বিশ্ববাজারে দাম কমলেও সুবিধা নেই ভোক্তাদের

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম কমলেও এর সুবিধা পাচ্ছেন না ভোক্তারা। উল্টো একের পর এক দাম বাড়িয়ে চলেছে একশ্রেণীর অসাধু চক্র।

বিশেষ করে রমজান এলেই নানা অজুহাতে কৃত্রিমভাবে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় চক্রটি। এবারও বিরাজ করছে একই চিত্র। যদিও ব্যবসায়ীদের দাবি, বর্তমানে ডলারের উচ্চমূল্য, আমদানিকৃত পণ্য খালাসে বিলম্ব, সরবরাহ ব্যবস্থায় নানা প্রতিবন্ধকতাসহ রমজানের আগে নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা বেড়েছে। এতেই নাভিশ্বাস উঠেছে ভোক্তাদের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক বছরে ডলারের দাম বেড়েছে ১ টাকা ১৩ পয়সা। কিন্তু আমদানিনির্ভর ভোগ্যপণ্যের দাম কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক মাসে কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

এটা বাস্তব কোনো কারণ নয়, শুধু ডলারের দামের কারণে পণ্যের দাম বাড়েনি; মূলত রমজানে অতিমুনাফার প্রবণতা থেকে ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক এই দাম বাড়িয়েছে একটি চক্র।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গতকাল ৩০ এপ্রিল প্রতি ডলারের এলসি মূল্য ছিল ৮৪ টাকা ৪৮ পয়সা। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮৩ টাকা ৩৫ পয়সা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে প্রতি ডলারের দাম বেড়েছে ১ টাকা ১৩ পয়সা।

কিন্তু বাজারের বাস্তবচিত্র ভিন্ন। বর্তমানে ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা দরে। যা এক মাস আগে ছিল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি ছোলার দাম বেড়েছে ১০ টাকা। একইভাবে মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০০ টাকা। যা এক মাস আগে ছিল ৮৫ থেকে ৯৫ টাকা। সে হিসাবে মাসে বেড়েছে ১০ টাকা।

পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ২৮ টাকা দরে, যা এক মাস আগে ছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা। তবে ভোজ্যতেল ও খেজুর আগের চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ ভোজ্যতেল ১০০ থেকে ১০৫ টাকা এবং প্রতি কেজি সাধারণ মানের খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। পৃথিবীর কোনো দেশে ধর্মীয় উৎসবে পণ্যের দাম বাড়ায় না। শুধু বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে। এখানে সরকারের ব্যর্থতার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও দোষ আছে। তারা লাভ করুক, কিন্তু এত লাভ করলে গ্রাহক কোথায় যাবে?

ব্যবসায়ীর ব্যবসা করা যেমন অধিকার, তেমনি ভোক্তাদের সীমার মধ্যে কেনাকাটা করে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। সব পক্ষকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এভাবে একচেটিয়া মুনাফা করলে ভোক্তার কষ্ট হয়। কারা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মুনাফা করছে, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীদেরও নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। পণ্য সরবরাহে যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্ছিদ্র হওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের আন্তর্জাতিক বাজার দরের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ এপ্রিল বিশ্ববাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের মূল্য ছিল প্রায় ৭১৩ ডলার। যা এক বছর আগে ছিল ৭৮৯ ডলার।

সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের মূল্য কমেছে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। একইভাবে অপরিশোধিত পাম অয়েল ৭ দশমিক ৪১ শতাংশ দাম কমে ৫৯২ ডলারে নেমে এসেছে। বিশ্ববাজারে মসুর ডালের মূল্য কমেছে ৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ। বর্তমানে বিশ্ববাজারে প্রতি টন মসুর ডালের মূল্য ৫৩০ ডলার। যা এক বছর আগে ছিল ৫৭৫ ডলার।

এ প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, ডলারের দাম বাড়ার কারণে কিছুটা প্রভাব পড়েছে।

