বিয়ে: পরিবার গঠনের পূর্বশর্ত ।। ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম

মানব সমাজের নূন্যতম একক সংস্থা হল পরিবার। এই সংস্থার সৃষ্টি হয় পরিবারের মাধ্যমে। মানব পরিবার বিবাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। সুতরাং পরিবারের ভিত্তি হল বিবাহ। এই বিবাহের মাধ্যমে পরিবার সমাজে স্বীকৃতি লাভ করে এবং স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিয়ে হলো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিয়ে ব্যবস্থা নতুন পরিবারের ভিত্তি রচনা করে। বিয়ের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় নতুন পরিবার। বিয়ে হলো মানব সমাজের এক অত্যন্ত প্রাচীন প্রথা। বর্তমানে বিয়ে সভ্য সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সমাজের স্থায়িত্ব ও সংহতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিয়ের ভূমিকা অপরিসীম। সমাজের মধ্যে বিয়ে ব্যবস্থার মাধ্যমে নতুন নতুন সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমে বন্ধন গড়ে উঠে। এই বন্ধনের পরিপ্রেক্ষিতে মানব সমাজের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান। মানব সমাজে বিয়ে একটি বিশ্বজনীন রীতি যা কিছু আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। সব ধর্মেই বিয়ে প্রথা চালু রয়েছে। বিয়ের মাধ্যমে নারী-পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়। যখন কোন নারী -পুরুষকে একত্রে বসবাসের সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তখন তাকে বিয়ে বলে।
বিয়ে পরিবারের অন্যতম উপাদান। বিয়েকে বাদ দিয়ে পরিবারকে কল্পনা করা যায় না। কারণ বিয়ের মাধ্যমেই একটি পরিবারের সৃষ্টি। বিয়ে হচ্ছে এমন একটি কার্যপ্রণালী যার মাধ্যমে পারিবারিক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। বিয়ের মাধ্যমে নারী-পুরুষের মধ্যে একটি পবিত্র সেতু বন্ধন রচিত হয়। বিয়ে হল পরিবার গঠনের পূর্বশর্ত। বিয়ের মাধ্যমে নর-নারীর যৌন চাহিদা পূর্ণ হয় এবং সন্তানদের বৈধ সামাজিক স্বীকৃতি মেলে। সঞ্জীব চট্টপাধ্যায় এর মতে, পৃথিবীটা কিসের উপর ঘুরছে জানো? শ্রেফ দু’টো শব্দ- ‘বিয়ে’। ওলন্দাজ প্রবাদ অনুসারে, একবার বিয়ে করাটা কর্তব্য, দু’বার বিয়ে করাটা বোকামি ও ভুল, তৃতীয়বার বিয়ে করাটা পাগলামি। এলেন কি’র মতে, ‘সত্যিকার বিবাহের একটি মাত্র শর্ত থাকবে-যারা পরস্পরকে ভালবাসে তারাই স্বামী-স্ত্রী।’ আবার রিচার্ড ডিউকের মতে, ‘আমি যেহেতু বিবাহিত মানুষ, সেহেতু আমার ব্যাথা বেদনার অন্ত নেই।’
বিয়ের আরবী শব্দ হলো নিকাহ্। নিকাহ্ এর শাব্দিক অর্থ হলো একত্রিত হওয়া, নারী-পুরুষ বৈধভাবে মিলিত হওয়া। ইসলাম ধর্মমতে, বিয়ে করা উত্তম ইবাদত। মানসিক দুঃখ নিবারক, শান্তিদায়ক ও ধর্মের সহায়ক। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহ মানুষকে যে সকল সম্পদ দান করেছেন, তার মধ্যে ঈমানের পর সতী স্ত্রী অপেক্ষা আর কিছুই নেই। বিবাহিত ব্যক্তির এক রাক’আত নামায অবিবাহিত ব্যক্তির সত্তর রাক’আত নামায হতে উত্তম। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, কোন আবেদের ইবাদত বিয়ে ব্যতীত পূর্ণ হয় না, বিয়ে ধর্ম সাধনাকে পূর্ণতা দান করে। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, যে বিয়েকে অস্বীকার করে সে আমার কেহ নয়। ইসলামে বিয়ে হলো একটি সুন্নাহ বা মুহাম্মদ (সাঃ) এর আদর্শ।

