বিএনপির ভিশন ২০৩০: পর পর কেউ দুইবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

জোরেশোরেই চলছে ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার তৈরির কাজ। জোট দুটির নেতারা বলছেন, জোট ও ঐক্যফ্রন্টের সব দলের মতমতের ভিত্তিতে দেওয়া হবে যৌথ ইশতেহার।

বিএনপি নেতারা বলছেন, ভিশন ২০৩০-এর আলোকে ইশতেহার তৈরির কাজ চলছে। তবে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা জানান, যে ১১ লক্ষ্য তাঁরা তুলে ধরেছেন, তার বিস্তারিত রূপই হবে তাঁদের ইশতেহার। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার কমিটির বৈঠক হয়েছে। সেখানে অংশ নেওয়া দলগুলো তাদের দলের পক্ষ থেকে প্রস্তাব তুলে ধরেছে।

এটি নিয়ে আগামী রবিবার আবার বৈঠক হবে। সেখানে খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্ত হলে সেটি যাবে স্টিয়ারিং কমিটিতে। সেখানে আরেকটি পরিমার্জিত খসড়া তৈরি করার পর তা দেওয়া হবে বিএনপিকে। বিএনপি সেটি নিজেরা ও ২০ দলের সঙ্গে আলোচনা করবে। পরে সেটি বিএনপি ও ফ্রন্ট নেতারা চূড়ান্ত করে জাতির সামনে তুলে ধরবেন।

গতকাল বৈঠকে যেসব প্রস্তাব এসেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো—পর পর দুবার কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে এমপিদের স্বাধীনভাবে মতামত দেওয়ার সুযোগ (ফ্লোর ক্রসিং) দেওয়া হবে। পুলিশ ও সেনাবাহিনী ছাড়া চাকরিতে ঢোকার ক্ষেত্রে বয়সের কোনো সীমা থাকবে না। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া সব উন্নয়ন প্রকল্পের ‘দুর্নীতির’ খতিয়ান তুলে ধরে তার বিচারের ব্যবস্থা করা হবে। তবে এসব প্রকল্পের কোনোটিই বন্ধ করা হবে না। ইউটিলিটি বিল, যেমন—বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল ৫০০ ইউনিট পর্যন্ত কমানো হবে এবং এর ওপরে যাদের তাদের বাড়ানো হবে না। দেশের সবার জন্য রেশনিং পদ্ধতি চালু করা হবে। বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ড হবে না। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট এবং প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা ছাড়াও আরো কিছু প্রস্তাবও এসেছে।

জানতে চাইলে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ইশতেহারের মূল বিষয়বস্তু হবে দুর্নীতিমুক্ত উন্নয়ন। তাতে থাকবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। তরুণ প্রজন্মের চাহিদাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্ব দিয়েই নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির কাজ চলছে, অচিরেই তা ঘোষণা করা হবে।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘২০৩০ ভিশনকে বেইস লাইন হিসেবে ধরে আমাদের ইশতেহার তৈরির কাজ চলছে। ঐক্যফ্রন্টের প্রস্তাবগুলো সমন্বয় করা হবে এবং আমাদের ২০ দলীয় জোটে যাঁরা আছেন তাঁদের কাছ থেকেও যদি আমাদের চিন্তা-চেতনার বাইরে আরো কোনো অগ্রসর ও যুগোপযোগী প্রস্তাব থাকে, সেগুলোও অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আগামী সাত দিনের মধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নিবার্চনী ইশতেহার চূড়ান্ত করা হবে। তিনি বলেন, ১১ দফার আলোকে প্রশাসনের ও বিচার বিভাগের ন্যায়বিচার ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়গুলো ইশতেহারে প্রধান্য পাবে।

গতকাল সকালে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে ডা. জাফরুল্লাহর অফিসে ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে তিনিসহ উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকবাল সিদ্দিকী, নাগরিক ঐক্যের ডা. জাহেদুর রহমান, গণফোরামের শফিকউল্লাহ ও জেএসডির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন।

উপস্থিত দলগুলোর বাইরে চরমোনাইয়ের দল ইসলামী আন্দোলনের পক্ষে দেওয়া কয়েকটি প্রস্তাবের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন নেতারা। বৈঠক সূত্র বলছে, গণফোরামের দেওয়া প্রস্তাবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলার বিষয়টি। সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবও বেশি দেওয়া হয়েছে ওই দল থেকে।

বিএনপির পক্ষ থেকে অনেকগুলো প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তিন পৃষ্ঠায় লেখা প্রস্তাবগুলো পেশ করেন মাহফুজ উল্লাহ। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—পুলিশ ও সেনাবাহিনী ছাড়া বয়সের কোনো সীমা থাকবে না। যে কেউ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ঢুকতে পারবে। বিএনপির লিখিত প্রস্তাবের সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো—পর পর দুইবার কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।

বৈঠকে বিগত সব উন্নয়ন প্রকল্পের ‘দুর্নীতি’র খতিয়ান নেওয়া হবে বলে ইশতেহারে বিষয়টি সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এসব প্রকল্পের ধারা অব্যাহত থাকার কথাও থাকবে ইশতেহারে। উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে বৈঠকে বলা হয়, কৃষক, শ্রমিক, তরুণদের উন্নয়ন ও তাদের কর্মসংস্থান হবে। একটি টাস্কফোর্স গঠনের কথা ইশতেহারে রাখার সিদ্ধান্ত হয়, যেটি সংবিধানের সংস্কারের প্রস্তাব আনবে, এমপিদেরকে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের সুবিধা দেওয়ার কথা থাকবে, সংবিধানের অন্যান্য জটিল ও সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে টাস্কফোর্স।

