বাবার চিকিৎসার জন্য খেলনা নিয়ে রাস্তায় শিশু রুহি

তারেক মাহামুদ:

বুধবার সময় বেলা ১১টা।রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্হিবিভাগের সামনে অগনিত মানুষের ঢল। নগরীর বিভিন্ন এলাকার মানুষ সেখানে উপস্থিত চিকিৎসা সেবা নিতে। ঠিক সে সময় বর্হিবিভাগের সামনের স্কুলের ইউনিফর্ম পরে রাস্তায় বসে আছে শিশু রুহি। ছোট্ট একটি পলিথিন পেতে তাতে বসে খেলনা, চিরুনি, মানিব্যাগ বিক্রি করছে সে। পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম।

 

খাতুনে জান্নাত রুহি। নগরীর কোর্ট এলাকায় অবস্থিত মিশন গার্লস স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সে।পরিবারের অভাব অনটন আর অসুস্থ বাবার চিকিৎসার টাকা যোগাড় করতে বসেছে নিত্য সামগ্রী বিক্রয়েরে উদ্যেশ্যে।

 

রুহির বাড়ি নগরীর হড়গ্রাম এলাকায়। বাবা রুবেল রানা দীর্ঘদিন ধরে প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। তাদের পরিবারটি প্রায় ধংসের মুখে। আয় উপার্জন ছাড়া চার সদস্যের পরিবারটির এমন অবস্থা দেখে তার মা জান্নাতুল ফেরদৌস একাই সংসারের দায়ভার নিয়েছেন। নগরীর বিভিন্ন ক্লিনিকে আয়ার কাজ করেন তিনি। কিন্তু তাতেও সংসারের খরচ মেটানো সম্ভব হয়না।তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই রুহিকে এই দোকান পরিচালনা করতে হচ্ছে।

 

রুহির সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন সকালে উঠে এসে পলিথিনের মাদুর বানিয়ে তাতে বসে দ্রব্য সামগ্রী বিক্রি করতে আসে। যেদিন স্কুলে যায় সেদিন তার মা এসে ঠিক সেখানেই বসে। শনিবার ও বৃহস্পতিবার সপ্তাহে দুদিন স্কুলে ক্লাস করে সে। তাও বৃহস্পতিবারে স্কুল শেষ করে তড়িঘড়ি করে তার নির্ধারিত স্থান,তার দোকানে এসে বসে। আর সে উপস্থিত হলে তার মা চলে যায় আপন কর্মস্থলে।

2-copy

রুহি জানায়, দীর্ঘ্ ১ মাস ধরে মায়ের চাকরি না থাকায় সংসারের চার জনের দায়ভার ও ছেলে মেয়ের পড়াশুনার খরচ বহন করতে হিমশিম খেতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে রুহিকে দোকানে বসতে হয়।

 

বুধবার সকালে রুহির স্কুলে পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষা দিয়েই আর দেরি না করে এসে মায়ের গোছানো দোকানে বসেছে সে। যতক্ষণ হাসপাতালে লোকজন থাকে ততক্ষণ তার দোকান চলে।

 

রুহি জানায়, তার ছোট ভাই ফেরদৌস হড়গ্রাম এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। মা কর্মস্থলে থাকায় পড়াশুনা ও দোকান বাদে রুহিকে ছোট ভাই ফেরদৌস ও বাবার দেখাশুনা করতে হয়।তাই সমসময় দোকান গোছাতে পারে না। রোজ সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ১ পর্যন্ত দোকান ব্যাবসা করে আর এ সময় বেচা বিক্রি ভালো হয়। কারণ হাসপাতালের এই সময় বিভিন্ন রোগীও মানুষ থাকে।

 

জানতে চাইলে রুহি এ প্রতিবেদককে বলে, আমি দুই দিন স্কুলে যাই।আর বাকি ৪ দিন এখানে একাই বসি। প্রথম অবস্থায় পার্কের দিকে দোকান নিয়ে বসতে চাইলে ঐ খানে বসতে দেয়া হয়নি।তাই নিরুপায় হয়ে হাসপাতালের সামনে বসি। প্রথম অবস্থায় এখানেও বসতে দিতো না। পরে এখানকার কিছু কর্মকর্তারকে অনুরোধ করলে তারা বসতে দিয়েছে।তবে পরিচালক আসলে উঠে যেতে হয়। সবাই প্রথম অবস্থায় পছন্দ না করলেও এখন সবাই ভালোবাসে।

 

রুহি জানায়, পরিবারের কিছু গোছানো টাকা থাকলেউ বাবার অসুস্থার জন্য ঐ টাকা দিয়ে বাবার ঔষুধ কিনতে হয় ও চিকিৎসা করাতে হয়।তাই পাশের বাড়ির এক আন্টির কাছে থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে দোকানের মালামাল কিনেছে সে।এখন প্রতিদিন দোকান থেকে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয়। আর এই টাকা দিয়েই প্রতি শুক্রবারে আন্টিকে ৩০০ টাকা করে ধারের টাকা শোধ করতে হয়।তবে বাবার অসুস্থ থাকায় কোন কোন সপ্তাহে টাকা দিতে না পারলেও আন্টি কিছু বলে না। এভাবে আমাদের সংসার চালানো অনেক কষ্ট হয়। বাবার জন্য প্রতিবন্ধী র্কাড করতে দিয়েছি তবে এখনো সেটি পায় নি।

 

অভাবের সংসার তবু নিজের ও ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ রুহিকেই বহন করতে হয়।সন্ধ্যা হলে ছোট ভাইকে পড়িয়ে নিজে পড়াশোনা শুরু করে সে। সহপাঠীরা বাইরে প্রাইভেট পড়লেও তার পড়ার মতো সামর্থ্য হয়না।

 

পড়াশোনায় বেশ ভালো রুহি। মনোযোগ সহকারে স্কুলের স্যার ম্যাডামদের কথা শুনে নিজের একান্ত চেষ্টায় সপ্তম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে সে। প্রাইভেট না পড়েও ভালো ফল আশা করে রুহি। তবে বিশেষ জটিল বিষয়গুলি স্যার ম্যাডামদের সাহায্য নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করে। পঞ্চম শ্রেণীর পিএসসি পরীক্ষাতে জিপিএ-৫ ছুটে যায় তার। তবে তার ইচ্ছা আরো ভালো ফলাফল করার।

 

ছোট্ট এই শিশুটি পরিবারের অভাব অনটনের কারণে আর অসুস্থ বাবার চিকিৎসার জন্য সে আজ রামেক হাসপাতালের সামনে খেলনা বিক্রি করছে। জানতে চাওয়া হয়েছিল রুহির কাছে তার ভবিষ্যতে কি হওয়ার ইচ্ছা আছে।রুহি জানায় ডাক্তার হয়ে এই হাসপাতলেই রোগীদের চিকিৎসা করবে রুহি।

 

স/আর