বুদ্ধিজীবীদের আসলে কেমন হওয়া উচিত

আইনস্টাইন যখন তার আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশ করেন, তখন তিনি ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানের প্রচলিত ধ্যান-ধারণার একেবারেই বিপরীত কিছু কথা বলেন। অনেক পদার্থবিদ সেটি তখন ঠিকমতো বুঝতে পারেননি, আবার অনেকে পদার্থবিদ্যার এ ‘প্যারাডাইম শিফটিং’ মেনে নিতে পারছিলেন না।

তখন আপেক্ষিকতার তত্ত্বের সমালোচনা করে একটি আলোচিত বই বের হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘হানড্রেড অথরস এগেইনস্ট আইনস্টাইন’। এ বইটি সম্পর্কে আইনস্টাইনের মতামত চাওয়া হলে তিনি এক বাক্যে বলেছিলেন- তিনি যদি ভুল হন, তাহলে সেটি প্রমাণ করার জন্য তো একজনই যথেষ্ট।

এ মুহূর্তে দেশের রাজনীতির মাঠে নানা আলোচনা আছে, কিন্তু এর মধ্যেই আলাদাভাবে জায়গা করে নিয়েছে ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিকের নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ এনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদনের বিষয়টি।

আমরা কি আইনস্টাইনের মতো বলে দিতে পারি, নির্বাচন কমিশনের অসদাচরণ থাকলে সেটা বলার জন্য তো একজনই যথেষ্ট? এ ব্যাপারটা সম্ভবত সেই ঘটনার সঙ্গে তুলনীয় নয়। বিবৃতিদাতা ৪২ জনের নাম আমি পড়েছি, তাই এটি বলাই যায়, নানা ক্ষেত্রে কাজ করা এতগুলো মানুষের একত্র হয়ে দেয়া বিবৃতিটির বিষয় যেমন গুরুত্বপূর্ণ, একই সঙ্গে সংখ্যাটাও গুরুত্বপূর্ণ।

তারা যখন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে এ রকম একটা বিবৃতি দিলেন, তখন সেটি নানা কারণে বেশ আলোচনা তৈরি করেছে সমাজে। একদিকে সরকারবিরোধী পক্ষ এটিকে যেমন স্বাগত জানিয়েছে, অপরদিকে সরকারি পক্ষ ভীষণ রকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে নির্বাচন কমিশনও। বিবৃতিদাতাদের প্রতি অত্যন্ত অশোভন, আপত্তিকর মন্তব্য এসেছে।

বুদ্ধিজীবীরা নির্বাচন কমিশনের আচরণ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে বলেছেন। খুব যৌক্তিকভাবেই প্রশ্ন এসেছে, বাংলাদেশের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কি আছে? ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগ সর্বসম্মত রায় দিয়ে বলেছিলেন সংবিধানের ৯৬-এর ২-৭ অনুচ্ছেদ পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে এনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রতিস্থাপিত করতে।

এ রায়ের বিরুদ্ধে সরকার রিভিউ পিটিশন করেছে, এ অজুহাতে সংবিধান এখনও সংশোধন করা হয়নি। আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের সংবিধানে এখনও ৯৬-এর ২ অনুচ্ছেদে অভিশংসনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের ভোটের কথা বলা আছে।

ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার আগেই সরকার তড়িঘড়ি করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছিল; কিন্তু ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পর তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এ ব্যাপারে সরকারের নীতি বড়ই ধীরে চল।

হাইকোর্টের কোন রায় সরকার কার্যকর করবে আর কোনটা করবে না সেটি পুরোপুরি নির্ভর করে সরকারের নিজের সুবিধা-অসুবিধার ওপর।

এদিকে খুব যৌক্তিকভাবে এ আলোচনাও হয়েছে, নির্বাচন কমিশন যখন তার মূল দায়িত্ব অর্থাৎ একটি অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে, তখন সেটিকে প্রধান কারণ হিসেবে না দেখিয়ে কিছু আর্থিক এবং অন্যান্য অনিয়মকে কেন প্রধান কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে, যেসব অভিযোগ নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে সবগুলোরই বয়স প্রায় দুই বছর। তাহলে সেই ব্যাপারে এতদিন পর এসে বুদ্ধিজীবীদের পদক্ষেপ নিতে বলার কারণ কী? এ বিষয়টি আমার কলামের মূল বিষয়ের সঙ্গে জড়িত বলে এ প্রশ্নটিকেই আমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি এ লেখার ক্ষেত্রে।

