বিনা দোষে হত্যা করা হয়েছিল এক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে

‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে, বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা, তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না।’ ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসটি ছিল মুক্তিযুদ্ধকে একটি চূড়ান্ত রূপদানের মাস।

এ মাসে মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টির কারিগর ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দার তার তৈরি ক্র্যাক প্লাটুন দিয়ে রাজধানী শহরকে কাঁপিয়ে তোলেন এবং মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। এ বীর সেনানীকে নিয়েই এ লেখা।

আমাদের সেনাবাহিনী তথা দেশের গর্ব ও অহংকার ক্যাপ্টেন হায়দার। ক্যাপ্টেন র‌্যাঙ্কের এ অফিসার স্বাধীনতাযুদ্ধে এক অনন্যসাধারণ ইতিহাস সৃষ্টি করে কিংবদন্তি হয়ে আছেন। হায়দার নামের অর্থ ‘সিংহ’। হ্যাঁ, সিংহের মতোই তেজস্বী ও নির্ভীক বীর যোদ্ধা ছিলেন হায়দার। নামের অর্থের পরিপূর্ণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল।

স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক, ভয়ংকর ও তেজস্বী সিংহের মতো যমদূত। হায়দারের নাম শুনে হৃদয় প্রকম্পিত হতো হানাদার বাহিনীর। ৩৫ হাজারেরও বেশি ছাত্র-যুবক ও তরুণকে প্রশিক্ষিত করে গেরিলা যোদ্ধায় পরিণত করেছিলেন তিনি। বৃহত্তর ঢাকা শত্রুমুক্ত হয় তার পরিচালিত বাহিনীর দ্বারা। এ যেন রূপকথার গল্পকেও হার মানায়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যন্ত দুর্ধর্ষ, দুঃসাহসী, নির্ভীক, অকুতোভয়, সর্বোচ্চ পেশাগত মানের চৌকশ কমান্ডো সেনাদল ‘দ্য স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপে’র (এসএসজি) অন্তর্ভুক্ত হওয়া খুব চাট্টিখানি কথা নয়! তাও আবার বাঙালি অফিসারের জন্য, যাদের সঙ্গে পাকিস্তানিরা বিমাতাসুলভ আচরণে অভ্যস্ত ছিল। এ সেনাদলে সুযোগ পাওয়ার জন্য অত্যন্ত কঠিন বেশ কিছু পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার পর সূক্ষ্ম যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া অতিক্রম করতে হয়।

এ কঠিন বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে এসএসজি-তে নির্বাচিত হন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যন্ত মেধাবী ও চৌকশ এক বাঙালি অফিসার। নাম তার ক্যাপ্টেন আবু তাহের মুহাম্মদ হায়দার। সংক্ষেপে এটিএম হায়দার। খালেদ মোশাররফ যুদ্ধে মারাত্মক আহত হওয়ার পর তিনি ২ নম্বর সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার হিসাবে (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৪২ সালের ১২ জানুয়ারি কলকাতার ভবানীপুরে জন্মগ্রহণ করেন এটিএম হায়দার। তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের কান্দাইল গ্রামে। বাবা মোহাম্মদ ইসরাইল ব্রিটিশ-ভারত ও পাকিস্তান পুলিশ বিভাগের অত্যন্ত সৎ ও আদর্শবান একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন। যে কারণে তাকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। মা হাকিমুন নেসা ছিলেন গৃহিণী। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে হায়দার ছিলেন দ্বিতীয়।

প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন পাবনা জেলার বীণাপানি স্কুলে। পরে ১৯৫৮ সালে কিশোরগঞ্জ রামানন্দ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৬১ সালে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৬৩ সালে লাহোর ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করেন। পরে লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পরিসংখ্যানে ভর্তি হন। হায়দারের দৈহিক গঠন ছিল অত্যন্ত সুঠাম ও শক্তিশালী। তিনি সুদক্ষ খেলোয়াড় হিসাবে এক নামে পরিচিত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সুইমিংয়ে ছিলেন চ্যাম্পিয়ন।