ইসলামে বিয়ে করার জন্য অত্যন্ত জোরালো ভাবে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ইসলামে সন্ন্যাস জীবন এবং কৌমার্যেরও কঠোরভাবে বিরোধীতা করা হয়েছে। ইসলাম শরীয়ত অনুসারে বিয়ের মূল স্তম্ভ হচ্ছে: ১) ইজাব তথা প্রস্তাব, ২) কবুল বা গ্রহণ। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ‘তিনি তোমাদের (স্বামী-স্ত্রী) একে অন্যের সাথী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া প্রবিষ্ট করেদিয়েছেন।- সূরা রুম-২১)। কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘স্ত্রীরা হচ্ছে তোমাদের পোশাক স্বরূপ, আর তোমরাও তাদের জন্য পোশাক স্বরূপ। (সূরা বাকারা: ১৮৭) হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের বলেছেন, হে যুবক! তোমাদের মধ্যে যে সামর্থ্যবান সে যেন বিবাহ করে। কেননা তা চক্ষু সংযতকারী এবং লজ্জাস্থানের হেফাজতকারী। আর যে অসমর্থ্য, সে যেন রোজা রাখে। রোজা তার কামভাবের নিয়ন্ত্রণ করবে। (নাসাঈ: ৩২১২)। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিরকুমার হতে নিষেধ করেছেন। (নাসাঈ: ৩২১৬)। হযরত আব্দুল্লাহ (রা:) থেকে বর্ণিত। নবী করীম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হে যুবকদল তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিয়ে করে নেয়। কেননা, বিয়ে দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং যৌন প্রবৃত্তিতে সংযমশীল করে। আর যে বিয়ে করার সামর্থ্যই রাখে না, সে যেন রোজা রাখে। কেননা, রোজা তার যৌন কামনাকে নিবৃত্ত করে। (বুখারী: ৪৬৯৬)।
ব্যক্তির অবস্থা ও আনুষাঙ্গিক সক্ষমতা ভেবে বিয়ে করা কারো জন্য ফরজ, কারো জন্য ওয়াজিব এবং কারো জন্য সুন্নত। কোন ব্যক্তি যদি স্ত্রীর ভরণ পোষণের ক্ষমতা রাখে বা নিজের প্রতি সেই আস্থা ও আত্মবিশ্বাস থাকে এবং তার জৈবিক চাহিদা এমন প্রবল হয় যে, বিয়ে না করলে তার দ্বারা ‘যৌন অনাচার’ ঘটে যাবে, এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিয়ে করা ফরজ। হাদীসে বর্ণিত রয়েছে, ‘হে যুবক সম্প্রদায় তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করতে সক্ষম হবে তারা যেন বিয়ে করে নেয়। কেননা বিয়ে দৃষ্টিকে অবনত ও গুপ্তাঙ্গের রক্ষণাবেক্ষণে অধিক কার্যকর। আর যে ব্যক্তি বিয়ে করতে অক্ষম সে যেন রোজা রাখে। রোজা তার যৌন আকাঙ্খাকে দমিত করে’- (বোখারী, মুসলিম)। খাদ্য গ্রহণ যেমন মানবজীবনে অপরিহার্য, একজন যৌবন দীপ্ত মানুষের সুস্থ জীবন যাপনের ক্ষেত্রে বিয়ের প্রয়োজনীয়তাও তেমনি। হাদিসে আরও বর্ণিত রয়েছে- ‘সন্তান পূর্ণ বয়স্ক বা পরিণত বয়স হলে তাকে বিয়ে করাবে। যদি বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পরে তার বিয়ে না হয়, এ কারণে সে ব্যভিচার বা এই সংক্রান্ত কোন পাপ করে তা পিতা-মাতার ওপর বর্তাবে।’ (মেশকাত, বায়হাকী)।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আজকের পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের দেখা যায় তথাকথিত সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান বিচার করে পরিণত বয়সের ছেলে মেয়েদের বিয়ের সময়কালকে বিলম্বিত করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, তারা একবারও পুত্র-কন্যাদের শারীরিক ও মানসিক প্রয়োজনের দিকটি বিবেচনা করেন না। লজ্জার কারণে সন্তানেরাও বিষয়টি মা-বাবা বা অভিভাবকদের কাছে তুলে ধরতে পারে না। এমতাবস্থায় অনিবার্যভাবে তরুণ তরুণীদের জীবনে যৌন অপবিত্রতার ঘটনা ঘটতে পারে। সন্তানের এমন পাপের দায়ভার পিতা-মাতার ওপরই বর্তাবে। সন্তানের পূর্ণ বয়স বা পরিণত বয়স কাকে বলে বা কত বছরকে বলা হবে, সে সম্পর্কে ভিন্ন মত রয়েছে। মুজাহিদ বলেছেন, ৩৩ বছর। সুদ্দী বলেছেন, ৩০ বছর। জুহাক বলেছেন, ২০ বছর। আবার কালাবী বলেছেন, ১৮-৩০ বছর। তবে এই বয়স সীমাকেই একজন পুরুষের ‘পরিণত বয়স’ বলে ধরা হয়। আরবী ভাষায় যৌবনের পূর্ণতা প্রাপ্তিকে বলা হয়, ‘আশুদ্দাহ’। ইমাম মালেক (রহ:) এর অর্থ সম্পর্কে বলেছেন, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। অর্থাৎ একজন মানুষ জ্ঞান ও প্রজ্ঞাবান হয়ে ওঠার সাথে পরিণতও হয়ে ওঠে।  (তফসীরে মাযহারী, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ: ১৬৬)। আমাদের দেশে আইন অনুসারে বিয়ের বয়স ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ বছর এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর ধার্য করা আছে।
বাংলাদেশের সর্বত্র বিয়েকে বিয়ে কিংবা বিবাহ নামে সম্বোধন করা হলেও অঞ্চল ভেদে আঞ্চলিকভাবে আরও বিভিন্ন উচ্চারণ ভঙ্গিতে ডাকা হয়। যেমন-বিয়্যা বা বিয়া (বিআ) কিংবা বিহা, শাদী। সর্ব ক্ষেত্রেই বিয়ের মোটামুটি তিনটি মূল অংশ। যথা- ১. গায়ে হলুদ, ২. বিয়ে, ৩. বৌভাত। বিশ্বের অনেক দেশেই বিয়ের অনুষ্ঠান একদিনের মধ্যে শেষ হয়ে গেলেও বাংলাদেশের বিয়ে শেষ হতে কয়েকদিন লেগে যায়। বিয়ের মুখ্য আয়োজনই থাকে কমপক্ষে তিন কি চারদিন ব্যাপী। বাংলাদেশের বিয়েতে যৌতুক বা পণপ্রথা বহু প্রাচীন। বাংলাদেশের বিয়ের ক্ষেত্রে বরের পক্ষ থেকেই সাধারণত বিয়ের প্রস্তাব কনে পক্ষের নিকট পেশ করা হয়, তাই বর পক্ষ বাংলাদেশের বিয়েতে একটি সক্রিয় অংশ। তবে কখনো কখনো এর ব্যতিক্রম ঘটিয়ে কনে পক্ষ বর পক্ষকে প্রস্তাব দিয়ে থাকে।

অঞ্চলভেদে বাংলাদেশের বিয়ের অনুষ্ঠান বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। এ দেশের প্রতিটি বিয়েতে থাকে আনন্দঘন পরিবেশ। মুসলমান ছাড়া এদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুসারে বিয়ে সম্পন্ন করে থাকেন। বাংলাদেশে সব মিলিয়ে ৪৫টি আদিবাসী গোষ্ঠী বসবাস করে। তাদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা বিয়ের রীতি রয়েছে। হিজড়ারা সাধারণত বিয়ে করতে পারেন না। কারণ তারা নপুংশক। তবে অপারেশনের মাধ্যমে যে সকল হিজড়াকে নারী বানানো সম্ভব হয়, তারা সম্পূর্ণ নারী হলেও গর্ভধারণে অক্ষম বলে সন্তানহীন ক্লেষাচ্ছাদিত বিবাহিত জীবনের চেয়ে অবিবাহিত থাকাটাই পছন্দ করেন।

