বাজেট যেন উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্ঘটনার কারণ না হয়!

২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার কর্তক ঘোষিত বাজেট নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক চলছে। এই বাজেটের পৃষ্ঠা সংখ্যা (মোট পৃষ্ঠা ১৫৩ যেখানে সিঙ্গাপুর ও ভারতে যথাত্রমে ৫১ ও ৫০) নিয়েও চলছে সমালোচনা। অনেকের অভিযোগ বাজেটের প্রথম অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার কথা আলোচিত হলো কেন? জাতীর পিতাকে নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা কেন? কেউ বলছেন ২০১৪ ও ২০১৫ সালের গোড়ার দিকে যে জ্বালাও পোড়াও হয়েছে তাও কেন বাজেটে আলোচিত হয়েছে? আমি এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চায়, মহান মুক্তিযুদ্ধে যাদের প্রাণের বিনিময়ে এবং যেসব মহান নেতার অসীম ত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো তাদের কথা আলোচনা হলে ক্ষতির কী আছে।

বরং তাদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোয় আমাদের গর্ব হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ সরকার কর্তক এবারে যে বাজেট পেশ করা হয়েছে তা একেবারে যে ‘নষ্ট বাজেট’ তা বলা যাবে না। বাজেটের দুটি অংশের মধ্যে একটি অংশে (অধ্যায় ৫-৮) ভবিষ্যৎ পকিল্পনা নিধারণ করা হয়েছে। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস অর্জনে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়েছে। সমাজিক নিরাপত্তা ও জনকল্যাণ জোরদাররের বিষয়ে গুরাত্বারোপ করা হয়েছে। শিক্ষা, মানব সম্পদ উন্নয়ন, বিদ্যুৎ-জ্বালনী উৎপাদন ও সঠিক ব্যহারের নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে নানামাত্রিক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজন অর্থ। অর্থ ছাড়া উন্নয়ন হয় না। অন্যদিকে সরকারী সেবা যেহেতু জনগণ নেবে সুতরাং অর্থও তাদের কাছ থেকে আসবে এটিই চিরাচরিত ব্যাপার। এলক্ষ্যে সরকার রাজস্ব উপার্জনের বিভিন্ন উৎস (অধ্যায় ৯-১০) সনাক্তকরণ ও লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বাজেটে রাজস্ব আহরণের সব নকশাই গণবিরোধী হয়েছে এমন কিন্তু আমরা কেউ বলতে পারি না। কেবল মূল্য সংযোজন কর (মূসক), সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানো ও ব্যাংক হিসাবে আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি এসব নিয়ে সরকার ও জনগণের মধ্যে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়িত হতে যাওয়া মূসক আইনের বাস্তবায়ন নিঃসন্দেহে সরকারের একটি সাহসী পদক্ষেপ। আবার বেশী করদাতা পরিবারকে ‘কর বাহাদুর’ উপাধিও দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
এখন আসছি বাজেটের কিছু দুর্বল দিকের আলোচনা নিয়ে। একসময় সমতার ভিত্তিতে বাজেট পেশ করা ছিল জরুরী বিষর। এর মানে হলো প্রস্তাবিত বাজেটে আয় ও ব্যয় সমান হবে। এ ধারণামতে তখন ঘাটতি বাজেটের কোন স্থান ছিলো না। কিন্তু সরকারের উন্নয়নের কর্মকান্ডের পরিসর বেড়ে যাবার কারণে এধারণা এখন পাল্টে গেছে। মানুষের কর্মযজ্ঞকে এবং দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে গতিশীল করতে এখন ঘাটতি বাজেটের ধারণা প্রবর্তিত হয়েছে। পৃথিবীর অনেক অর্থনীতিবীদগণ এখন এই ধারণার পক্ষে। বাংলাদেশের বে-সরকারী গবেষণা সংস্থা সিপিডির মতে, বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের সমন্বয় ঘটানো জরুরী। সেগুলো গচ্ছে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, অর্থনৈতিক নেতৃত্ব ও সামাজিক সমর্থন। এখন দেখা যাক এসব শর্তের কতুটকু বাজেটে সমন্বয় হয়েছে।

এবারে বাংলাদেশে ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরের জন্য বাজেট পেশ করবার পর এ সংক্রান্ত তিনটি পক্ষ হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে এক. দেশের অর্থনীতিবীদ, সুশীল সমাজ, এবং গণমাধ্যম কর্মী যাঁরা নিয়েছেন জনগণের পক্ষ। এটিই বোধ হয় শাশ্বত পথ। দুই. সরকার নিয়েছে ঘোষিত বাজেটের পক্ষ। তিন. ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগ ভিন্ন অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা  নিয়েছেন ব্যবসা ও রাজনৈতিক পক্ষ। কোন পক্ষ বলছেন এবারের বাজেট গণবিরোধী। কেউ অবার বলছেন এটি মানুষ মারার বাজেট।

