বাম গণতান্ত্রিক শক্তি ও বাংলাদেশের রাজনীতি

গত শুক্রবার ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির বা সিপিবির দ্বাদশ কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অধিবেশনে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও অন্য কমিউনিস্ট নেতারা বলেছেন, দেশে করোনাভাইরাসের চেয়েও ভয়াবহ রাজনৈতিক শূন্যতা চলছে। তাঁরা যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধার জন্য বিএনপির সমালোচনা করেছেন এবং বলেছেন, তাঁরা দেশ শাসনের স্বপ্নে ব্যস্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ তিন মেয়াদের শাসন সম্পর্কে বলেছেন, তাঁরা দেশে লুটপাটের শাসন কায়েম করেছেন।

তাঁরা জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছেন। দুটি বড় দলই দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। এই শূন্যতা বহাল থাকলে দেশের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। এ জন্য তাঁরা দেশে বাম গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানের আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, বাম গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানের দ্বারা ক্ষমতায় বসতে হবে। বামদের ক্ষমতায় যাওয়া ছাড়া দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা দূর হবে না।

সিপিবির কাউন্সিল অধিবেশনে নেতারা অনেক দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং তাঁরা ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তাঁদের দীর্ঘ বক্তৃতার কথা একটিই—আওয়ামী লীগ দেশে ভয়াবহ অপশাসন শুরু করেছে। এই অপশাসনের বিকল্প যে প্রগতিশীল বামশক্তির উত্থান, এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করি না। কিন্তু সিপিবির ক্ষমতায় যাওয়ার অভিলাষকে আমি ‘বামনের চাঁদে হাত’ দেওয়ার সমতুল্য মনে করি।

১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর থেকে সিপিবি একলা চলার নীতি গ্রহণ করে। পরে পাঁচদলীয় বাম ঐক্যজোটে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু কোনোবারই ক্ষমতায় যেতে পারেনি। গেছে হয় বিএনপি, না হয় আওয়ামী লীগ। সিপিবির মতে, দুটি দলই অপশাসক। তাহলে তারা স্বচ্ছ দল হয়েও ক্ষমতায় যেতে পারছে না কেন? এটা তারা কখনো বিবেচনা করে দেখে কি? আমি মনে করি, সিপিবির আগেকার নীতি তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার অনুকূল ছিল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নেহরু সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে। কংগ্রেসকে তারা বাম রাজনীতির অনুকূলে রাখতে সফল হয়। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব থেকে ভারতকে মুক্ত রেখে নেহরু জোটনিরপেক্ষ নীতির অনুসরণ করে ভারতে গণতন্ত্র ও মিশ্র অর্থনীতি কায়েম রাখতে সমক্ষ হয়েছিলেন। এটা সম্ভব হয়েছিল কংগ্রেসের ওপর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির চাপ থাকার ফলে। সিপিআই আশা করেছিল কংগ্রেসের বাম অংশকে শক্তিশালী রেখে তারা একসময় ক্ষমতায় যেতে পারবে। তাদের আশা ক্রমেই পূরণ হচ্ছিল।

ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তা দান করে। ১৯৬৪ সালে কংগ্রেসের বিরোধিতার নামে একদল চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে দেয় এবং সিপিএম গঠন করে। তারা পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, কেরল প্রভৃতি রাজ্যে কংগ্রেসের শাসন উত্খাত করে সিপিএমের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম ৩০ বছরেরও বেশি আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল। তার ফল হয়েছে এই যে এই রাজ্যটি কমিউনিস্ট রাজ্য হয়নি; বরং জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে দলটি কংগ্রেসের মতোই দুর্নীতিপরায়ণ দলে পরিণত হয়েছে। বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তি কংগ্রেস থেকে সরে আসায় কংগ্রেস এখন একটি ছোট দলে পরিণত হয়েছে এবং ভারতে বামশক্তির উত্থান ঘটেনি। হিন্দত্ববাদের উত্থান ঘটেছে।

বাংলাদেশেও প্রায় একই ঘটনা ঘটতে চলেছে। আওয়ামী লীগে কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগিতায় একটি শক্তিশালী বাম অংশ ছিল, যার ফলে প্রথমে মোশতাকের নেতৃত্বে গঠিত এবং পরে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ডান অংশ সুবিধা করতে পারেনি। তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে দলের বাম অংশ সরকার গঠন করায় এবং তাতে সিপিবি এবং মোজাফফর ন্যাপ সমর্থন দেওয়ায় সহজেই ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুও তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখেন। দেশে নব্য ধনীদের লুটপাট বন্ধ করার জন্য তিনি কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের সহযোগিতা ও সম্মতিতেই বাকশাল গঠন করেছিলেন। এই বাকশাল আওয়ামী লীগ ভাঙেনি। ভেঙেছে সিপিবি এবং ন্যাপ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় আসেন, তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে তাঁর কাছে প্রথম দরখাস্ত করে পুনরুজ্জীবনের জন্য আবেদন জানানোর ব্যবস্থা করেন। সিপিবির সহযোগী মোজাফফর ন্যাপ প্রথমে বাকশাল ভেঙে পুনরুজ্জীবনের জন্য আবেদন জানায়। সিপিবিও বাকশালের ঐক্য বজায় না রেখে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য হাত মেলায়। আওয়ামী লীগ তখন বিধ্বস্ত এবং একলা হয়ে পড়ে।

