‘বুকে চাপা কষ্ট নিয়েই পড়ে আছি বৃদ্ধাশ্রমে’

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক:

‘আমি এখানে থেকে মরতে চাই, কোথায় যাব? আমার আপন থেকেও এখন কেউ নেই, আমি যেতেও চাই না তাদের কাছে।’ বুকে চাঁপা কষ্ট নিয়ে আজ শুক্রবার বিকেলে কথাগুলো বলছিলেন নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার চন্ডিগড় গ্রামের অনিকেত বৃদ্ধাশ্রমে থাকা শোভা রানী পাল।

চন্ডিগড় গ্রামের নাথপাড়া গ্রামের প্রয়াত নিত্যানন্দ গোস্বামী নয়ন, মানব কল্যাণকামী অনাথালয়, অনিকেত বৃদ্ধাশ্রম, বিনামূল্যে হোমিও দাতব্য চিকিৎসালয় ও বিনামূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ গড়েছেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে। ওনার স্ত্রী অনাথমাতা নিশা দেবীর কাছ থেকে জানা গেলো বৃদ্ধাশ্রমে থাকা প্রবীণদের কথা।

এখানে আশ্রিতরা বেশিরভাগই শারীরিকভাবে অসুস্থ। জরাজীর্ণ এই ভবনে নেই গ্যাস, পানির সুব্যবস্থা। ইলেকট্রিক আলোর ব্যবস্থা থাকলেও তা তুলনামুলকভাবে অনেক কম। আশ্রিতদের কেউ সাভার, কেউ কুমিল্লা আবার কেউবা চট্রগ্রাম এলাকা থেকে এসেছেন এখানে। ছেলে সন্তানরা কেউ তাদের খোঁজ নেন না। বৃদ্ধাশ্রম নয় এ যেন ভালোবাসার এক নিষ্ঠুর কারাগার। মা নামক এই ভালোবাসাগুলো সারাদিন জানালা দিয়ে অপলোক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে, এই বুঝি তার ছেলে-মেয়েরা এলো, তাকে বুকে জড়িয়ে বলবে বোধহয়, ‘মা তোমায় নিয়ে যেতে এসেছি, চলো। আজ থেকে তুমি আমার সাথে আমার বাসাতেই থাকবে।’

অসহায় মায়েদের ইচ্ছেগুলো বুঝি পূরণ হয় না। তাদের ছেলে সন্তানরা কেউ বুঝি খোঁজ নিতে আসে না, জানতে চায় না কেমন আছে তাদের মা। সন্তান জন্মের পর যখন কান্নার আওয়াজ ছাড়া যখন কোনো শব্দ ছিল না ওই ছোট শিশুটির, তখন পাশে থাকা সেই মাকে আজ বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে ফেলে রাখা হয়েছে। ভাবতেই কেমন গাঁ শিহরে ওঠে।

খোলা বারান্দায় পায়চারি করছেন বৃদ্ধাশ্রমে থাকা কয়েকজন। কেউ আবার গীতা পাঠ করছেন। বারান্দায় বসে কয়েকজন আবার নিভৃতে তাকিয়ে রয়েছেন খোলা আকাশের দিকে। সব মিলিয়ে কেমন যেন এক হাহাকার। চোখে চোখ পড়তেই মনে হচ্ছে, কত না বলা কথা, কত অভিযোগ জমে আছে ওই দৃষ্টিগুলোতে। পাওয়া না পাওয়ার হিসেব না করেই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বৃদ্ধ মায়েরা।

শোভা রানী পাল (৭১)। অল্প বয়সেই স্বামীকে হারিয়েছেন। সংসারে এক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে এখন অসহায় তিনি। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। মেয়ের সংসারে থাকার মতো পরিস্থিতিও নেই। কেননা মেয়ের শ্বশুরবাড়ির কেউ তাকে গ্রহণ করবে না। এমন পরিস্থিতিতে ভাইয়েরা মিলে তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যান প্রায় ৭ বছর আগে। তখন থেকেই এখানেই বুকে চাঁপা কষ্ট নিয়ে মুখ বুজে পড়ে আছেন তিনি।

অন্য কক্ষে থাকেন শিলা রানী পাল (৬১)। শারীরিক প্রতিবন্ধী বিধায় বিয়ে হয়নি তার। বড় ভাইয়ের দুই ছেলেকে নিজের প্রাপ্ত সম্পত্তি টুকু বিক্রি করে অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন। তাদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। এখন একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, অন্যজন থাকেন কুয়েত। দুই ছেলের কোনো এক পরিবারেও তার ঠাঁই হয়নি। প্রায় ৮ বছর ধরে এই বৃদ্ধাশ্রমেই কাটাচ্ছেন তিনি। কেউ কোনো খোঁজ নিতেও আসেন না।

অনাথ মাতা নিশা দেবী বলেন, ‘মানব কল্যাণকামী অনাথালয়, অনিকেত বৃদ্ধাশ্রম, বিনামূল্যে হোমিও দাতব্য চিকিৎসালয় ও বিনামূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণের মতো প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন নিত্যানন্দ গোস্বামী নয়ন। আজ তিনি নেই, সদস্য চাঁদা ও সরকারি অনুদানের (চাহিদার তুলনায় কম) মাধ্যমে কোনোরকমভাবে ধরে রেখেছি প্রতিষ্ঠানগুলো। টাকার জন্য বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায় দেয়াল তুলতে পারছি না। এখানে থাকা অনাথ ছেলে-মেয়ে ও বৃদ্ধাশ্রমে থাকা প্রবীণদের ভালোমন্দ খেতে দিতে না পারলেও মায়া মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছি তাদের। দেশের ধনাঢ্য পরিবার ও ব্যক্তিদের প্রতি আমার আকুল আবেদন, অনাথ ছেলে-মেয়ে ও প্রবীণদের মুখে একমুঠো অন্ন তুলে দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন।’ সূত্র: কালের কণ্ঠ