জুলিয়ান বেন্ডা একজন ফরাসি ঔপন্যাসিক এবং দার্শনিক। নানারকম বিষয়ে লিখেছেন তিনি; কিন্তু সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত তার বই ‘দ্য বিট্রেয়াল বাই দ্য ইন্টেলেকচুয়ালস’। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত এ বইয়ে বেন্ডা এর আগের বেশ কয়েক দশকের এবং সেই সময়কার পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালদের ভূমিকা নিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন।

তিনি নানারকম উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন ইন্টেলেকচুয়ালরা তাদের নানারকম অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং শ্রেণিগত স্বার্থের কারণে সমাজে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে পারছেন না।

আমাদের নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে, এ তো এখনকার বাংলাদেশের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। অনেক দীর্ঘ সময় হয়ে গেছে যখন বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে বুদ্ধিজীবীরা আক্ষরিক অর্থেই ‘বুদ্ধিজীবী’ হয়েছিলেন। এ দেশে পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালের অনুবাদ করা হয়েছে বুদ্ধিজীবী।

কায়িক শ্রমের বাইরে যারা বুদ্ধি-জ্ঞান বিক্রি করে জীবিকা অর্জন করেন তাদের আমরা বুদ্ধিজীবী বলতেই পারি। বুদ্ধিজীবী বলতে আমরা যদি পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল বুঝিয়ে থাকি, তবে দীর্ঘকাল সেটার একটা খুব বড় শূন্যতা আমরা দেখতে পাই।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে একাদশ সংসদ নির্বাচন, বেশকিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং যেসব আর্থিক অনিয়ম এবং অসদাচরণের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির পদক্ষেপ দাবি করতে এত দেরি হওয়া বর্তমান সমাজে পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালদের ভূমিকা পালনের ব্যর্থতার খুব বড় একটি নজির হয়ে থাকবে। একইসঙ্গে এটি হয়তো আমাদের এক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেয় যে, বহুধাবিভক্ত পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালদের এক হতে গিয়ে এ দীর্ঘ সময় লেগেছে।

৪২ বিশিষ্ট নাগরিক তাদের আহ্বান জানিয়েছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে। এর মধ্যে স্বনামধন্য আইনজীবীরাও আছেন। সংবিধানের ৪৮(৩) ধারা অনুযায়ী শুধু প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ব্যতীত আর সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হয়। তার মানে আদতে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার কথা এলে সেটির উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। তাহলে এ নাগরিকরা কি বিশ্বাস করেন, বর্তমান সরকার নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিশংসনের জন্য কাজ করবে?

আমার কাছে মনে হয়, তারা নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগ এনে সেটি জনগণের সামনে প্রকাশ করতে পারতেন। এবং যুক্তি দিতে পারতেন এ অপরাধগুলোর কারণে বর্তমান কমিশন অভিশংসনযোগ্য। এরপর তারা সরকারের উদ্দেশে বলতে পারতেন, সরকার যা ইচ্ছা করুক তাদের কর্তব্য ছিল জনগণকে জানানোর তারা সেটা জানিয়েছেন।

কিন্তু তারা এমন একটি সিস্টেমের মধ্যে থেকে এমন একটি সিস্টেমের কাছে সুবিচার চাইছেন, সিস্টেমটি নিজেই সমস্যার মূল বলে বিশ্বাস করার খুব শক্ত ভিত্তি আছে। তাহলে এটি কি তাদের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারটাকে অনেক হালকা করে দিল না? এ কলামের শেষ অনুচ্ছেদ আমার এ প্রশ্নের জবাব দেব।

একটি সমাজে পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কাজের ক্ষেত্র হিসাব করলে রাজনীতিবিদ আর ইন্টেলেকচুয়ালদের কাজ করার ক্ষেত্র মোটামুটি একই। যে কোনো ইস্যুতে কাজ করার ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের কাজ করার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে যেখানে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়, সেখানে রাজনীতিকদের কিছুটা হলেও পপুলিস্ট হতেই হয়।