প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ইশতেহারে উল্লেখ করার কথা বৈঠকে আলোচিত হয়। গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের দাম নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কিভাবে কমানো যায় তা খতিয়ে দেখার কথা বলেন নেতারা। ৫০০ ইউনিট যারা ব্যবহার করে তাদের বিল কমানো আর অন্য যারা এর ওপরে ব্যবহার করবে সেটি যাতে না বাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখার ঘোষণা থাকবে ইশতেহারে। এ ছাড়া সবার জন্য রেশনিং কার্ড চালু করা, বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ড হবে না বলে ইশতেহারে গুরুত্ব দেওয়া হবে।

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রস্তাবে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে সংবিধানের সংস্কার ও আইন-কানুন পরিবর্তন। তাদের প্রস্তাবে আরো রয়েছে—শিশু নিপীড়নমূলক পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিল করা, পরীক্ষাপত্র মূল্যায়নে অসততা বা প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঠেকানো, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির নোংরা খেলা বন্ধ করা, সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ ছাত্রসংসদ নির্বাচন আয়োজন করা, মাধ্যমিক স্তরে চালু অপ্রয়োজনীয় বইয়ের বোঝা কমিয়ে দেওয়া, বেদখল থেকে পার্ক ও মাঠগুলো উদ্ধার করা, কর্মজীবী মায়েদের জন্য মানসম্পন্ন ডে কেয়ার গড়ে তোলা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিতে স্থানীয় সরকার বা জাতীয় সরকারের বা প্রশাসনের কোনো প্রতিনিধি না থাকার বিধান করা, মায়ের গর্ভকাল শুরু থেকে শিশুর বয়সের পাঁচ বছর পর্যন্ত বিশেষ ভাতা প্রদান, সরকারের সব পর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারবর্গের যতটা সম্ভব সরকারি শিক্ষা এবং যতটা সম্ভব দেশের চিকিৎসা গ্রহণ করার ব্যবস্থা করা। চরমোনাইয়ের দল থেকে মাদকবিরোধী প্রচারণা স্কুলের পাঠ্য বইয়ে আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

বিএনপি ও ফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, যৌথ এই ইশতেহারের স্লোগান এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে ‘দেশ বাঁচাতে মানুষ বাঁচাতে, আনবে পরিবর্তন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ এই স্লোগানটি নিয়ে আলোচনা চলছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, ইশতেহারে সাংবিধানিক সংস্কার, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, বেকারত্ব কমানো, উন্নয়নের সুষম বণ্টন, সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার নিশ্চিত, জাতীয় নেতাদের মর্যাদা নিশ্চিত, মেগা প্রকল্পগুলো অব্যাহত রাখা, নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি, কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন, কোটা সংস্কার, সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত, স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের সরকারি চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি থাকবে। তাঁরা জানান, রাজনীতিতে অতীতমুখিতা বা প্রতিহিংসা বাদ দিয়ে নতুন ধারার সৃষ্টি, সংসদকে সব কর্মকাণ্ডে কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি থাকবে ইশতেহারে। প্রশাসনে আমূল পরিবর্তন আনার প্রত্যয় থাকবে। সুশাসন, সুনীতি ও সুসরকারের (থ্রিজি) সমন্বয় ও বৃহত্তর জনগণের সম্মিলনের মাধ্যমে ‘ইনক্লুসিভ সোসাইটি’ গড়ার অঙ্গীকার থাকবে। প্রশাসন ও বিচার বিভাগে দলীয়করণের অবসান ঘটিয়ে মেধা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা থাকবে। শিক্ষা ও কৃষি খাতে যুগোপযোগী সংস্কারের মাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা, বাস্তবমুখী শিক্ষাব্যবস্থা, ক্রীড়াক্ষেত্রে শুধু স্থাপনা নির্মাণ নয়, গুরুত্ব দেওয়া হবে নিয়মিত টানা অনুশীলনের দিকে, খেলায় শতভাগ মনোযোগ দেওয়ার লক্ষ্যে খেলোয়াড়দের আর্থিক বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখার প্রতিশ্রুতি থাকবে।

জানা গেছে, কোটার যৌক্তিকীকরণের অঙ্গীকার থাকবে। মুক্তিযোদ্ধাসহ সব কোটা বাস্তবতা অনুযায়ী যৌক্তিক হারে পুনর্বহাল, চাকরিতে আবেদনের ফি বা পে অর্ডার থাকবে না, যানবাহনে বা গণপরিবহনে স্টুডেন্ট হাফ ভাড়া কার্যকর, সুলভ মূল্যে ইন্টারনেট, তরুণদের সৃজনশীল করে গড়ে তুলতে প্রতিটি উপজেলায় সমৃদ্ধ পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপন ইত্যাদি ইশতেহারে থাকছে। ‘স্মার্ট শহর’ নামে একটি অঙ্গীকার থাকবে ইশতেহারে। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা, যাতে মানুষ আরো শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারে। কালের কণ্ঠ