বিয়ের দু’টো দিক রয়েছে। একটি ইতিবাচক এবং অপরটি নেতিবাচক।
বিয়ের ইতিবাচক দিকগুলো হলো:
১. নর-নারীর স্বামী-স্ত্রীতে পরিণত হওয়ার এক সমাজ স্বীকৃত উপায়, ২. পুরুষ ও মহিলার মধ্যে এক ধরণের চুক্তির সম্পর্ক যা ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি কর্তৃক অনুমোদিত, ৩. একজন নারী ও একজন পুরুষের মধ্যে আপেক্ষিক ভাবে স্থায়ী এবং সমাজ স্বীকৃত পবিত্র বন্ধন, ৪. নারী ও পুরুষের মধ্যকার কমবেশী স্থায়ী একটি সম্পর্ক বিশেষ যা সন্তান জন্মদানের পর অব্যাহত থাকে, ৫. একটি জন সমর্থিত ও আইন সম্মত বন্ধুত্ব, ৬. একটি সামাজিক চুক্তিপত্র যা একজন পুরুষ ও একজন মহিলার মধ্যকার যৌন ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের নিশ্চয়তা দান, ৭. জীবনের সবচেয়ে বড় একটি মুহূর্ত, ৮. এক মহান দায়িত্ব, নতুন জীবনে পা রাখার আনুষ্ঠানিকতা, ৯. নিয়ন্ত্রিত যৌন আচরণ অপেক্ষা অধিক কিছু এবং গার্হস্থ্য ধর্ম পালনের উপায়, ১০. জীবনে স্মৃতি গড়ার প্রথাগত উদ্যোগ নেওয়া, ১১. বেঁচে থাকার প্রেরণা, ১২. আকাশ ছোঁয়ার রঙ্গিন স্বপ্ন এবং একরাশ ভালবাসা, ১৩. দু’টো জীবন একত্রে থেকে এগিয়ে যাওয়া, ১৪. কেবলমাত্র যৌন সম্ভোগের ছাড়পত্র নয়, ১৫. নারী-পুরুষের মধ্যে এক অটুট বন্ধন, ১৬. নারী-পুরুষের ধৈর্র্য্য ও নৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, ১৭. নারী-পুুরুষের যৌন সম্পর্কের সমাজ স্বীকৃত ব্যবস্থা, ১৮. নারী-পুরুষের যৌন মিলনের এক সমাজ অনুমোদিত উপায়, ১৯. সুখ-শান্তির পথে অগ্রযাত্রা, ২০. পরিপূর্ণ সুখময় ও অনাবিল আনন্দের অফুরন্ত সমাহার, ২১. আশার উথাল-পাথাল ঢেউ এবং স্বপ্নের ঝিকিমিকি আলো, ২২. সব সময় স্বস্তির সুবাতাস, ২৩. অনন্ত সুখের এক টুকরো স্বপ্ন, ২৪. স্মৃতির কোঠায় এক স্থায়ী ছাপ, ২৫. পরিপূর্ণ এক জীবন যেখানে রয়েছে শুধু নিশ্চয়তা আর নির্ভরতা, ২৬. স্বত্বস্ফূর্ত আবেগ, উৎসাহ নিয়ে বাস্তবতার প্রতিফলন, ২৭. সম্ভাবনা আর সফলতার দ্বার উন্মোচিত হওয়া,। ২৮. সন্তান উৎপাদন ও লালন পালনের একটি চুক্তিমাত্র, ২৯. নারী ও পুরুষের জৈবিক চাহিদা বৈধভাবে পূরণের একমাত্র অবলম্বন, ৩০. একটি সুস্থ, সুন্দর, সংযত প্রক্রিয়া, ৩১. দুই বিপরীত ¯œায়ুতন্ত্রের শান্তিপূর্ণ অবস্থান, ৩২. নারী ও পুরুষের মধ্যে নিষ্পন্ন বৈধ বন্ধন ও সামাজিক চুক্তি, ৩৩. সুনিয়ন্ত্রিত যৌনাচারের সামাজিক স্বীকৃতি, ৩৪. স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে এক সেতুবন্ধন, ৩৫. পরিবার গঠন এবং জীবনের দায়-দায়িত্বপালনে অংশীদার হওয়া, ৩৬. একটি ধর্মীয় দায়িত্বের পাশাপাশি দেওয়ানী চুক্তিও, ৩৭. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সাহচর্য, সহানুভূতি, প্রেম প্রীতি ও ভালবাসা, ৩৮. নারীর সম্পূর্ণ ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করা, ৩৯. দু’টি পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তার যোগসূত্র হওয়া, ৪০. দেহ-মনকে সতেজ করে, ৪১. জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ আমোদ ও প্রমোদও বটে, ৪২. যৌন জীবনকে সুষ্ঠু, স্থিতিশীল ও বিকারহীন রাখার জন্য একটি সুসম্পন্ন জীবন ধারা, ৪৩. মানব জীবনকে পরিস্ফুটিত করে, ৪৪. অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যার প্রভাবে জীবন অনেকটাই বদলে যায়, ৪৫. একটি বৈশ্বিক সার্বজনীন সংস্কৃতি, ৪৬. দম্পত্তির মাঝে সমাজ স্বীকৃত বা আইনগত দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করে, ৪৭. বংশ বিস্তার ও উত্তরাধিকারের সুযোগ সৃষ্টি, ৪৮. মূলত একটি ধর্মীয় রীতি এবং আইনী প্রথা। ৪৯. একটি ধর্মীয় দায়িত্বের পাশাপাশি দেওয়ানী চুক্তিও, ৫০। নারী ও পুরুষের মধ্যে নিষ্পন্ন বৈধ বন্ধন ও সামাজিক চুক্তি। ৫১. নর-নারীর মধ্যে স্বামী-স্ত্রীতে পরিণত হওয়ার এক সমাজ স্বীকৃত উপায়, ৫২. বৈধ ও নৈতিক একটি প্রতিষ্ঠান, ৫৩. সব সময় স্বস্তির সুবাতাস, ৫৪. শিশু বৈধভাবে পৃথিবীতে আর্বিভূত হওয়ার মাধ্যম, ৫৫. পিতৃত্বের স্বীকৃতি, যৌন সম্ভোগের ছাড়পত্র, ৫৬. এক ধরণের ব্যক্তিগত ও পারস্পরিক সম্পর্ক, ৫৭. যৌন আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণ ও স্বাভাবিক রাখার পন্থা, ৫৮. স্ত্রী-পুত্র-কন্যার ভরণ পোষণের দায়-দায়িত্ব বহন, ৫৯. রতি সুখের বিষয়, ৬০. দু’টি পরিবারের মহামিলন, ৬১. সুখ-শান্তি লাভে স্থিরিকৃত ক্ষেত্র, ৬২. দিনগুলি হয়ে যায় প্রশান্তিতে মুখর, ৬৩. পরিবার গঠন ও বংশ বৃদ্ধির একমাত্র বৈধ উপায়, ৬৩. নারী-পুরুষের সহজাত দৈহিক কামনাকে সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত রাখা, ৬৪. নতুন নতুন সামাজিক সম্পর্কের বন্ধন গড়ে ওঠা, ৬৫. উভয়পক্ষের পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তার যোগসূত্র সৃষ্টি, ৬৬. মানুষের বহুবিধ পারস্পরিক সম্পর্কের মূল নিয়ামক, ৬৭. স্বাভাবিক বিকাশ ও জীবন যাপনের পথ প্রশস্ত এবং স্বাচ্ছন্দ্য হওয়া।
কখনো কখনো বিয়ের নেতিবাচক দিকগুলো হলো:
১. শুধু শাসন আর অনুযোগ এবং শৃঙ্খলিত জীবন, ২. কখনো স্মিত হাসি কিংবা কখনো কালো মুখ, ২. চলার পথে শুধুই বাঁধা এবং জবাবদিহিতা, ৩. পদে পদে শুধু বিড়ম্বনা, ৪. অশান্তির কালো ছায়া আর ঝক্কি-ঝামেলা, ৫. কখনো আত্মহত্যার পথে এগিয়ে যাওয়া, ৬. অশান্তির আবরণে আবদ্ধ হওয়া, ৭. কখনো পড়ন্ত বেলার অস্তমিত সূর্যের ন্যায় বিষাদময় অশান্ত জীবন, ৮. কখনো অল্প বিস্তর ঠোকাঠুকি এবং উত্তপ্ত কথার লড়াই, ৯. হাসি-কান্নার ডামাডোলে অশ্রুসিক্ত হওয়া, ১০. অহেতুক ভোগান্তির শিকার, ১১. উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা, ১২. এক গুচ্ছ ব্যর্থতার গ্লানি আর দুঃখ ভরা কিছু মধুময় স্মৃতি, ১৩. কখনো বিভীষিকাময় আতঙ্ক আর শঙ্কার দুঃসহ যাতনা ভোগ করা, ১৪. কখনো অশান্তি, ঝগড়া-ঝাটি, মনোমালিন্য, বিচ্ছেদ এবং বেদনার বিরহ, ১৫. কখনো দুশ্চিন্তাযুক্ত, বিষাদময়, নিরানন্দ এবং হতাশাগ্রস্থ জীবন, ১৫. খরচের হিসাব খোলা, ১৬. উত্তাল সাগরের অশান্ত ঢেউ, ১৬. অস্তমিত সূর্যের মতো অসহায় হওয়া, ১৭. ভাঙ্গা বেহালার অসংলগ্ন করুণ সুর, ১৮. কখনো