বিএনপি এখন কী করবে?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সংসদের বাইরে থাকা প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কেউ স্বীকার না করলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত ৬ প্রার্থীর শপথগ্রহণ ও সংসদে যোগদান এবং দুটি মামলায় দোষীসাব্যস্ত হয়ে কারাদণ্ড ভোগরত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন- একটির সঙ্গে আরেকটি শর্তযুক্ত হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। উভয় দলের নেতাদের সাম্প্রতিক কথাবার্তা থেকে এমন একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

নানা অনিয়মের অভিযোগ থাকা একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বর্জনকারী এবং নির্বাচনে জয়ী দলটির ৬ জন প্রার্থীর শপথগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বিএনপি এমতাবস্থায় কী করবে তা নিয়ে আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

গত ১৯ এপ্রিল বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে শত নাগরিক কমিটির আয়োজনে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে নিয়ে লেখা ‘খালেদা জিয়া : তৃতীয় বিশ্বের কণ্ঠস্বর’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘বিএনপি থেকে নির্বাচিত ৬ জনের সংসদে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ আমরা দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কেউ শপথ নেবে না।

আমরা স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে (স্কাইপিতে) বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সুতরাং এখানে কোনো পরিবর্তন ও ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন আসে না’ (যুগান্তর, ২০ এপ্রিল)। তবে তিনি এও বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত বিএনপির সাংসদদের শপথ নেয়ার প্রশ্নই আসে না’ (প্রথম আলো, ২০ এপ্রিল)।

দলটির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র্র রায় একই অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়ার প্যারোলে ‘মুক্তির’ বিষয়টিকে ‘ঠাট্টা ও মশকারা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, এ ধরনের প্রস্তাব সরকারের কাছ থেকে আসতে পারে না এবং আসবে না। ২০ এপ্রিল কুমিল্লায় এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপি কখনই প্যারোলে খালেদা জিয়ার ‘মুক্তি’ দাবি করেনি।

এসব গুজব, মিডিয়ার সৃষ্টি। খালেদা জিয়ার ‘মুক্তির’ বিনিময়ে বিএনপির নির্বাচিত ‘এমপিরা’ সংসদে যাবেন, এমন তথ্যও সঠিক নয়। এদিকে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও নেতারা একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি প্রার্থীদের শপথগ্রহণ ও সংসদে যোগদানের আহ্বান জানিয়ে আসছেন। সর্বশেষ ২০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সভা শেষে দলটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিনের সঙ্গে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি প্রার্থীদের সংসদে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। উভয় দলের নেতাদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে যে ধারণা জন্মে তা হল, একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী ৬ জন বিএনপি প্রার্থীর শপথগ্রহণ ও সংসদে যোগদান এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন শর্তযুক্ত করা নিয়ে সরকার ও বিএনপির মধ্যে দরকষাকষি চলছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের অনুকূলে সিল মেরে রাখা, বুথ দখল করে প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের অনুকূলে ব্যালটে সিল মারা, সরকারবিরোধী জোটের পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়া, সরকারবিরোধী দল বা জোটের প্রার্থীর সমর্থক ও নেতাকর্মীদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন, হামলা, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করা ও পুড়িয়ে দেয়া- এসব অভিযোগ এ নির্বাচনের ফলাফলকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে।

অন্যদিকে অভিযোগ আছে, নির্বাচনের আগে বিএনপি বা বিএনপির আবরণে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের নির্বাচনী কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখতে নেয়া হয় নানা ব্যবস্থা। গত বছর ৮ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কর্তৃক একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই বিএনপির বহু নেতাকর্মীকে ‘গায়েবি ও হয়রানিমূলক’ মামলায় আটক করা হয়। সিইসি তার ৮ নভেম্বরের ভাষণে ভোটার, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, প্রার্থী, প্রার্থীর সমর্থক ও এজেন্টদের বিনা কারণে হয়রানির শিকার বা মামলা-মোকদ্দমার সম্মুখীন না করার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে তখন পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৫২১টি মামলা হয়। গ্রেফতার করা হয় ১ হাজার ৮৬ জনকে।

আর ২০০৯ থেকে তখন পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৯০ হাজার ৩৪০টি মামলা হয়। এসব মামলায় ২৫ লাখ ৭০ হাজার ৫৪৭ জন আসামি। তাদের মধ্যে কারাগারে ৭৫ হাজার ৯২৫ জন। ফলে বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ও তাদের কর্মীদের নির্বাচনী প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার মতো কোনো পরিবেশ ছিল না।

