বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্র আছে, প্রয়োজন সুযোগ সৃষ্টি

অর্থনীতিতে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই সরকারকে বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতেই হয়। এর মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ একটি দেশের জন্য নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগের সঙ্গে দেশি বিনিয়োগের যে যোগসূত্র রয়েছে, সেদিকে আমরা খুব কমই নজর দিই। সব মিলিয়ে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। তাই দেশি-বিদেশি উভয় ক্ষেত্রেই বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট তথা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) নিয়ে আমাদের আরো ভাবা দরকার। বিনিয়োগের বাধা দূর করতে আমাদের উদ্যোগগুলো কতটুকু কার্যকর হলো, আদৌ কার্যকর হয়েছে কি না তার মূল্যায়ন করতে হবে।

একটি দেশের জন্য সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ খুব প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। এর আগে আমরা দেখেছি, জিডিপির তুলনায় বিনিয়োগের হার যথেষ্ট নয়। আমরা যদি ৭ থেকে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চাই, তাহলে বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির ৩০-৩২ শতাংশ ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

কভিডের কারণে আমাদের অর্থনীতিতে নতুন করে কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। রাজস্ব আদায় প্রায় কমে গেছে। জনগণের ওপর করের চাপও দেওয়া যাবে না। তাই বিদেশি বিনিয়োগের ওপর মনোযোগ বাড়াতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের কাছাকাছি দেশ হিসেবে ভিয়েতনামের উদাহরণ দেওয়া যায়। তাদের বৈদেশিক বিনিয়োগ ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর আমাদের দুই বিলিয়ন ডলারের নিচে। এটা মোটেও সন্তোষজনক নয়। এ ছাড়া থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, এমনকি ভারতেও ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট অনেক বেশি। তাদের ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্টও অনেক বেশি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতেই হবে।

এফডিআই আকর্ষণে আমি প্রথমেই জোর দিতে চাই দেশীয় বিনিয়োগে। যদি দেশীয় বিনিয়োগ না হয়, দেশের মানুষ যদি বিনিয়োগ না করে; তাহলে বাইরের লোকজন নেতিবাচক চিন্তা করে। তারা ভাবতে চায় দেশের মানুষ বিনিয়োগ কেন করছে না। অর্থাৎ এটাও একটা সক্ষমতার ব্যাপার বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে। অতএব দেশীয় বিনিয়োগের যেসব বাধা আছে, আইনগত বাধা, ব্যবসা প্রক্রিয়াকরণ বাধা, আইন-শৃঙ্খলা, যাতায়াত, প্রযুক্তিগত বাধা—এসব দূর করতে হবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে বিনিয়োগ পরিস্থিতিটা অনেক স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রণোদনার প্যাকেজে তাদের জন্য বরাদ্দ থাকলেও সেখানে অর্থ যাচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, দেশীয় বিনিয়োগ বাড়লে দেশের ইমেজ বৃদ্ধি পাবে এবং বাইরের লোকজনও আকৃষ্ট হবে।

বিদেশি বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ চারটি জিনিস হলো—বিনিয়োগ পরিবেশ, স্বচ্ছ আইন-কানুন ও নিয়ন্ত্রণমূলক বিধি-বিধান, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং কার্যকর জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা আমি আলাদা করে বলতে চাই। দেশে ব্যাংক ও বীমা ছাড়াও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোসহ বিভিন্ন সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের সঙ্গে বিনিয়োগের জোরালো সম্পর্ক রয়েছে। এখন এই চারটি ক্ষেত্রকে যদি আমরা উন্নত করতে না পারি, তাহলে আমরা বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারব না। খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ‘রেট অব রিটার্ন’ অনেক বেশি। যেসব বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে এ দেশে, মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিগুলো, তাদের প্রফিট মোটামুটি বেশ ভালো। অতএব চারটি জিনিস যদি আমরা ঠিক করতে পারি, তাহলে আমাদের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যাবে। এর সঙ্গে আমাদের সরকারি নীতিগুলো প্র্যাগমেটিক (বাস্তববাদী) ও ব্যবসাবান্ধব হতে হবে।

এই চারটি জিনিস ঠিকঠাকমতো কাজ করে না বলে দেশে ব্যবসা চালুর প্রক্রিয়াটা সময়সাপেক্ষ। এই প্রক্রিয়ায় সময়টা এত বেশি লাগে যে একটি বিনিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন হতে দুই থেকে তিন বছরও লেগে যায়। তা-ও অনেক সময় সিদ্ধান্ত হয় না। বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। বিডার ওয়ান স্টপ সার্ভিস দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো এটা সম্ভব হয়নি। কিন্তু অন্যান্য দেশে আমাদের মতো সময় লাগে না। এটা নিয়ে এত কথা হলো; কিন্তু কিছুই হলো না। এ জন্যই আমরা বলি, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে, রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকতে হবে। এই যে ঘাটে ঘাটে সময় লাগছে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকেই যাচ্ছে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে—এই রেগুলেটরি জটিলতার কোনো বিধান হচ্ছে না, সংশোধন হচ্ছে না। ফলে আমরা আসলে বারবার একটা দুষ্টচক্রের মধ্যে ঘুরপাক খাই। এ বিষয়টি নীতিনির্ধারকরা জানেন, আমলারাও জানেন। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন; কিন্তু কাজটা যাঁরা করবেন আমলা ও নীতিনির্ধারকরা—তাঁরা যদি নিজেরা খুব প্রো-অ্যাকটিভ না হন, তাঁরা যদি খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত না নেন, তাহলে কোনো কিছুতেই কিছু হবে না।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে দুটি ইতিবাচক বার্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে। এর একটি হলো দেউলিয়া আইন ১৯৯৭ সংশোধনের উদ্যোগ। যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি দেউলিয়ার অবস্থানে চলে গেছে, যাদের অবস্থা একেবারে খারাপ, এগুলোকে ঘোষণা দিয়ে দেউলিয়া করা উচিত। এই আইন দ্রুততম সময়ে সংশোধন করা উচিত। এতে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা বাড়বে এবং করপোরেট স্বচ্ছতাও বাড়বে। যাদের দেউলিয়া ঘোষণা করা হবে, তারা ফের ব্যাংকঋণ নিতে পারবে না, বাড়ি-গাড়ি ক্রয় করতে পারবে না, বিদেশে যেতে পারবে না, সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে না—খসড়ায় রাখা এই বিষয়গুলো চূড়ান্ত আইনেও রাখতে হবে। এর মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে একটা বার্তা যেন যায়, কেউ ইচ্ছা করে দেউলিয়া হতে পারবে না।

দ্বিতীয় ইতিবাচক খবরটি হলো, ভূমি নামজারির (মিউটেশন) সময় কমিয়ে আনার উদ্যোগ। এখানে ভূমি রেজিস্ট্রেশন হয় সাবরেজিস্ট্রি অফিসে। মিউটেশন করে এসি ল্যান্ডের দপ্তর। দুটিই সরকারের ভিন্ন বিভাগের অধীনে। সুতরাং দুটি আলাদা প্রতিষ্ঠান জমি রেজিস্ট্রেশন ও মিউটেশন করে। দেখা গেল আপনি রেজিস্ট্রেশন করলেন; কিন্তু মিউটেশন করতে সময় লাগে। এভাবে বিনিয়োগ বিলম্বিত হয় এবং উদ্যোক্তারা আগ্রহ হারায়। তাই জমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। বাইরের বিনিয়োগকারীরা যখন আসে, তখন তারা দ্রুত ব্যবসা চালু করতে জমি কিনতে চায়। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন ও মিউটেশন নিয়ে তাকে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। অতএব স্বল্পতম সময়ে নামজারি ও রেজিস্ট্রেশনের সমন্বয়ের উদ্যোগটা খুব ইতিবাচক বার্তা বহন করে।

