বালিশ কাণ্ডের সেই হোতা পাচ্ছেন পাবনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৮০ কোটি টাকার কাজ

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসিক ভবনে একটি বালিশ ওঠানোর জন্য খরচ দেখানো হয়েছিল ৭৬০ টাকা, আর কেনায় দেখানো হয়েছিল পাঁচ হাজার ৯৫৭ টাকা। বৈদ্যুতিক চুলা ভবনে ওঠানোর খরচ দেখানো হয় ছয় হাজার ৬৫০ টাকা। টেলিভিশন ওঠানোর খরচ দেখানো হয় সাত হাজার ৬৩৮ টাকা। দুর্নীতির এমন এলাহি কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন ঠিকাদার সাজিন এন্টারপ্রাইজের মালিক শাহাদাত হোসেন। বিতর্কিত এই ঠিকাদারের কাণ্ডে সরকার পড়েছিল ভাবমূর্তি সংকটে। দেশজুড়ে তোলপাড় ওঠার পর দুদকের মামলায় সেই শাহাদাতসহ ১৩ জন এখন জেলে রয়েছেন। একই সঙ্গে সাজিন এন্টারপ্রাইজকে কালো তালিকাভুক্ত করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। কিন্তু জেলে থেকেও কমেনি শাহাদাত ও তাঁর সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য।  সেখানে বসেই শাহাদাত নিজের প্রতিষ্ঠান ও সিন্ডিকেটের জন্য বাগিয়ে নিয়েছেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকার উন্নয়নকাজের বেশির ভাগ।

সাজিন এন্টারপ্রাইজকে কালো তালিকাভুক্ত করায় ভিন্ন কৌশলে কাজ বাগিয়েছেন শাহাদাত। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর আরেক প্রতিষ্ঠান সাজিন কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের নামে আলাদা দুটি ভবন নির্মাণের ৮৭ কোটি টাকার কাজ  দিচ্ছে। এরই মধ্যে দরপত্রপ্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এটা করতে গিয়ে সর্বনিম্ন দর প্রস্তাবকারীকে বঞ্চিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ সর্বনিম্ন দরদাতা জিন্নাত আলী জিন্নাহ লিমিটেডের মালিক লিখিত অভিযোগ করেছেন প্রকল্প কর্মকর্তা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চে ১৭টি ভবন নির্মাণসহ মোট ৩১টি কাজের পৃথক দরপত্র আহ্বান করে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। মোট ৪৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকার কাজের জন্য বহু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয়। এর মধ্যে ১০ তলা ছাত্রী হল নির্মাণের দরপত্রে চারটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এগুলো হলো যৌথভাবে আতাউর রহমান খান-জিন্নাত আলী জিন্নাহ লিমিডেট, এমজেসিএল-এমএনএইচসিএল এবং হোসাইন কনস্ট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেড ও সাজিন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আতাউর রহমান খান-জিন্নাত আলী জিন্নাহ লিমিটেড সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ৪৮ কোটি ৯৩ লাখ ৫৫ হাজার ৩৩৭ টাকায় কাজ নিতে প্রস্তাব দেয়। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা হোসাইন কনস্ট্রাকশন ৪৮ কোটি ৯৩ লাখ ৮৮ হাজার ৫০০ টাকা প্রস্তাব করে। কিন্তু সর্বনিম্ন দর প্রস্তাবকারী এই দুই প্রতিষ্ঠানকে নীতিমালাবহির্ভূত ঠুনকো অভিযোগে কাজ দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করা হয়েছে। নির্বাচিত করা হয়েছে তৃতীয় নিম্ন দর প্রস্তাবকারী সাজিন কনস্ট্রাকশনকে। সাজিন ৪৯ কোটি ১৯ লাখ ৯৩ হাজার ৩৭৮ টাকা প্রস্তাব করে। ২৬ লাখ ৩৮ হাজার ৪১ লাখ টাকা বেশি দর প্রস্তাব করেও নির্বাচিত হয়েছে সাজিন।

পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ তলা প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের দরপত্রে পাঁচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এর মধ্যে সর্বনিম্ন সাড়ে ৩০ কোটি ৫৪ লাখ ১০০ টাকা দর প্রস্তাব করে আতাউর রহমান খান-জিন্নাত আলী জিন্নাহ (জেবি)। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ৬৩ লাখ ৮৬ হাজার ৫৮৯ টাকা বেশি দর প্রস্তাব করার পরও কাজের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে শাহাদাত হোসেনের সাজিন কনস্ট্রাকশনকে। শুধু এই দুই কাজই নয়, অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির মোট ৪৮০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজের মধ্যে প্রায় পুরোটাই শাহাদাতের সিন্ডিকেটের ঠিকাদাররা পেয়েছেন।

