বিষণ্ণ শহরে মন্দাক্রান্ত মানুষ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

প্রায় একইরকম শিরোনাম আমার আরেকটি লেখায় ব্যবহৃত হয়েছে। কেন আবার এই শিরোনাম, এই প্রশ্নের জবাবটা প্রথমে দিয়ে রাখছি। আমাদের চলমান ঘটনা আর খবরের ট্রেন্ডের দিকে তাকালে তা দৃশ্যত প্রায় একই রকম।

‘ক্রসফায়ারে’র ঘটনা দেখুন, প্রায় একই শিরোনাম আর কাছাকাছি বর্ণনা। দুর্ঘটনা, গুম, খুন সবই প্রায় কাছাকাছি। ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে শিরোনাম একই থেকে যায়। আবার একই খবরের মধ্যে ঘটনা থাকে অনেকগুলো, বাদ পড়ে যাওয়া ঘটনাগুলোর পুনঃশিরোনামও হয় কাছাকাছি।

‘প্রথম আলো’র সংবাদ শিরোনাম থেকেই এই লেখার শুরু এবং যথারীতি পুনরাবৃত্তি। কাগজটি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)কে উদ্ধৃত করে শিরোনামে বলেছে, ‘ঢাকার ৭১ শতাংশ মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগছে, ৬৮ শতাংশ মানুষ শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত’।

প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা অনুযায়ী ঢাকা শহরের মানুষদের আয়ের বৈষম্য ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। যার কারণেই বিষণ্ণতায় ভুগছেন ৭১ শতাংশ মানুষ। অর্থাৎ ঢাকা শহরের ২৯ ভাগ মানুষ মোটামুটি ভালো আছেন। মানসিক বিষণ্ণতার সাথে ৬৮ শতাংশ মানুষ শারীরিক সমস্যাতেও আক্রান্ত।

অর্থাৎ এই ঢাকার একশ জনে ৬৮ জন মানুষ শারীরিকভাবে অসুস্থ। গবেষণা আরও বলছে, ঢাকা শহরের ৩ শতাংশ মানুষ এখনো তিনবেলা খেতে পায় না। এই তিন শতাংশ সংখ্যায় কত? সামাজিক মাধ্যমে একজন জানালেন, অংকটা সাড়ে সাত লাখের।

অন্য অনেকেই বলেন, এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি। বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্তদের ক্ষেত্রে। যারা নিজেদের সামাজিক সম্মান রক্ষায় অহেতুক ভালো থাকার অভিনয় করে। এনাদের ধরলে সংখ্যাটার ক্রমবৃদ্ধিই স্বাভাবিক।

অবশ্য উন্নয়নশীল, মধ্যম আয়ের একটি দেশে এমন পরিসংখ্যান মেনে নেয়াটা সঙ্গত কিনা। মেগা প্রজেক্টের হুলুস্থুল প্রচারণায় এমন গবেষণা কতটা বাস্তব, এমনসব প্রশ্নও উঠতে শুরু করবে। কেউ কেউ এই গবেষণাকে ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করবেন। কেউ বলবেন, মূর্খতা।

তারপর বাহাসের আধিক্যে হারিয়ে যাবে গবেষণার এসব তথ্য। সেই অবসরে তিনবেলা খেতে না পাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। বৃদ্ধি পাবে মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ মানুষের পরিসংখ্যানও। কেন পাবে, তা বোঝা যাবে এবং যায় চ্যানেল আই অনলাইনের ‘৩ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা’, এমন শিরোনামে।

আর অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রকটটা বয়ান করে, ভূমি অফিসের একজন সামান্য কর্মচারীর স্ত্রী ব্যাংকে কোটি টাকাসহ বাড়ি ও শপিং মলের দোকান মালিক হবার খবরে।

জার্মান সংবাদ সংস্থা ‘ডয়চে ভেলে’র খবর অনুযায়ী দেশের অর্থনীতি মন্দাক্রান্ত হতে চলেছে। অর্থনীতির অবস্থা যে ভালো নেই, তা বিদেশি কোম্পানিগুলোর দেশ ছাড়তে চাওয়ার অভিযাত্রাতেই বোঝা গেছে। দৈনিক ইত্তেফাক জানাচ্ছে, ‘এবার বাংলাদেশ ছাড়তে চায় পসকো দাইয়ু’।

এমন খবরের শুরুটা পড়লেই বোঝা যায় মন্দার আশংকাটি একেবারে অমূলক নয়। ইত্তেফাকের ভাষায়, ‘অস্ট্রেলীয় কোম্পানি সন্তোষের পর এবার বাংলাদেশ ছাড়তে চায় কোরীয় কোম্পানি পসকো দাইয়ু। ৬ মাসেরও কম সময়ে মধ্যে দুই বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।’

খবরটির শুরুর শব্দচয়ন এবং ধাঁচ প্রমাণ করে এই চলে যাওয়া স্বাভাবিক বা সানন্দে নয়। অবশ্য ‘ডয়চে ভেলে’র শিরোনামই বুঝিয়ে দেয় এই চলে যাওয়া সঙ্গতই অস্বাভাবিক।

‘চাপের মুখে অর্থনীতি, মন্দার কবলে পড়ছে বাংলাদেশ?’- এমন শিরোনামের খবরটির প্রথমেই বলা হচ্ছে, ‘প্রবাসী আয় ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচকের নিম্নমুখী প্রবণতাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন অর্থনীতিবিদরা।

তাদের আশঙ্কা, এখনই সতর্ক না হলে মন্দার কবলে পড়তে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি৷’ আশংকার দিকটা আরও বাড়িয়েছে খবরের পরবর্তী অংশ।

বলা হচ্ছে, ‘বাংলাদেশে এখন রপ্তানি এবং আমদানি বাণিজ্যের সূচক নিম্নমুখী৷ বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। লেনদেনের ভারসাম্যও কমছে৷ কমছে বেসরকারি ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি৷ ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়া বাড়ছে।’

ব্যাংকগুলোর অবস্থা তো সবারই জানা। মূলধন সংকটের কথা বলতে গেলে ‘ওপেন সিক্রেট’। লাটে উঠা ফারমার্স ব্যাংক নাম বদলে শুধু হয়েছে ‘পদ্মা’ কিন্তু অবস্থার বদল হয়নি। এরমধ্যে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়া বাড়লে তো অবস্থা হবে, ‘হাতে হারিকেন’ সম!

হারিকেনের সাথে বাঁশের নিবির সম্পর্কের কথা অজানা নয়, সেই বাঁশটা যাবে কাদের তরে, সেটাও বুঝতে অসুবিধা হবার কারণ নেই। পরিশেষে জানটা যায় ‘উলুঘাগড়া’রই এটাই চিরন্তন। সুতরাং অর্থনীতিবিদদের আশংকাটাকে ঝেড়ে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

শারীরিক অবস্থা তো এমনিতেও ভালো থাকার কথা নয় ঢাকার মানুষের। সবচেয়ে দূষিত বাতাসে শ্বাস নেয় তারা। পরিসংখ্যান যদি ভুল না হয়, তবে এমন শহরে তাদের শ্বাস যে চলছে, সেটাই বা কম কিসে।

দৈনিক সমকাল স্বয়ং মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে উদ্ধৃত করে জানাচ্ছে, ‘কচু ছাড়া সব কিছুতেই ফরমালিন’, এমন কথা। সুতরাং দূষিত বায়ু আর ফরমালিনের মধ্যে সুস্থ থাকাটা, শ্বাস নেয়াটাই তো অনেক বড় অর্জন!

স্বাস্থ্যখাতের কথা তো বেশ কিছুদিন ধরেই মশহুর। সর্বশেষ খবরে দেখলাম, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারের ছয় লাখ টাকার বাতি কেনা হয়েছে ছিয়ানব্বই লাখ টাকায়! ‘হরিলুটের বাতাসা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বাস্থ্যখাত।

যে যেমন পাচ্ছে লুটে নিচ্ছে, বালিশ কেনা হচ্ছে সাত হাজারে, আশি হাজারে পর্দা! এমন অসুস্থ স্বাস্থ্যখাত দিয়ে মানুষকে সুস্থ করা বড় কঠিন কাজ।

যখন দেশে মারের ভয়ে মাথায় হেলমেট লাগিয়ে পেঁয়াজ বেচতে হয়, তখন বুঝতে হবে দেশটির মানুষেরা ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, সমাজ আক্রান্ত হচ্ছে ‘ক্যানিবালিজমে’। অথচ সেই ‘ক্যানিবালিজম’কে নিরুৎসাহিত না করে উল্টো উৎসাহিত করা হচ্ছে।

‘মব জাস্টিস’কে ‘জাস্টিফাই’ করার প্রক্রিয়া চলছে। এই যে, ‘ক্যানিবালিজম’, ‘মব জাস্টিস’ এবং ‘লিঞ্চ’ এটা মানসিক ভাবে অসুস্থদের দ্বারাই সম্ভব। বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘বিষণ্ণতা একটি রোগ’, হ্যাঁ বিষণ্ণতা মানসিক বৈকল্য।

আর মানসিক বৈকল্যজনিত কারণেই মানুষ প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে। সিস্টেমের উপর থেকে তাদের আস্থা উঠে যায়।

এমন মানুষেরা সুযোগ পেলেই ‘ক্রাউড’ থেকে ক্রমান্বয়ে ‘মবে’ পরিণত হয়। যার লক্ষণ ক্রমেই পরিস্ফুট হয়ে উঠছে। এটাকে থামাতে হবে। এখনো সময় হয়তো কিছুটা আছে। এ সময়ের সঠিক ব্যবহার করা না গেলে, ‘মবে’ সয়লাব হয়ে যাবে সব, ‘লিঞ্চিং’ যার সম্ভাব্য নিয়তি।

লেখক: কাকন রেজা, সাংবাদিক ও কলাম লেখক