নিজস্ব প্রতিবেদক: একসময় ছিলেন তিনি শিবির ক্যাডার। একেবারেই দরিদ্র পরিবারের এ যুবক পরে কাজ নেন বাসের সুপারভাইজারের। সেখান থেকে কয়েক বছরের ব্যবধানে হন কোটিপতি। রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার পেছনে আলাদিনের চেরাগবাতি হিসেবে কাজ করে তাঁর মাদকের কারবার।
এই মাদকের কারবার করে তিনি এখন রাজশাহী শহরে তিনটি বাড়ি, তিনটি দোকান এবং গোদাগাড়ী উপজেলা সদরে দুটি বিলাসবহুল বাড়ির মালিক। এত দিন স্থানীয় জনপ্রতিনিধির ছত্রচ্ছায়ায় নিজেকে অসীম ক্ষমতাধর করে তুললেও শেষ রক্ষা হয়নি। সম্প্রতি গোদাগাড়ীর মাটিকাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক পদও পান সেই অর্থের জোরে।
অবশেষে পুলিশের ওপর মহলের চাপে গত শুক্রবার বিকেলে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেই ‘মাদকসম্রাট’ রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সোহেলকে; যাঁর পুরো নাম সোহেল রানা। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে মাদক কারবার থেকে তাঁর কোটিপতি হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে।
গোদাগাড়ী থানার পুলিশ জানায়, গত শুক্রবার বিকেলে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বাইপাস মোড় থেকে থানার পুলিশ সোহেলকে গ্রেপ্তার করে। সরকারবিরোধী নাশকতার ষড়যন্ত্র, প্রচারণা ও উসকানির অভিযোগের একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে গতকাল শনিবার দুপুরে তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, হেরোইনের কারবারই তাঁর মূলকাজ।
রাজশাহীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুবিত চৌধুরী জানান, সোহেল রানার বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগ রয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাঁকে আটক করা হয়। এ ছাড়া বড় মাদক কারবারের অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে।
সম্প্রতি গোদাগাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশিদ শারীরিকভাবে নাজেহাল হন সোহেলের হাতে। এ ঘটনায় গোদাগাড়ীতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়।
গোয়েন্দা ও স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, একসময় শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন সোহেল রানা। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি স্থানীয় শীর্ষ জনপ্রতিনিধিসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। এ কারণেই তিনি দলের নাম ভাঙিয়ে দিনের পর দিন মাদকের কারবার করে গেলেও পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি গ্রেপ্তারের পরও পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মাদকের মামলা না দিয়ে শুধু সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র ও নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়; যাতে দ্রুত তিনি জামিনও লাভ করতে পারেন। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে রাজশাহী জেলা ও গোদাগাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝে। গতকাল কয়েকজন নেতাকর্মী কালের কণ্ঠ’র কাছে ফোন করেও তাদের ক্ষোভের কথা জানায়।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, মাদকসম্রাট সোহেল রানা গোদাগাড়ী উপজেলার উজানপাড়া গ্রামের মজিবুর রহমানের ছেলে। কয়েক বছর আগেও জীবিকার তাগিদে ন্যাশনাল ট্রাভেলসে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করতেন তিনি। এ কাজে প্রতিদিন আয় করতেন মাত্র কয়েক শ টাকা। কিন্তু ২০১০ সালের শেষের দিকে হঠাৎ করে সুপারভাইজারের কাজ ছেড়ে দেন। অভিযোগ রয়েছে, এর পর থেকেই তিনি শুরু করেন হেরোইনের কারবার। এ জন্য ভারতের মাদক মাফিয়াদের সঙ্গে গড়ে তোলেন গভীর সম্পর্ক। ভারতের লালগোলা থেকে সোহেলের কাছে আসতে থাকে হেরোইনের বড় বড় চালান। সেসব চালানে তিনি রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলকেন্দ্রিক মাদক সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। এরপর দ্রুত বদলে যেতে থাকে সোহেলের আর্থিক অবস্থা। এ সুযোগে ধূর্ত সোহেল টাকা-পয়সা ছড়িয়ে স্থানীয় এমপি থেকে শুরু করে রাজশাহীর ক্ষমতাসীন নেতাদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন।
সোহেলের ফেসবুক আইডি ঘেঁটে দেখা গেছে, রাজশাহী-১ আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে তোলা তাঁর একটি প্রফাইল পিকচার করা ছবি রয়েছে। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সুবাদে সোহেল সুযোগ পেলেই বড় বড় মন্ত্রী, এমপি ও নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে ছবি তুলতেন। আর সেই ছবি তাঁর ফেসবুক পাতায় দ্রুত আপলোড করতেন।
সোহেলের রাজনীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে গোদাগাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশিদ বলেন, সোহেল দলের কোনো পদেই নেই। তিনি একসময় শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের বড় নেতা পরিচয় দিয়ে এলাকায় দাপটে ছিলেন। কিন্তু তিনি একজন বড় মাপের মাদক কারবারি। কোথাও দলের বড় নেতারা এলে তিনি নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে ছেড়ে দেন। আর সেই ছবি দিয়েই তিনি বড় আওয়ামী লীগ নেতা হয়ে মাদকের কারবার করতেন।
জানতে চাইলে গোদাগাড়ী থানার ওসি হিপজুর আলম মুন্সি বলেন, সোহেলের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ আছে। তবে মাদকের কারবার করে তিনি কোটিপতি হয়েছেন বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদন রয়েছে।
স/আর