মাস্টার্স শেষ করে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ৪র্থ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি ওয়ার কোর্সে যোগদানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতকার্য হন এবং ১৯৬৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুলে যোগদান করেন। ছয় মাস প্রশিক্ষণ শেষে একই বছরের ৬ আগস্ট সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসাবে গোলন্দাজ বাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। তার বদলি হয় মুলতান সাঁজোয়া ডিভিশনের সেল্ফড প্রপেল্ড আর্টিলারি ইউনিটে। এ ডিভিশনটি পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী স্ট্রাইকিং বা পাঞ্চিং ডিভিশন হিসাবে পরিচিত, যা আমেরিকার সেনাবাহিনীর অনুকরণে গড়ে তোলা।

১৯৬৯ সালে তিনি চেরাটে ঝঝে (Special Service Group) ট্রেনিংয়ে অংশ নেন ও কৃতিত্বের সঙ্গে সবচেয়ে কঠিন গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষ করেন। উল্লেখ্য, ৩৬০ জন কমান্ডোর মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র দুজন। কৃতিত্ব ও দক্ষতার সঙ্গে বিশেষ কমান্ডো প্রশিক্ষণ শেষ করার পর তাকে দুটি পদে বদলি অফার দেওয়া হয়- ১. চেরাটে কমান্ডো প্রশিক্ষক, ২. কুমিল্লা তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে যোগদান। তিনি মাতৃভূমির টানে কুমিল্লা সেনানিবাসে বদলি হওয়াটাই বেছে নেন। ১৯৭০ সালের শেষের দিকে হায়দারকে কুমিল্লা সেনানিবাসে তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে বদলি করা হয় এবং তিনি ১৯৭১ সালের প্রথমদিকে যোগদান করেন।

ক্যাপ্টেন হায়দারের মতো কমান্ডোকে মুক্ত রাখা বিপজ্জনক হতে পারে ভেবে মার্চ মাসের শুরুর দিকে ঢাকা সেনানিবাসে পাঠিয়ে তাঁবুর মধ্যে কয়েকজন বাঙালি অফিসারের সঙ্গে তাকেও অন্তরীণ রাখা হয়। তিনি বাঙালিদের প্রতি এহেন আচরণে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এক সিনিয়র অফিসারের কাছে বেতনের জন্য কথা বললে মার্চ মাসের ২১/২২ তারিখে আবারও কুমিল্লা সেনানিবাসে তার নিজস্ব ইউনিট তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে পাঠানো হয়।

ইউনিটে ফিরে এসে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রমূলক কথাবার্তা তার সন্দেহের উদ্রেক ঘটায়। তিনি বুঝতে পারেন, তারা সাংঘাতিক ভয়ংকর কিছু একটা করার পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে এবং বাঙালিদের যে কোনো মুহূর্তে হত্যা করা হতে পারে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় এটা টের পেয়েই তিনি অফিসার মেসে তার রুমে এসে তার পিস্তলটি নিয়ে বাথরুমের জানালা ভেঙে বের হয়ে আসেন। অন্ধকারে ক্রলিং করে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সেনানিবাসের বাইরে চলে আসেন। তার কমান্ডো ট্রেনিং এক্ষেত্রে খুব কাজে লেগেছিল। পালাতে ১/২ মিনিট বিলম্ব করলেই তার ললাটে শহিদ হওয়া ছিল নিশ্চিত।

কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে হানাদারদের কবল থেকে পালিয়ে এসে ক্রমাগত হাঁটতে শুরু করলেন ক্যাপ্টেন হায়দার। একটিমাত্র পিস্তল তার সঙ্গী। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪ ইস্ট বেঙ্গলের অবস্থান সম্পর্কে। দীর্ঘ ৬০ মাইল হেঁটে পৌঁছে গেলেন সেখানে। দেখা হলো ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি হায়দারকে পাঠিয়ে দিলেন ৪ ইস্ট বেঙ্গলের সদর দপ্তর তেলিয়াপাড়ায় মেজর খালেদ মোশাররফের কাছে। এসএসজি প্রশিক্ষিত ক্যাপ্টেন হায়দারকে পেয়ে ভীষণ আবেগাপ্লুত হয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন খালেদ মোশাররফ। রতনে রতন চিনে ফেললেন। এ রকমই একজন সুপ্রশিক্ষিত ক্যাপ্টেন হায়দারের প্রয়োজন ছিল তার।

পাকিস্তান সরকার রাত-দিন মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী বলে প্রচার করে যাচ্ছে, বহির্বিশ্ব যাতে কোনোভাবেই বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম টের না পায়। ঢাকা ছিল বাড়তি নিরাপত্তা বেষ্টনিতে আবদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে ২নং সেক্টর কমান্ডার এবং ‘কে’ ফোর্সের প্রধান মেজর খালেদ মোশাররফ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করলেন। পাক সরকারের মিথ্যাচারের জবাব ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে জানান দেওয়ার উদ্দেশ্যে রাজধানী ঢাকায় গেরিলা অপারেশন করার জন্য তার নির্দেশে ক্যাপ্টেন হায়দার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, দুঃসাহসী ও মেধাবী ১৭ জন তরুণকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুললেন এক দুর্ধর্ষ গেরিলা দল।

এদের কাজ ছিল গ্রেনেড ছোড়া থেকে শুরু করে ঝটিকা আক্রমণ, অতর্কিত ত্রাস সৃষ্টি করা এবং ‘হিট অ্যান্ড রান’। মোট কথা আরবান গেরিলা যুদ্ধের সব ধরনের কৌশলই এদের রপ্ত করান হয়। এ দলকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের আশপাশে একটি গেরিলা অপারেশন ‘হিট অ্যান্ড রান’ পরিচালনা করার জন্য প্রথমবারের মতো ঢাকা পাঠানো হয়। কিন্তু ঢাকার অশান্ত পরিস্থিতি তুলে ধরতে তারা যেভাবে লক্ষ্যবস্তুর কেন্দ্রে হামলা করে বসে, তাতে তোলপাড় ওঠে চারদিকে।

দুর্ধর্ষ অপারেশনটির কথা শুনে নড়েচড়ে ওঠে যুদ্ধের সব পক্ষ ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। অপারেশন শেষে আলম-মায়া-জিয়ারা যখন ক্যাম্পে ফেরেন, তখন প্রশিক্ষণদাতা এটিএম হায়দারকে উদ্দেশ করে খালেদ মোশাররফ বলে ওঠেন, ‘লুক হায়দার, এদের বললাম টার্গেটের আশপাশে গ্রেনেড মারার জন্য। এরা তো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ফুটায়ে দিয়েছে। They all are Crack People. Bravo! Bravo!’ সেই থেকে ঢাকার গেরিলা অপারেশনে যাওয়া যোদ্ধাদের পরিচিতি হয়ে গেল ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ নামে।

বিজয়ের দিন, ১৬ ডিসেম্বর সেক্টর ২-এর ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার হিসাবে ঢাকার আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, মিত্রবাহিনী ইস্টার্ন কমান্ডার লে. জেনারেল অরোরাকে অভ্যর্থনা জানানো, পাকিস্তানি বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডার লে. জেনারেল নিয়াজি ও তার সঙ্গীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান আয়োজন ও নানাবিধ জটিল ও কঠিন দায়িত্বগুলো অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন মেজর হায়দার।

স্বাধীনতার পর ভারতীয় বাহিনী রেডিও স্টেশন দখল করার আগেই ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৮টা ১০ মিনিটে মুক্ত বাংলাদেশে প্রথম রেডিও চালু হয় হায়দারের নেতৃত্বে। মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরী ঘোষণা করলেন যে, এখন জাতির উদ্দেশে কিছু বলবেন সেক্টর ২-এর কমান্ডার ইনচার্জ মেজর আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দার। সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে মেজর হায়দার তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শুরু করলেন, ‘আমি মেজর হায়দার বলছি। প্রিয় দেশবাসী, আমাদের প্রিয় দেশকে মুক্ত করা হয়েছে।