আস্থাভাজন, বেশির ভাগ সময়ই বিরাগভাজন, ১৯. চাহিদার নেই কোন শেষ, ২০. খর¯্রােতা নদীর তীর ভাঙ্গা ঢেউ, ২১. ঘাত-প্রতিঘাতে বেসামাল হওয়া, ২২. সংসার সমুদ্রে ঝড়-ঝাপটার সম্মুখিন হওয়া, ২৩. প্রাত্যহিক অশান্তি, বিষাদে বিপর্যস্ত হয়ে ওঠা, ২৪. মাঝে মাঝে বিষাদময় জীবন, ২৫. সংকটের সৃষ্টি, ২৬. অসহনীয় অসামঞ্জস্যের আশংকা, ২৭. দুর্বিসহ জীবন, ২৮. বিপর্যয়ের সম্ভাবনা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিয়ের ক্ষেত্রেও বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে বিয়ের সঙ্গে নৈতিক আদর্শের ধারণা সংযত হয়েছে। বিয়ে প্রথার সৃষ্টি হয়েছে সম-সাময়িক প্রয়োজন বা আস্থা অনুসারে। বিয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের আচার-অনুষ্ঠানও বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন ধরণের বিয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। আর স্বামী-স্ত্রীর সংখ্যাও প্রত্যেক সমাজে ভিন্ন। বাংলাদেশে একক বিয়ে প্রথা সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। আইন অনুসারে এদেশে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে দ্বিতীয় বিয়ে করা যায়। যদিও ইসলাম ধর্ম অনুসারে সামর্থ থাকলে ৪টি পর্যন্ত বিয়ে করা জায়েয। জাতিসংঘের শান্তি রক্ষীবাহিনীর সদস্য হিসেবে সুদানের দারফুর প্রদেশের রাজধানী নিয়ালায় চাকুরী করাকালীন দেখেছি- যেহেতু সুদান মুসলিম দেশ, সেহেতু সামর্থ থাকলে তাদের সমাজে কেউ কেউ ৪ টি বিয়ে করে থাকেন। সেখানে কোন লোককে মাথায় সাদা পাগড়ি এবং হাতে লাঠি থাকলে বুঝতে হবে তার ৪টি স্ত্রী রয়েছে। এটি ঐ দেশের প্রথা। আবার কোন মেয়ের পায়ে আলতা ও হাতে মেহেদী লাগানো থাকলে বুঝতে হবে তিনি বিবাহিতা।
আমাদের দেশে বিয়েতে সাধারণত মেয়ে পক্ষ ছেলে পক্ষের চাপে অথবা স্বেচ্ছায় সামর্থ অনুযায়ী যৌতুক বা প্রচুর উপহার সামগ্রী দিয়ে থাকেন। কিন্তু সুদানে জাতি সংঘ বা শান্তি বাহিনীতে চাকুরী করা কালীন সময়ে দেখেছি সেখানে একটি মেয়েকে বিয়ে করতে হলে তার পিতাকে অনেক উট বা দুম্বা কিংবা ছাগল উপহার স্বরূপ দিতে হবে। তা না হলে মেয়েকে কোন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবেন না। আর এই কারণেই সুদানে অনেক ছেলেই বিয়ের টাকা যোগাড় করতে না পেরে অবিবাহিত থেকে যান। তার উপর সুদানী মেয়ে যদি লম্বা হয়, বিয়ের বাজারে তার চাহিদা খুব বেশী। তাকে বিয়ে করতে হলে প্রায় ৩০টি উট অথবা ৬০টি দুম্বা অথবা ৬০টি ছাগল উপহার স্বরূপ কনের পিতাকে দিতে হবে। বিয়ের খরচ তো আলাদা রয়েছেই। একবার এক ক্যাম্পে ডিউটি করার সময় আমার এক ইয়েমেনী পুলিশ অফিসার বন্ধু কিছু ফল ও বিস্কুট এনে খুশী মনে আমাকে সেগুলো খেতে বলেন। প্রায় সময়ই তাকে খুব একটা কথা না বলে মুখ কালো করে চুপচাপ থাকতে দেখি। অথচ ঐদিন সে কেন জানি খুবই আনন্দিত এবং হাস্যোজ্জ¦ল ছিল। এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে জানায়, এবার ছুটিতে গিয়ে সে ৩য় বিয়ে করবে। শুনে আমি কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে যাই। আমাকে হতবাক হতে দেখে সে বলে, তোমার কয়টি স্ত্রী। উত্তরে বলি একজন। সে বলে তোমরা কেমন মুসলমান যে মাত্র একটি বিয়ে করেছো? এবার বাংলাদেশে গিয়ে আরেকটি বিয়ে করবে, কয়েক বছর পরে আরো ২টি। কথা প্রসঙ্গে সে জানায়, সামর্থ থাকলে ইসলামে তো ৪টি বিয়ে জায়েয। আমি তাকে বিনয়ের সাথে জানাই, যদিও আমরা মুসলিম তথাপি আমাদের আইনে একক বিয়ে প্রথা চালু রয়েছে। দ্বিতীয় বিয়ে করতে হলে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি প্রয়োজন। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া কেউ যদি বিয়ে করে তবে তার সাত বছরের জেল হবে। এ কথা শুনে সে আশ্চর্য হয়ে পুনরায় বলে, তোমরা কি ধরণের মুসলমান? আমি প্রতি উত্তরে বলি, এটাই আমাদের দেশের আইন ও প্রথা। তবে প্রথম স্ত্রী মারা গেলে কিংবা অসুস্থতাজনিত কারণে তিনি যদি মত দেন তবে কেহ দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে। আমার ইয়েমেনী বন্ধু আমার কথা শুনে পিঠ চাপড়িয়ে রসিকতা করে বলে, তোমাদের কপালটাই খারাপ। আমিও রসিকতা করে বলি, সুখ যদি আসে তবে একটিতেই আসবে। আর যদি না আসে তবে ৪টিতেও নয়। তবে মাঝে মাঝে আমাদের দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় কিছু বিয়ে পাগল লোকের খবর ফলাও করে ছাপা হয়। তারা এক ডজনেরও অধিক আবার কেউ বা এর চেয়ে বেশি বিয়ে করে থাকেন। তারা বিয়ে করে কিছু দিন সংসার করার পর ঐ স্ত্রীকে ছেড়ে আরেকজনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিয়ে করাই যেন তাদের নেশা। একবার এক ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন কালে হঠাৎ হৈ চৈ, শোরগোল এবং ঢোলের বাজনার শব্দে উপরে সেন্ট্রি পোষ্টে গিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখি, ৭০/৮০ জন সুদানী পুরুষ ও মহিলা একটি মেয়েকে সাজিয়ে নিয়ে ঢোল বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে নাচানাচি করছেন। কৌতুহলী হয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি মেয়েটি কনে। তার বিয়ে উপলক্ষে এই নাচ গান ও বাজনার আয়োজন। এটিই সুদানের প্রচলিত রীতি। আমি এই সুন্দর মুহূর্তটিকে গোপনে ভিডিও করে রাখি। উল্লেখ্য যে সুদানে ছবি তোলা এবং ভিডিও করা নিষেধ। ইসলাম ধর্ম অনুসারে এটি তাদের কাছে গুনাহের কাজ।
বিয়ে হচ্ছে অনাবিল সুখ-শান্তির আমরণ প্রতীক। বিয়ের মাধ্যমে জীবনের পরিপূর্ণতা আসে। বিয়ের কারণে স্ত্রী যেমন পায় সামাজিক নিরাপত্তা। পাশাপাশি স্বামীও পায় সংসার জীবনে সুখ-দুঃখের চিরসাথী। প্রবাদ বাক্য আছে, সংসার সুখের হয় স্বামী-স্ত্রীর গুণে। সংসার সুখের না হলে বিয়ের সার্থকতা কখনই খুঁজে পাওয়া যায় না। জীবনটা এলোমেলো এবং ছন্নছাড়া হয়ে দুঃখের সাগরে অনবরত ভাসতে থাকে। তাই নিজের সাথে সাথে বিয়ে সবার জীবনে বয়ে আনুক চিরসুখ আর আনন্দ। এক্ষেত্রে উভয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ প্রয়োজন। তবেই মিলবে সুখ, নচেৎ নয়।

লেখক: পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তা (অবঃ)
(আইজি ব্যাজ, জাতিসংঘ এবং রাষ্ট্রপতি পদকপ্রাপ্ত)