ব্যবসায়ীরা বলছেন এই বাজেট ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংসের অস্ত্র ইত্যাদি। কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা এটি প্রতিহতের হুমকিও দিয়েছিলেন। তবে বাজেট প্রণেতা অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এই বাজেট আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট। আসলে কোন পক্ষের যুক্তি সঠিক তা আলোচনা করলে সবার মনে স্পষ্ট ধারণা জন্মাবে। এ মর্মে বলে রাখতে চাই যে, প্রাক বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রী মহোদয় বিভিন্ন অংশিজনদের সাথে যে আলোচনা করে বাজেট প্রণয়নের যেসমস্ত সুপারিশ পেয়েছিলেন তা চূড়ান্ত বাজেটের সাথে সংযুক্তি হিসেবে লাগিয়ে দিলে জনগণ বুঝতে পারবে প্রস্তাবিত বাজেটে তাদের আশা আকাঙ্খার কতুটুকু প্রতিফলন ঘটেছে। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা বাড়বে।  সরকার ও জনগণের মধ্যে টানাপোড়েন কমবে।
বাজেটের রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের মানুষ মানে এক একটি টাকার গাছ। সরকার হলো এই টাকার গাছের ব্যবহারকারী। বলা চলে (দক্ষতার অভাব ও দুনীতির কারণে) অপব্যবহারকারী। টাকার এই গাছের এমন নৃশংস ব্যবহারের ফলে যদি ওই গাছের শিকড়-বাঁকড় উপড়ে যায় তবুও সরকারের ক্ষতি নেই। বরং এতে সরকারের কর্মকর্তাদের শরীরে শর্করা, মেদ ভুড়ি বাড়বে। এসব কথার মর্মার্থ বুঝা যায় যখন ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরের বাজেটে আয়করের তুলনায় মূসক থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষমাত্রা বেশী সূচক নির্দেশ করে।

কেননা আয় কর দেয় ধনীরা। আর মূসক দেয় সব শ্রেণীর মানুষ। মূসক ব্যবসায়ীদের ওপর আরোপ করা হলেও ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত তা দেশের ধনী-গরীব সর্বস্তরের মানুষের ঘাড়েই ফেলে দেয়। ধনী ব্যবসায়ীরা মূসকের মতো করের বোঝা গরীবদের ওপর স্থানান্তর করতে সক্ষম হলেও সাধারণ ভোক্তা বা গরীবদের এমন করার ক্ষমতা নেই । সুতরাং তারাই আসল ভুক্তভোগী।
জনগণের করের টাকায় জনগণের জীবনমান উন্নয়ন হবে এটিই বাজেটের দর্শন হওয়া উচিত। সরকারকে কর দিয়ে জনগণ আবার নিজের কাছে ঋণী হবে এমন তো হতে পারে না। ব্যাংক লুট, বিদেশের অর্থ পাচার, রাজস্ব ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সীমাহীন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারী প্রতিষ্ঠানের অনবরত লোকসান, জাতীয় ও স্থানীয় দুর্নীতি আজ নির্দেশ করে যে জনগণ কর দিবে আর সাহেবরা তার অপব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার ঋণের বোঝা জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিবে।

এমন যদি হয় তবে সরকারকে মনে রাখতে হবে, সবশেষে ক্ষমতা কিন্তু জনগণেরই হাতে। বেকারত্ব, বিনিয়োগের নি¤œমুখী হার, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি সরকারের উন্নয়নের মহাসড়কে জগদ্দল পাথর হয়ে বসে পড়বে। উন্নয়নের কাল্পনিক মহাসড়কে মহাদুর্ঘটনা ঘাটাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। করের বোঝার বাজেট উন্নয়নের মহাসড়ককে আন্তর্জাতিক রুটে সংযোগ ঘটানোর আগেই মহাদুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

ক্ষতার মসনদ বিকলাঙ্গ করে চার দেয়ালের ঘরের মধ্যে লিথারজিক অবস্থায় বসিয়ে দিবে। উন্নয়নের মহাসড়কের দুর্বার গতির যানকে ছিনিয়ে নিয়ে পেছনে হুইল চেয়ার ধরিয়ে দিবে। এটি সময়ের ব্যাপর মাত্র। তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলের মনে রাখতে হবে যে, খাবার মানুষের শরীরে একইসাথে পুষ্টি ও বেঁচে থাকবার শক্তি যোগায়। কিন্তু যেন-তেন খাদ্য একসাথে বেশী পরিমান গ্রহণ করলে তা বদহজমে পরিণত হয়। পেটের স্বাভাবিক ক্রিয়া নষ্ট করে মহাবিপর্যয় তৈরী করে।
বাজেটের দলিলে কী লিখা আছে না আছে তা মানুষ তেমন জানতে পারে না। তারা জানতে পারে যখন করের বোঝা টানতে হয় তখন। তবে বাজেটের তথ্য মানুষকে জানানোর ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন দেশের গণমাধ্যম কর্মীরা। অর্থনীতিবীদগণ তাতে রসদ জোগাচ্ছেন। নানামাত্রিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাঁরা বাজেটের বাস্তবতা নিরূপণ করছেন। সরকারকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। সরকার যদি এসব পরামর্শে নজর না দেন তবে তাদের জন্য বিপদ আসন্ন। পৃথিবীর বেশীর ভাগ অর্থনৈতিক তত্ত্ব সাধারণত উন্নত অর্থনৈতিক সংস্কৃতির আলোকে গড়ে উঠেছে। তাই কোন নতুন ত্তত্ব নেবার সময় তর্ক-বিতর্ক থাকবে না এমন ভাবার কারণ নেই।

তর্ক-বিতর্ক দ্বারা যুক্তিকরণ না করে কোন করনীতিও সরকারের গ্রহণ করা উচিত নয়। যেমন বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারি, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিলো। কিন্তু এই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারই এখন পৃবিীর ‘উন্নয়নের বিষ্ময় ও রোল মডেল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এই নির্বাচনের সমালোচনা ছিলো বলেই এমনটা সম্ভব হয়েছে। অন্যথায় হয়তো পৃথিবীতে আমাদের দেশের এমন স্বীকৃতি হতো না। সুতরাং আলোচনা-সমালোচনা শেষে বাজেটে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফল হোক এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: মো. আবদুল কুদ্দুস/ শিক্ষক, বিজনেস স্টাডিজ বিভাগ ও সহকারী প্রক্টর
নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী