বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পঠন-পাঠন

কোভিড-১৯, প্যানডেমিক, ট্রান্সমিশন, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, লকডাউন, কফ, কোল্ড, প্লিজ, অ্যাইক, ফিভার ও ডেথ ইত্যাদি ইংরেজি শব্দ দ্বারা বর্তমান পৃথিবীর অবস্থা বোঝা যায়। করোনা মহামারী মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কে ভিন্ন ধারা এনেছে, এসেছে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন। মানুষ বর্তমান ও ভবিষ্যতের ভাবনায় নতুন করে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখছে।

অস্থিতিশীল এ অবস্থা থেকে আমরা মুক্তি চাই শিগগির। এ অনিশ্চয়তায় তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেশি ভাবনার কারণ। বিশ্বে এ অবস্থায় স্বাস্থ্যঝুঁকি, বেকারত্ব বা কর্মহীন হয়ে পড়া, উৎপাদন ব্যবস্থা, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি, শিক্ষা ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাগুলো প্রধান। স্বাস্থ্যঝুঁকিকে বিশ্বে প্রথম এবং শিক্ষাকে চতুর্থ বা পঞ্চম সমস্যা হিসেবে ধরা হচ্ছে।

করোনায় সামগ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী, শিক্ষাগ্রহণে এখানে আপেক্ষিকতা রয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে সবকিছু শিখিয়ে দিতে পারবেন না, তবে তাকে শিক্ষাগ্রহণে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে পারবেন আর এটাই হল একজন মহান শিক্ষকের ভূমিকা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অপেক্ষা ব্যক্তিশিক্ষা অগ্রবর্তী। এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়- সপ্তাহে গড়ে পাঁচ দিনে ৬-৭ ঘণ্টা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত আর বাকি ১৭-১৮ ঘণ্টা ব্যক্তিকেন্দ্রিক।

অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ থাকলেও সেলফ স্টাডি বিদ্যমান থাকে। এটিও স্থান-কালভেদে আপেক্ষিক। তবে অনুপ্রেরণা, জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা দান, অনুশীলন, কার্যকরী শিক্ষা পদ্ধতি ও শিক্ষায় শৃঙ্খলা আনয়নের জন্য ক্লাস কার্যক্রমে সশরীরে উপস্থিতির বিকল্প নেই।

পৃথিবীতে শিক্ষাগ্রহণের নথিগত পাকা ও টেকসই পদ্ধতি হিসেবে পবিত্র পাঠ্যপুস্তক আল কোরআন, যা আল্লাহতায়ালার কাছে সংরক্ষিত আছে সেখান থেকে জ্ঞান ধীরে, পালাক্রমে ও মানুষের চাহিদা মোতাবেক জিবরাইল (আ.) সশরীরে উপস্থিত হয়ে নবী মোহাম্মদ (সা.)-কে শিখিয়ে দিয়েছেন ও প্রায়োগিকভাবে তা দেখিয়ে দিয়েছেন। এখানে জিবরাইল (আ.) আগে থেকেই আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, তবে তার নিজস্ব কোনো প্রয়োগক্ষমতা ছিল না; শুধু মাধ্যম হিসেবে যান্ত্রিকতার মতো আল্লাহর নির্দেশ পালন করতেন। শিক্ষাসংক্রান্ত আল্লাহর প্রথম নির্দেশ- ‘আল্লাহর নামে পড়ুন, মানবসৃষ্টির কৌশল নিজেকে জানুন, পড়ুন আর আপনার পালনকর্তা দয়ালু, যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলমের সাহায্যে যা মানুষ জানত না’।

জ্ঞানচর্চার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কৌশল এখানে পাওয়া যায়। নিজেকে জানতে হলে পড়া ও কলমের সাহায্য নেয়া, উচ্চ ধারার পুস্তক থেকে যেখানে জ্ঞান অর্জনের ব্যবহারিক অংশ অপরিহার্য। এখানে উচ্চ প্রযুক্তির শিক্ষায়, তা অনুসরণীয়। পড়াশোনার মূল লক্ষ্য নিজেকে জানা, আর এ তত্ত্বটি বহু আগে গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলে গিয়েছেন। তিনিও মনে হয় সৃষ্টিকর্তার আদেশ পালন করেছেন। কথিত আছে, বিশ্বের প্রথম প্রতিষ্ঠানের প্রধান যাজক তার গড়া শিক্ষা আশ্রমে শিক্ষার্থীদের আচরণে এক সময় হতাশ হলেন।

তিনি শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাস করতেন, কেন তারা এখানে পড়তে এসেছে। তাদের কারও জবাব ছিল চাকরি করব, কারও আয়-উপার্জনের জন্য, কারও কারও ছিল আনন্দ বা ফুর্তি করার জন্য, জীবন উপভোগ করার জন্য বা কারও বাজারমূল্যের জন্য ইত্যাদি। তিনি হতাশ হলেন এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, এ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেবেন। যে উদ্দেশ্যে তিনি এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তা পূরণ হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানে ঘুরে ঘুরে দেখছেন আর ব্যথিত মনে স্মৃতিচারণা করছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্ন।

ঘুরতে ঘুরতে এক সময় এক শিক্ষার্থীকে বিমর্ষ অবস্থায় বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে তোমার? শিক্ষার্থী ধীরে ধীরে উত্তর করল, আমি ভাবছি কেন আমি এখানে পড়াশোনা করতে এসেছি? পুনরায় ওস্তাদ জিজ্ঞেস করতে শিক্ষার্থী উত্তর দিল ‘নিজেকে জানা বা চেনার জন্য; এতেই আমার জীবনের সঠিকতা ও সার্থকতা খুঁজে পাব।’ সঠিক উত্তর পেয়ে প্রতিষ্ঠাতা সন্তুষ্ট হলেন এ ভেবে যে, একজন শিক্ষার্থী নিয়েই তিনি শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যাবেন। প্রাচীনকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, তখন জ্ঞান অন্বেষণকারীকে ওস্তাদের গৃহে অবস্থান করে বিদ্যা অর্জন করতে হতো। ওস্তাদ সন্তুষ্ট হলে জ্ঞান অন্বেষণকারীকে মাথায় হাত বুলিয়ে সম্মানিত করা হতো।

জীবন হতে হবে সার্থক, সফল নয়। অনাকাঙ্ক্ষিত বা বিশৃঙ্খলা পদ্ধতিতেও জীবনকে সফল করা যায়; কিন্তু সার্থক করা যায় না। সার্থক জীবনের জন্য দরকার উপযুক্ত শিক্ষা। নবী মোহাম্মদ (সা.) যখন দুর্গম হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন নীরবে-নিভৃতে, তখন সাধনার লক্ষ্য ও প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী আল্লাহর রহমতে জিবরাইল (আ.) জ্ঞানের ভাণ্ডার নিয়ে সশরীরে উপস্থিত হতেন । এটিকে ভার্চুয়াল বা অনলাইন শিক্ষাপদ্ধতির সুপার অ্যাডভান্সড প্রযুক্তি বলে মনে হবে। পৃথিবীতে হয়তো এমন এক সময় আসবে যে কোনো মুহূর্তেই যে কোনো স্থানে সশরীরে উপস্থিত হওয়া যাবে।

শিক্ষার যে কোনো পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য দরকার দৃঢ়সংকল্প ও শ্রমসাধনা। এখানে দৃঢ়সংকল্প বা শ্রমসাধনা বাস্তবায়নের জন্য দরকার পবিত্র একটি পরিবেশ। মনে রাখা ভালো, জীবনের কম সময়ের বিদ্যা অর্জনেই দীর্ঘ সময়ের সার্থকতার বীজ। বর্তমানে অনেক দেশ করোনা সংক্রমণের প্রথম থেকেই অনলাইনে উচ্চতর শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। আবার বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে হার্ভার্ড, ক্যালিফোর্নিয়া, ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড, বন, সিডনিসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। সেসব দেশে অনলাইন অফিস কার্যক্রমও চালু আছে আগে থেকেই।

এ কথা শাশ্বত যে, শাসন ব্যবস্থার চরিত্রই নির্দিষ্টভাবে শিক্ষার চরিত্র নিরূপণ করে এবং এ চরিত্র অনুযায়ী ভবিষ্যতের যাত্রা শুরু হয়। গণতান্ত্রিক শাসনচরিত্র, গণতান্ত্রিক শিক্ষাচরিত্র, ধনতান্ত্রিক শাসনচরিত্র, ধনতান্ত্রিক শিক্ষাচরিত্র দেয়। সর্বোত্তম শাসনচরিত্র দক্ষ, কার্যকরী ও টেকসই শিক্ষাচরিত্র অভ্যাস আকারে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে করোনা মিশ্রিত শাসনচরিত্রে ক্ষণস্থায়ী শিক্ষাচরিত্রে কোন ধরনের পুনর্জাগরণ ঘটাবে, তা দেখভালের আবশ্যকতা আছে। এ শিক্ষাচরিত্রের এদিক থেকে সেদিক ও অস্থায়ী থেকে স্থায়ীরূপ শিক্ষার মূল লক্ষ্যকে ব্যাহত করতে পারে।

শিক্ষার মাধ্যমে আমরা নিজেকে চিনতে পারি আর সেখানেই আনন্দ, সৌন্দর্য এবং দক্ষতাও লাভ হয়। আর শক্তি, সৌন্দর্য ও কৌলীন্য শুধু জিনগত বা স্বীয় চেষ্টায় অর্জিত নহে। আর রাষ্ট্রীয় শিক্ষাচেইনে শিক্ষা প্রদান জাতীয়ভাবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব-কর্তব্য। এটি নাগরিকের বিশেষ সুবিধা প্রদান নয়, যা নাগরিকদের দুর্বল করতে পারে। দেশের উন্নয়ন গতিকে বেগবান ও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে শিক্ষার মানোন্নয়ন ও ধারাবাহিকতা আবশ্যক।

এ ধারাবাহিকতায় নবীন শিক্ষার্থীদের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে ও অর্জিত জ্ঞান অপেক্ষা বেশি অবদান রাখতে তাদের দেহ, মন, বুদ্ধি ও আত্মপ্রকাশের সক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়ার কর্তব্য রাষ্ট্রের। পড়াশোনাকে ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে কিছু বইকে চেটে দেখতে হয়, কিছু বইকে গিলে ফেলতে হয় আবার কিছু বইকে চিবিয়ে হজম করতে হয়। বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি অনলাইনে ক্লাসের সিদ্ধান্তকে হাস্যকর ও অপরিপক্ব বলেছেন।

আর এ নতুন ব্যবস্থায় বাস্তবিক পক্ষে শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে ক্লাসে এবং হল তত্ত্বাবধানে উপস্থিত থাকতে হবে না; এখানেই গভীর উদ্বেগের বিষয়। বিদেশি শিক্ষার্থীদের বেলায় ইমিগ্রেশন আর অন্যদের বেলায় নানা অন্তরায়। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে বেশি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কারণ, তারা ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের যাবতীয় কোর্স অনলাইনে নেয়ার সিদ্ধান্তের দিনই শিক্ষার্থীদের দেশত্যাগের সরকারি আদেশ জারি হয়। তাছাড়া ভবিষ্যতে এ ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বা থাকার আবশ্যকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এ ক্ষেত্রে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট সবার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা।

শিক্ষার্থীরা পাঠটি বুঝল কি না, পাঠদান পছন্দ হল কি না, ক্লাস ও ক্লাসের বাইরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিজেদের আন্তঃক্রিয়ার অভাব, প্রশ্ন ও যথোপযুক্ত রেসপন্সের অভাব, শিক্ষকের উপস্থাপন ভঙ্গি ইত্যাদি সমস্যাগুলো মুখ্য থাকায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের অতৃপ্তি ও অসম্পূর্ণতা কাজ করবে। আর ইন্টারনেট কানেকটিভিটি একটি বড় শর্ত। এ ছাড়াও বেশিরভাগ শিক্ষার্থী অনলাইনে ছোট্ট একটি ডিভাইস স্মার্টফোনে দীর্ঘক্ষণ চোখ লাগিয়ে থাকার কারণে একঘেয়েমি ও বৈচিত্র্যহীনতাসহ চোখ-মাথা ধরা সমস্যায় ভোগবে, যা পরবর্তী সময়েও নতুন করে সামাজিক দুঃখ বয়ে আনতে পারে।

শুধু বর্তমান সমস্যার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালুর প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা যেত। লেখায় এ বিষয়ে প্রশ্ন বা সম্ভাব্য উত্তর থাকা বাঞ্ছনীয়। বিষয়টি নিয়ে অনেকে মানসম্মত লেখছেন এবং লেখবেন। সমাধানও আসবে। আর এ বিষয় নিয়ে কম-বেশি সব বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করছে স্বাধীনভাবে। বাজারে ইন্টারনেট কানেকটিভিটির গুরুত্ব বাড়ছে। ভার্চুয়াল ক্লাসরুম হিসেবে অনেক সফটওয়্যার চালু আছে, যেমন: জুম, সিসকো ওয়েবেক্স মিটিং, স্কুলোজি ও লার্নকিউব অ্যাপ ইত্যাদি।

বাণিজ্যিকভাবে সহজে অনেকেই বলতে পারে, ‘দ্রত চালু করা হোক অনলাইন শিক্ষা’। এ মর্মে দুকূল রক্ষার্থে যেমন করোনা ভ্যাকসিন বা মেডিসিন আসছে ও আসবে, যা কিছু চিকিৎসায় পজিটিভ বা নেগেটিভ, তেমনি খণ্ডিতাকারে অনলাইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রযুক্তি পঠন-পাঠন চলতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্যানডেমিক-মহামারী রোগ (উদাহরণ, করোনা) এবং এর সমাজ ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বিষয়ে শিগগির পাঠ্যক্রমভুক্ত করে নেয়া ভালো।

ড. মো. মামুনুর রশীদ: প্রফেসর, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর

 

সুত্রঃ যুগান্তর