আমাদের আরেকটা সমস্যা হচ্ছে প্রতিযোগিতা আইন। বাংলাদেশে প্রতিযোগিতা কমিশন আছে ঠিক। কিন্তু ২০১২ সালের আইনটাই ঠিকমতো প্রয়োগ হচ্ছে না দেশে। বিদেশে ‘অ্যান্টি ট্রাস্ট ল’ আছে। বড় কম্পানিগুলো যদি আরেকটা ছোট কম্পানিকে ‘টেক ওভার’ করতে চায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তারা আইন কার্যকর করে, বিলিয়ন ডলার ফাইন করে এবং বাধা দেয়। আমাদের দেশে তো এগুলো কিছুই নেই। আমাদের দেশে ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী মাত্রাতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নেয়। এখানে প্রতিযোগিতা নেই। তাই সুষ্ঠু বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি হয় না, ভোক্তারাও প্রতিযোগিতামূলক সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। সুতরাং প্রতিযোগিতা আইন কার্যকর খুব দরকার।

বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে আমাদের শিল্পায়নের, বিশেষ করে রপ্তানিপণ্যের এককেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের বিনিয়োগসংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা প্রধানত তৈরি পোশাক শিল্পকে (আরএমজি) কেন্দ্র করেই। কিন্তু এটা খুব ভালো জিনিস নয়। তাতে বাইরের লোকদের কাছে ভালো বার্তা যায় না। তাই আরএমজির পাশাপাশি আমাদের রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ করতে হবে। একই সঙ্গে সরকারি ভর্তুকি, প্রণোদনা, নানা রকম সরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং এনভায়রনমেন্টাল ডিগ্রিডেশন—এসবের ওপর নির্ভর করে পোশাকশিল্প ও অন্য কিছু শিল্প খাত লাভবান হচ্ছে। এসব সুযোগ-সুবিধা তুলে দেওয়া যাচ্ছে না, মানে, তারা এফিশিয়েন্ট হচ্ছে না। অতএব আমাদের ব্যাবসায়িক দক্ষতা বাড়াতে হবে। কৃত্রিম ইনসেনটিভ দিয়ে আমাদের শিল্পকে চললে হবে না। এটা যেন একটা শিশুকে কৃত্রিম উপায়ে লালন-পালন। আমাদের যেসব শিল্প এই কৃত্রিম ইনসেনটিভ দিয়ে চলে, তারা কি ৩০ বছর ধরে শিশুই রয়ে গেছে? একই সঙ্গে আমাদের কর্মীদের কর্মদক্ষতা (প্রডাকটিভিটি) বাড়াতে হবে। ভিয়েতনামের একজন নারীকর্মী আমাদের নারীকর্মীদের তুলনায় তিন-চার গুণ বেশি দক্ষ। যদিও আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, নিরাপদ কর্মক্ষেত্র ইত্যাদির সঙ্গে কর্মীদের দক্ষতার যোগসূত্রও রয়েছে।

বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে আরো যে কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে, তা হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চ মানসম্পন্ন পণ্য দিয়ে আমাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা তৈরি করা। আমাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তিগত সুবিধা বাড়াতে হবে। প্রযুক্তিতে আমাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা বাড়াতে হবে। চলতি বছর বৈশ্বিক উদ্ভাবনী সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান হলো ১৩০টি দেশের মধ্যে ১১৬তম। অথচ মালয়েশিয়ার অবস্থান ৩৩, ভারতের ৪৮ আর সুইজারল্যান্ড সর্বাগ্রে।

সুতরাং আমি মনে করি, আমরা যদি এই জিনিসগুলো ঠিকঠাক করতে পারি, তাহলে আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসবেই। এর পাশাপাশি আমাদের স্থানীয় বিনিয়োগও বাড়বে। আমাদের জনশক্তি, আমাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট—সব আমাদের অনুকূলেই আছে। আমাদের শুধু দরকার বিনিয়োগের সুযোগ বাড়িয়ে নীতি-কৌশল যুগোপযোগী করা।

 

 

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