কারণ দিনের শেষে তাদের জনগণের কাছে ভোট চাইতে হয়। তাই রাজনীতিবিদরা সবসময় সব ইস্যুতে খুব নৈতিক অবস্থান শক্তভাবে নিতে পারেন না। এ প্রবণতা আমাদের এ অঞ্চলে অনেক বেশি হলেও পৃথিবীর উন্নত-বিকশিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও এর অস্তিত্ব আছে।

সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ দেয়া যাক। বিশ্লেষকরা অনেকেই বলছেন, জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণ করার পর চীনের সঙ্গে আমেরিকার কৌশলগত এবং ভূ-রাজনীতিগত প্রতিযোগিতা এবং উত্তেজনা থাকবে, তবে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো এতটা প্রকাশ্য যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখাবেন না।

মজার ব্যাপার হল, ট্রাম্পের সঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রচারণার সময় বাইডেন তার চীন নীতি নিয়ে খুব স্পষ্টভাবে কিছু বলেননি এবং এ প্রশ্নে ট্রাম্পের নীতিরও খুব শক্ত বিরোধিতাও করেননি। আসলে সেই সময়ে নানা কারণে আমেরিকার জনমত প্রচণ্ডভাবে চীনবিরোধী ছিল এবং সেটিকে বিবেচনা করেই বাইরে তখন অন্তত প্রচারণার ক্ষেত্রে সেই অবস্থান নেননি।

গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কাজ করার ক্ষেত্রে কখনও কখনও রাজনীতিবিদদের যে খামতি থাকে, সেই জায়গাটিকেই পূর্ণ করে তুলতে পারেন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালরা। যেহেতু তাদের পপুলিস্ট হওয়ার কোনো দায় থাকে না; তাই তারা সমাজের সবার সামনে সবচেয়ে সঠিক কথাগুলো বলতে পারেন।

৪২ নাগরিক বর্তমান ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার না করে সেটির কাছে তাদের দাবি পেশ করাতেই পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল হওয়ার খুব গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ভেঙেছেন বলে আমার ধারণা। কিন্তু তবুও তাদের এ কাজের একটি প্রতীকী মূল্য আছে তো বটেই। দীর্ঘকাল পর এত জন ‘উচ্চ সামাজিক পুঁজির মালিক’ মানুষের কোনো ইস্যুতে বক্তব্য দেয়ার ঘটনা ঘটল।

অতি আশাবাদী না হলেও এ রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে আমি খেয়াল করব ভবিষ্যতে তারা একইভাবে অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এগিয়ে আসেন কিনা। গত ৫-৬ বছরের ইতিহাসকে ভবিষ্যতে নানাদিক থেকে দেখা হবে। আমি বিশ্বাস করি, সেসময় এটিও খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে; এ সময়টায় আমাদের পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালদের ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে এক ভীষণ শূন্যতা তৈরি হয়েছিল।

কেমন হওয়া উচিত পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালদের? কী হওয়া উচিত তাদের আসল ভূমিকা? ‘রিপ্রেজেন্টেশনস অব দ্য ইন্টেলেকচুয়ালস’-এ অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালদের সম্পর্কে যা বলেছেন, সেটি দিয়েই শেষ করা যাক এ কলামটি- ‘ইন্টেলেকচুয়াল একজন মানুষ যিনি জনগণের স্বার্থে তাদের সামনে কোনো বক্তব্য, মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা দর্শনকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখেন।

একজন ইন্টেলেকচুয়ালের ভূমিকা পালনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে বিব্রতকর হলেও প্রকাশ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করা এবং গোঁড়ামি ও কর্তৃত্ববাদী মতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা; নিজে তেমন মত তৈরি করার তো প্রশ্নই আসে না। তারা এমন মানুষ হবেন, যাদের সরকার বা বড় বাণিজ্যিক কর্পোরেশন নিজ পক্ষে ভিড়িয়ে ফেলতে পারবে না। তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার মূল বিষয় হবে জরুরি বিষয়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলা যেগুলো আমরা নিয়মিতভাবে ভুলে যাই, কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ময়লার মতো কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলা হয়।’

ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট

 

সুত্রঃ যুগান্তর