আমাদের দেশ এখন মুক্ত। আপনারা সবাই এখন মুক্ত বাংলাদেশের নাগরিক।…’ তারপর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বললেন, ‘সব গেরিলার প্রতি আমার নির্দেশ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। কোথাও যেন আইন ও শৃঙ্খলা বিনষ্ট না হয়। লুটপাট বন্ধ করতে হবে। এলাকায় এলাকায় পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। যত দিন পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার দেশে ফিরে দায়িত্ব না নেবেন, ততদিন পর্যন্ত গেরিলাদের যার যার এলাকায় আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। জনগণের প্রতি আমার আবেদন, আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করুন। আলবদর, আলশামস, রাজাকার ও দালালদের ধরিয়ে দিন। নিজ হাতে আইন তুলে নেবেন না।’

স্বাধীনতা যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এটিএম হায়দার ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন। ১৯৭২ সালে মেজর থাকাবস্থায় কুমিল্লা সেনানিবাসে ইস্ট বেঙ্গলের ১৩তম ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠার গুরুদায়িত্ব তাকে দেওয়া হয় এবং অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে তিনি তা গড়ে তোলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি লেফটেনেন্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের অভ্যুত্থান-পালটা অভ্যুত্থানের সময় তিনি এ ইউনিটেই পার্বত্য চট্টগ্রামের রুমা গ্যারিসনে ছিলেন।

নারায়ণগঞ্জে পারিবারিক একটি জমির সমস্যা সমাধানের জন্য পহেলা নভেম্বর তার বাবা হায়দারকে জরুরিভাবে ঢাকায় আসার জন্য ‘Family problem, come sharp’ লিখে টেলিগ্রাম পাঠান। এ টেলিগ্রামই হায়দারের যমদূত হিসাবে কাজ করে। ৩ তারিখে তা পেয়ে তিনি তৎকালীন ব্রিগেড ও স্টেশন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আতিকুর রহমানের (পরবর্তীকালে সেনাপ্রধান) নিকট ছুটির আবেদন করেন। স্টেশন কমান্ডার তাকে খারাপ পরিস্থিতি ও সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকার কারণে ছুটিতে যেতে বারণ করেন। কিন্তু পিতৃভক্ত হায়দার ছুটি না পেলে চাকরি ছেড়ে দিবেন বললে তাকে ছুটি মঞ্জুর করা হয়।

বাবার ডাকে প্লেন, ট্রেন বা বাসের টিকিট না পেয়ে মোটরসাইকেলে করেই এ দীর্ঘ বিপদসংকুল পথে রওয়ানা দেন। ৪ নভেম্বর রাত ৯টায় তিনি মতিঝিলে বোনের বাসায় পৌঁছেন। ৬ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত পারিবারিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ৬ নভেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে তিনি তার প্রিয় সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা সেনানিবাসে যান। অতঃপর খালেদ মোশাররফের সঙ্গেই ৭ নভেম্বর নির্মমভাবে নিহত হন। এ অভ্যুত্থান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, বিতর্ক ও খালেদ মোশাররফের ভূমিকা নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, মত-দ্বিমত থাকলেও অভ্যুত্থানে এটিএম হায়দারের কোনো ভূমিকা ছিল না।

হায়দার কোনো কিছুতে অংশগ্রহণ না করেও তাকে এই চরম অবস্থার শিকার হতে হয়। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যার কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি। যে রাষ্ট্র অর্জনের জন্য তিনি প্রবল বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন ও তৈরি করেছিলেন অসংখ্য দুঃসাহসী গেরিলা যোদ্ধা, সেই স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রেই কতিপয় বিপথগামী সৈনিক হত্যা করে এ অকুতোভয় বীর সেনানীকে এবং কলঙ্কিত করে আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতাকে।

কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অব.) : সামরিক ইতিহাস বিশারদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

 

সূত্রঃ যুগান্তর