এ কথা ঠিক, ভোটে নানা অনিয়ম ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হতে সহায়তা করেছে। তবে তাদের এ বিজয়ে বিএনপির নেতৃত্বহীনতাও কিছুটা ভূমিকা রেখেছিল। খালেদা জিয়া কারাবাসে থাকায় বিএনপি নেতাকর্মীরা উদ্যম ও সাহস হারিয়ে ফেলেন। সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে জীবন বাজি রেখে ভোটকেন্দ্র পাহারা দেয়াসহ প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণে তাদের তেমন উৎসাহী দেখা যায়নি।

নির্বাচনে অনিয়ম হতে পারে এমন আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও বিএনপি নেতারা তা প্রতিরোধ করার মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করেননি। একমাত্র খালেদা জিয়ার নির্দেশনাই দলীয় কর্মীদের জীবন বাজি রেখে এমন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করতে পারত। বিএনপি নেতারা তাদের দলের কাণ্ডারিবিহীন অবস্থা চিন্তা করেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের দল থেকে নির্বাচিত ৬ জনের শপথগ্রহণ ও সংসদে যোগদানের বিনিময়ে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘মুক্তি’তে (জামিন) আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন।

তবে খালেদা জিয়ার জামিনের বিনিময়ে নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপির ৬ প্রার্থীর শপথগ্রহণ ও সংসদে যোগদানের ক্ষেত্রে দলটিকে বড় ছাড় দিতে হবে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিএনপি এ যাবৎ প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ এবং প্রার্থীর বিজয় চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টের নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৭৪ প্রার্থী। এখন খালেদা জিয়ার জামিনের বিনিময়ে বিএনপি নির্বাচনে বিজয়ী তাদের ৬ প্রার্থীর শপথগ্রহণ ও সংসদে যোগদানে সম্মত হলে একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের ব্যাপারে তাদের নেয়া অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে।

সরকারি দল সঙ্গতভাবেই যুক্তি দেখাবে, বিএনপি একাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টিকে মেনে নিয়েছে এবং নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়েই তাদের বিজয়ী ৬ জন প্রার্থীকে শপথগ্রহণ ও সংসদে যোগদানের অনুমতি দিয়েছে। এতে ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচন দেয়ার বিএনপির দাবি গুরুত্ব হারাবে। তাছাড়া খালেদা জিয়া জামিন পেলে তার জামিনে থাকাকালীন রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ না করার শর্ত জুড়িয়ে দেয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

আর যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল, একাদশ সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের প্রতিবাদে বিএনপি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নির্বাচনে বিজয়ী তাদের ৬ প্রার্থীর শপথগ্রহণ ও সংসদে যোগ দেয়ার মধ্য দিয়ে তাদের সে সিদ্ধান্ত প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়বে। উত্তর ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে নবগঠিত ৩৬টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ও ১২টি নারী কাউন্সিলর পদে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এবং পঞ্চম উপজেলা পরিষদের পাঁচ ধাপের মধ্যে চার ধাপে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। এতে দলটির তৃণমূল পর্যায়ে নেতারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারা এমপি হতে চান না।

তাদের লক্ষ্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ও জয়ী হওয়া। এখন সরকারি দলের সঙ্গে কোনোরকম সমঝোতা বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ে অসন্তোষ বাড়াবে। এতে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মীর অন্য বড় দলে, বিশেষ করে সরকারি দলে যোগদানের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সরকারি দল দু’বাহু বাড়িয়ে দিয়ে তাদের আলিঙ্গন করবে।

এটা ঠিক, বিএনপির সর্বোচ্চ দু’জন নেতার রাজনৈতিক কার্যক্রমে শারীরিক অনুপস্থিতি দলটিকে অত্যন্ত দুর্বল অবস্থানে নিয়ে এসেছে। জন্মের পর থেকে গত প্রায় চল্লিশ বছরে দলটির এমন দুরবস্থা দেখা যায়নি। তবে এতে হতাশ হলে চলবে না।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ ঠিক এমন অবস্থায় পড়েছিল। কিন্তু দলটি ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় নেয়নি। বঙ্গবন্ধু বা তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে না থাকা সত্ত্বেও ১৯৭৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে দলটি মোট প্রদত্ত ভোটের ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ পেয়ে এবং সংসদের মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ৩৯টিতে জয়ী হয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করেছিল।

দলটির এর পরের ইতিহাস সবার জানা। আওয়ামী লীগের মতো এবার বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৯ এপ্রিল ‘খালেদা জিয়া : তৃতীয় বিশ্বের কণ্ঠস্বর’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে হয়তো ঠিক বলেছেন, ‘বিএনপি নিঃশেষ হয়ে যায়নি। বিএনপি প্রতিটি সংকটে উঠে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েছে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে।’

এটা অনস্বীকার্য, একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপির ৬ প্রার্থীর শপথগ্রহণ ও সংসদে যোগদানের বিনিময়ে খালেদা জিয়ার জামিনের বিষয়টি নিয়ে বিএনপি এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন। বিএনপির বর্তমান নেতৃবৃন্দকে সব দিক বিবেচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।