শেখ হাসিনা যখন নেতৃত্বে আসেন, তখন আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ ডানপন্থীদের কবলে। জিয়াউর রহমান দেশে যে দুর্নীতিপরায়ণ নব্য ধনী দল সৃষ্টি করেছিলেন, তখন তাঁরা দলে দলে আওয়ামী লীগে ঢুকেছেন। শেখ হাসিনা যদি দলের নেত্রী না হতেন, তাহলে এই দল ও সরকারকে বহুদিন আগে ডানপন্থীরা সাম্রাজ্যবাদী শিবিরে ঢুকিয়ে ফেলতে পারত। দেশে ভয়াবহ রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হতো। কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে না গিয়ে কিংবা মহাজোটে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে ইন্দিরা গান্ধীর মতো আরো প্রগতিশীল পথে থাকার জন্য চাপ দিতে পারত। তারা সেই চাপ দেয়নি। অথবা শেখ হাসিনাকেও বিরোধিতা ছাড়া কোনো সহায়তা দেয়নি। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখনো কিছুটা আছে। হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে দেশে তালেবানি শাসন কায়েম হতো। সিপিবির বর্তমানে যে দুরবস্থা, বলতে গেলে সমগ্র বামশক্তির যে দুর্বল অবস্থান, তাতে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আওয়ামী লীগে না থাকলে দেশ বহুদিন আগে হিন্দুত্ববাদী ভারতের মতো মৌলবাদী বাংলাদেশে পরিণত হতো।

আওয়ামী লীগের ছয় দফা মুভমেন্টের প্রথম দিকে সিপিবি এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। বলেছে, এটা সিআইএর দলিল। পরে এসে ছয় দফার আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। দেশের কোনো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেই সিপিবি ছিল না। পরে বলেছে, ওটা ছিল তাদের ‘বৈজ্ঞানিক ভুল’ এবং তা স্বীকার করে ছয় দফার আন্দোলনে এসেছে এবং বঙ্গবন্ধুর জয়গানে দেশ মুখর করে তুলেছে। দেশ স্বাধীন হতেই কী হলো, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর আজীবন সদস্য পদের সনদ ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। এক দিন পরেই বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমা চান এবং বাকশালে যোগ দেন।

যা হোক, সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে যাওয়ার পর বাংলাদেশেও কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে যায়। তবে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমদের প্রশংসা করব। তাঁরা আগের শক্তিশালী সিপিবির ভাঙা অংশকে কমিউনিস্ট পার্টি নাম দিয়ে পরিচালনা করতে শুরু করেন। তাঁরা এরশাদবিরোধী বামদলীয় জোটে যোগ দেন এবং তাঁদের আওয়ামী লীগবিরোধী রেটোরিক (rhetoric) আওড়ানো শুরু হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিএনপি সরকারের শাসন উচ্ছেদ করার জন্য যখন সব বামপন্থী দল, এমনকি রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টিও তাতে যোগ দেয়, কিন্তু সিপিবি সেই মহাজোটে আসেনি। অতঃপর যত নির্বাচন হয়েছে, তাতে সিপিবি একটি আসনও পায়নি।

লেজ কাটা শিয়াল যেমন বাকি শিয়ালদের লেজ কাটার পরামর্শ দিয়েছিল, এবারের নির্বাচনেও তেমনি, লেজ কাটা সিপিবি সব লেজ কাটা বামপন্থী দল নিয়ে জোট গঠন করে দেশে বামপন্থী অভ্যুত্থানের ডাক দিয়েছে! দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে কিছুমাত্র জ্ঞান না থাকলে যা করা যায়, সিপিবি তা-ই করছে।

সাতের দশকে পশ্চিমবঙ্গে না হয় অত্যন্ত শক্তিশালী পাঁচটি বাম দল ও শ্রমিক ইউনিয়ন ছিল। তারা মিলিত হয়ে কংগ্রেস সরকারকে উত্খাত করে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গকে তারা ‘কমিউনিস্ট স্টেট’ বানাতে পারেনি। তারা কংগ্রেসের মতো একটি দুর্নীতিপরায়ণ সরকারে পরিণত হয়েছিল। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাই তাঁদের ‘পাঁচ দলের সরকারকে’ উত্খাত করতে পেরেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে বাম দল বলতে একটিও শক্তিশালী দল নেই। সিপিবির চেয়ে যেকোনো ডানপন্থী ক্ষুদ্র দলও শক্তিশালী। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকারকে উত্খাত করে তারা কি ক্ষমতায় যেতে পারবে? তারা ক্ষমতায় যেতে পারবে না। ভারতে কংগ্রেস শাসন উত্খাত করতে গিয়ে বামপন্থীরা যেমন ক্ষমতায় যেতে পারেনি, হিন্দুত্ববাদী শাসনের অভিশাপ ডেকে এনেছে, বাংলাদেশেও তা হতে পারে।

বিএনপি-জামায়াত জোটের পেছনে রয়েছে আফগানিস্তানের তালেবানদের সমর্থন। এখন আমেরিকার সমর্থনে বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীল জোট শক্তিশালী হচ্ছে। সব প্রগতিশীল দল নিয়ে বাংলাদেশে এখনো কোনো বিকল্প গণতান্ত্রিকবিরোধী দল গঠিত হয়নি। গঠিত হওয়ার পরিবেশও দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে কোনো বাম জোটই ক্ষমতায় যেতে পারবে না; বরং তালেবানদের জন্য ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সহজ করে দেবে। এ জন্যই বলি, সিপিবি নেতারা বাস্তববাদী হোন। দেশকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দেবেন না। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ফসল সাম্প্রদায়িক শক্তিকে লুট করে নিতে দেবেন না। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধুন। আওয়ামী লীগের ভেতরে যে ডান প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছে, তাদের দমন করুন। শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করুন। এটাই মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমদের কাছে আমার বিনীত নিবেদন।

লন্ডন, সোমবার, ২৮ ফেব্রুয়রি ২০২২

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