বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম তলানিতে, সুফল নেই দেশে

করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাবে বিশ্ববাজারে গত টানা তিন মাসে খাদ্যপণ্যের দাম তলানিতে ঠেকেছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। তবে সে অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে এর প্রভাব তো পড়েইনি বরং অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে ভোগ্যপণ্যের বাজার দুষ্টচক্রের কবলে পড়েছে। ভোক্তাদের জিম্মি করে এসব দুষ্ট ব্যবসায়ী নানা ধরনের সুবিধা নিচ্ছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দুর্বলতার সুযোগে বাজারে এই চক্রের আধিপত্য চলছেই, তারা বিভিন্ন সময়ে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে ফায়দা লুটছে। তাই বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম কমার পরও এর সুফল পাচ্ছে না দেশের সাধারণ ভোক্তা।

গত এপ্রিলে এফএওর খাদ্যপণ্যের গড় মূল্যসূচক দাঁড়িয়েছে ১৬৫ দশমিক ৫ পয়েন্টে। মার্চের তুলনায় যা ৩ দশমিক ৪ শতাংশ কম। এ নিয়ে টানা তিন মাস এফএওর ফুড প্রাইস ইনডেক্সে নিুমুখী প্রবণতা বজায় রয়েছে। বৈশ্বিক এ মূল্যসূচকে টানা মন্দাভাবের পেছনে মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে বিশ্বজুড়ে নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ। গত মাসে ভোজ্যতেল ও চিনির বাজারে সবচেয়ে বড় দরপতন দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া একই সময়ে অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দামেও মন্দাভাব বজায় ছিল। তিন মাস ধরে চাল বাদে অন্য সব খাদ্যশস্যের রফতানিমূল্য কমতির দিকে রয়েছে।

এফএওর প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, গত মাসে বড় ধরনের পতন দেখা দিয়েছে ভোজ্যতেলের বাজারে। এপ্রিলে পণ্যটির বৈশ্বিক মূল্যসূচক ৫ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে।

এ সময় সবচেয়ে বেশি দরপতনের মুখে পড়েছে চিনির বাজার। এপ্রিলে পণ্যটির বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। যা সূচকটির গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিু অবস্থান।

পণ্যটির বৈশ্বিক চাহিদায় দীর্ঘদিন মন্দা চলছে, এর ওপর নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপে তা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দামে খাড়া পতন এ ক্ষেত্রে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

কারণ, জ্বালানি তেলের দাম কমলে ইথানলের দামও কমে যায়। ফলে আখ থেকে ইথানল তৈরির পরিবর্তে চিনি উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এতে বাজারে পণ্যটির সরবরাহ বেড়ে গিয়ে দাম কমিয়ে আনে। একই পরিস্থিতি বিদ্যমান দুগ্ধপণ্যের বাজারেও। এপ্রিলে পণ্যটির বৈশ্বিক মূল্যসূচক ৩ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও জ্বালানিবহির্ভূত উভয় পণ্যের দাম কম থাকাকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সুখবর বলে মনে করছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ভোগ্যপণ্যের নিট আমদানিকারক দেশ। এখানে জিনিসপত্রের দাম অনেকটাই আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর করে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বিশেষত জ্বালানি তেলের মূল্য কম থাকলে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে তা সহায়ক হবে।

দেশের বাজারে পণ্যের দাম কমছে না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বাজার ব্যবস্থায় ভুল আছে-এগুলো শুধরে নিলেই বাজার স্বাভাবিক গতিতে চলবে। আমদানিকারকদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণেই নিত্যপণ্যের দাম কমছে না বলে মনে করে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আমদানিকারকরা সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে সবসময় দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে রাখেন। এসব অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারণেই বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম কমলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়ছে না। দাম কমানোর বিষয়ে সরকারেরও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে বাজারে অসাধু সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ী বা সিন্ডিকেট রোধে প্রতিযোগিতামূলক আইন যথাযথভাবে প্রয়োগের পাশাপাশি বাস্তবতার ভিত্তিতে টিসিবিকে কার্যকর করা, গণপরিবহন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো ও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দেশীয় বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে আনা এবং দ্রব্যমূল্য জনগণের হাতের নাগালে রাখতে জাতীয় মূল্য কমিশন দ্রুত কার্যকর করতে হবে।

 

সুত্রঃ যুগান্তর