এছাড়া বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে দেশের ব্যবসায়ীরা দাম কমায় না। মূলত এসব পণ্যে প্রতিযোগিতার বাজার সৃষ্টি করা যায়নি। কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপ ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। ভোক্তারা কম দামে পণ্য পেতে হলে বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে হবে। তিনি বলেন, প্রতিযোগিতা কমিশনের তৎপরতা খুব বেশি চোখে পড়ে না। তাদের তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে।

ক্যাবের সভাপতি আরও বলেন, একজন ব্যবসায়ী আজকে যে পণ্য বাজারে তুলেছেন সেটা ৪-৫ মাস আগে এলসি খুলেছেন। সেই হিসেবে তার পণ্যের দাম আজকের আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের কোনো সুযোগ নেই। এটা একটি অসাধুতা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চিনি এবং খেজুরের আমদানি এবার কম হয়েছে। উভয় পণ্য গত রোজার আগে এসেছিল ১৭ লাখ ৪৩ হাজার ১৮১ টন। এবার এসেছে ১২ লাখ ৬ হাজার ৭৬১ টন। অর্থাৎ গত রোজার তুলনায় এবার পণ্য দুটি ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৪২০ টন কম আমদানি করা হয়েছে।

তবে অন্য চার পণ্য ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, ছোলা ও মসুর ডাল চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট মজুদ রয়েছে বলে জানা গেছে। তবুও পণ্যগুলোর দাম বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি কমের কারণ দেখিয়ে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী পণ্য দুটির দাম প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আসা উচিত। এক্ষেত্রে মনিটরিং আরও জোরদার করতে হবে।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট হেলাল উদ্দিন বলেন, চিনি পর্যাপ্ত আছে। সংকট হবে না। খেজুর নিয়ে আসতে সময় বেশি লাগে না। প্রয়োজনে যে কোনো সময় দ্রুত নিয়ে আসা যাবে।

দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, এবারের রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে না। কেউ ইচ্ছা করে বাড়ালে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে ভোক্তাকেও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

খাতুনগঞ্জের শাহ আমানত ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. মহিউদ্দিন জানান, বাজারে রোজার পণ্যগুলোর কোনো সংকট নেই। মাঝে মধ্যে ডলারেরও মূল্য বৃদ্ধি হলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ে। তখন ব্যবসায়ীরা সেই দরের সঙ্গে সমন্বয় করেন। এতে জিনিসপত্রের দাম সাময়িকভাবে বেড়ে যায়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার যুগান্তরকে বলেন, রমজানের আগে বা পরে নিত্যপণ্যের দাম যাতে সহনীয় থাকে সেজন্য বাজারে অধিদফতরের একাধিক টিম কাজ করছে। মোকাম, পাইকারি পর্যায় ও খুচরা পর্যায়ে শনিবার ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করা শুরু হয়েছে।

দাম বাড়ানোর পেছনে কোনো ধরনের অনৈতিক কারণ থাকলে দোষীদের চিহ্নিত করে ভোক্তা আইনে শাস্তির আওতায় আনা হবে।

তিনি আরও বলেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বর্তমানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এখন ডলারের মূল্য বাড়লেও ব্যবসায়ীরা এখন যে পণ্য আমদানি করার জন্য এলসি খুলবে তা দেশে আসতে আসতে রমজান পার হয়ে যাবে। অর্থাৎ রমজানে যেসব পণ্য বাজারে থাকবে, সেগুলোর এলসি করা হয়েছে অনেক আগেই।

দাম বাড়ানোর কোনো কারণ নেই। আর অসাধুরা ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে পণ্যের দাম যাতে না বাড়াতে পারে সেদিকে নজর রাখা হবে।

মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মওলা বলেন, পাইকারি পর্যায়ে কোনো পণ্যের দাম বাড়েনি। কিছুটা বাড়লে খুচরা বাজারে বাড়তে পারে। সেক্ষেত্রে খুচরা মূল্য ও পাইকারি মূল্য দৃশ্যমান জায়গায় টানিয়ে রাখলে বোঝা যাবে।

তিনি আরও বলেন, পণ্যের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে পণ্য সরবরাহ বিলম্বও একটি কারণ। এগুলো নিরসনে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।