শিক্ষকদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম রুস্তম আলীর সঙ্গে যোগসাজশে কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন শাহাদাতসহ তাঁদের সিন্ডিকেটের ঠিকাদাররা। সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টকারী ও বিতর্কিত যে ব্যক্তি এখনো দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে রয়েছেন, বেশি দর প্রস্তাব করেও কিভাবে তাঁর প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষকরা।

এই উন্নয়ন প্রকল্পে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে আব্দুর রহিমকে নিয়োগ দিয়ে শুরুতে বিতর্কে জড়ান উপাচার্য। আব্দুর রহিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের ভবন নির্মাণসহ অন্যান্য উন্নয়কাজে দুর্নীতির অভিযোগে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। শিক্ষকদের চাপে পড়ে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তাঁকে চাকরিচ্যুত করতে বাধ্য হন উপাচার্য। একই প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ইসিএল নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও রডের পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বালিশকাণ্ডের পর দুদকের করা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর গত বছরের ১২ ডিসেম্বর শাহাদাত হোসেনকে কারাগারে পাঠান আদালত। কারাগারে যাওয়ার পর কালো তালিকাভুক্ত হওয়া সাজিন এন্টারপ্রাইজকে ব্যবহার থেকে বিরত থাকছেন শাহাদাত হোসেন। এর পরিবর্তে তাঁরই অন্য প্রতিষ্ঠান সাজিন কনস্ট্রাকশনকে ব্যবহার করছেন সর্বত্র। জেলে বসেই নানাভাবে সরকারি কর্মকর্তা এবং নিজের সিন্ডিকেটের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তিনি। সিন্ডিকেটের লোকজন কারাগারে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের নানা ধরনের শলা-পরামর্শ দেন শাহাদাত। তাঁর ঠিকাদারি ব্যবসা তদারকি করেন শ্বশুর আফতাব উদ্দিন আহমেদ। দরপত্রে অংশ নেওয়ার কাজটি তিনি করেন। আর সবাইকে ম্যানেজ করার কাজটি জেলে বসে শাহাদাতই করেন।

জিন্নাত আলী জিন্নাহর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ঠিকাদারি কাজে অংশ নিয়েছিলাম। সর্বনিম্ন দর প্রস্তাব করার পরও দুটি প্রকল্পেরই কাজ আমি পাইনি। কেন আমাকে কাজ দেওয়া হয়নি, সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগও করেছিলাম।’

আরেকজন ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে সাজিন কনস্ট্রাকশনের মালিকের সখ্য রয়েছে। কৌশলে তিনি সাজিনের মালিককে কাজ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন। দুর্নীতিবাজ শাহাদাত কারাগারে থেকেই কাজটি কৌশলে হাতিয়ে নিয়েছেন।

এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক লে. কর্নেল (অব.) আজিজুর রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আপনি যেসব তথ্য সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন, এ বিষয়ে আমার কথা বলার অনুমতি নেই। আমাদের জনসংযোগ বিভাগ আছে, সেখানে যোগাযোগ করুন।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা ফারুক হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম রুস্তম আলীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে জানে মূল্যায়ন কমিটি, মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়েছে।’ কারাগারে থাকা একজন বিতর্কিত ঠিকাদারকে কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজের জন্য নির্বাচিত করা হলো জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, ‘সর্বনিম্ন দর প্রস্তাব করলে তো কাজ পাবেই।’

কিন্তু সাজিন এন্টারপ্রাইজ তো সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল না জানানো হলে উপাচার্য এবার বলেন, ‘এসব আমি জানি না, মূল্যায়ন কমিটি জানে। আর আমি তো তাকে নির্বাচিত করিনি। মূল্যায়ন কমিটিই তাকে নির্বাচিত করেছে। তবে এখনো কাজের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়নি।’ শাহাদাতের সঙ্গে সখ্য থাকা এবং নিজের গ্রামের মানুষকে ঠিকাদারি কাজ দেওয়ার বিষয়ে সহযোগিতা করার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, ‘আমার সঙ্গে কার সম্পর্ক আছে, সেটা আপনি খুজেঁ বের করেন। আমার সব কিছুই মন্ত্রণালয় জানে।’ সূত্র: কালের কণ্ঠ