বাঘার সেই পাখির বাসার জমি কিনে নিবে সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার খোর্দ্দ বাউসা গ্রাম। হাজারো শামুকখোলের বাস যেখানে । দীর্ঘ তিন বছর থেকে শামুকখোল পাখিরা তাদের আবাস গড়ে তুলেছে গ্রামের একটি বাগানে। এখন চলছে তাদের প্রজননের সময়। আর এমন সময়ে বাগান মালিকের অসন্তোষ জন্মে। কারণ এই মৌসুমে বাগানে কীটনাশক প্রয়োগ করার উপযুক্ত সময়।

গাছের ওপর বাসা বাঁধায় আম বাগান পরিচর্যা করতে পারছিলেন না আতাউর রহমান। ভাঙতে শুরু করেছিলেন সেই বাসা। তবে পাখিপ্রেমীদের বাধায় শেষ পর্যন্ত পাখিদের বাসা ভাঙতে পারেননি তিনি। তাই বাসা খালি করে দেওয়ার জন্য ১৫ দিনের নোটিশ দিয়েছিলেন পাখিদের। এরপর আর কি? ঘটনা গড়ায় উচ্চ আদালত পর্যন্ত। সম্প্রতি পাখিদের বাসা ভাড়া হিসেবে বছরে ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা বরাদ্দ চেয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠায় জেলা প্রশাসন।

তবে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাসা ভাড়া নয় পাখিদের জন্য স্থায়ী আবাস তৈরি করতে ওই আমবাগানসহ সংশ্লিষ্ট জমিটিই অধিগ্রহণ করে কিনে নিতে চায় মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবনাটি আপাতত মৌখিকভাবে দেওয়া হলেও আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই এ সংক্রান্ত একটি চিঠি রাজশাহী জেলা প্রশাসকের দফতরে পাঠানো হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানানো হয়েছে। তাই এখন এর সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখা হচ্ছে।

যদিও এই পাখিগুলো প্রতিবছর একই গাছে বা একই বাগানে বাসা বাঁধে না বলে জানিয়েছেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান। তিনি বলেন, এই পাখিরা প্রতি বছর একই গাছে বাসা বাঁধে না। চার বছর আগে এই গ্রামের আমবাগানে এসেছে। আগামী বছর আবার অন্য কোথাও চলে যেতে পারে।

এজন্য বাগানটি পাখিদের অভয়ারণ্য ঘোষণা করা ঠিক হবে কিনা সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। কারণ এর আগে পাখিরা বাঘার পার্শ্ববর্তী পুঠিয়া উপজেলার ভাল্লুকগাছি ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রামের আবদুল হামিদ মাস্টারের আমবাগানে বাসা বেঁধেছিল বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

রাজশাহী জেলা প্রশাসক হামিদুল হক বলেন, পাখির বাসা ভাড়া দেওয়ার জন্য বছরে ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা চেয়ে তিনি মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। গত ৫ নভেম্বর এই প্রস্তাবনাটি পাঠানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ নভেম্বর কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে রাজশাহী জেলা প্রশাসককে মৌখিকভাবে পাখিদের জন্য ওই জমিটিই অধিগ্রহণের পাল্টা প্রস্তাব দেওয়া হয়।

জেলা প্রশাসক বলেন, স্থায়ী অভয়ারণ্য করা গেলে পাখিরা আর অন্য কোথাও যাবে না। পাখিদের স্থায়ী আবাস তৈরি করা হলে তাদের কেউ বিরক্তও করবে না। তাই এজন্য এর সম্ভাব্যতা যাচাই বাছাই ও প্রস্তাবনা তৈরির কাজ চলছে।

পাখিদের স্থায়ী আবাসনের জন্য আমবাগানসহ অন্তত ১০ বিঘা জমি অধিগ্রহণের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই এই জমি অধিগ্রহণ প্রস্তাবের চিঠি মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানোর কথা রয়েছে।

এর আগে বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহীন রেজার নেতৃত্বে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বাগানে গিয়ে দেখেন, মোট ৩৮টি আমগাছে বাসা বেঁধেছে শামুকখোল পাখিগুলো। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলার পর তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করেন।

জরিপ শেষে ওই আমগাছগুলো থেকে বছরের সম্ভাব্য আম উৎপাদন ও তার সম্ভাব্য দাম নিরূপণ করেন। তাদের হিসাব অনুযায়ী বছরে ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা ক্ষতি হতে পারে বাগান মালিক বা ইজারাদারের। ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের পর তারা রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন দেন। নিরীক্ষণের পর প্রস্তাবনাসহ সেই প্রতিবেদন কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠান জেলা প্রশাসক।

এদিকে, মানুষের ভালোবাসা আর নিরাপত্তা পাওয়ার পর সেই শামুকখোল পাখিগুলো এখন স্বাচ্ছন্দ্যেই দিন কাটাচ্ছে। ‘স্থায়ী নীড়’ পাওয়ার আনন্দে মুক্তমনে কয়েকশ বাচ্চা নিয়ে ডানা ঝাপটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবুজ গাছগাছালি আর বাতাসের সঙ্গেই যেন তাদের মিতালী।

তাদের কলকাকলিতে বদলে গেছে সবুজে ঘেরা ওই গ্রামটির প্রাকৃতিক আবহ। বদলে গেছে গ্রামের নামও। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার প্রত্যন্ত খোর্দ্দ বাউসা গ্রাম এখন নতুন করে ‘পাখির গ্রাম’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। ছুটির দিনসহ প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে পাখিপ্রেমী মানুষ ও সাধারণ দর্শনার্থীরা ছুটে যাচ্ছেন ওই গ্রামে।

গত চার বছর ধরে শামুকখোল পাখিগুলো এই আমবাগানে বাসা বেঁধে আছে। বর্ষার শেষে এসে তারা এই বাগানে বাচ্চা ফুটিয়েছে। বাচ্চাগুলো উড়তে শিখলে শীতের শুরুতে এরা আবার চলে যায়। তবে এখন প্রায় সারা বছরই থাকে। এখন পাখিগুলোর সুরক্ষায় দায়িত্ব নিচ্ছে সরকার।

এবছর ইজারাদার আতাউর রহমান আম উৎপাদনের জন্য বাগানের পরিচর্যা করতে চেয়েছিলেন। গত ২৯ অক্টোবর তিনি বাসা ভেঙে আমগাছ খালি করতে শুরু করেন। একটি গাছে থাকা কিছু বাসা ভেঙেও দেন। তবে স্থানীয় কিছু পাখিপ্রেমী তাকে বাসা ভাঙতে বাধা দেন। পরে তাদের কারণে আমবাগান ইজারাদার পাখিদের বাসা ছাড়ার জন্য ১৫ দিন সময় বেঁধে দেন। এর মধ্যে পাখিরা বাসা না ছাড়লে তাদের বাসা ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেন ইজারাদার।

এ সংক্রান্ত খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর পাখির আবাসস্থল রক্ষার উদ্যোগ নেয় রাজশাহী জেলা প্রশাসন। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গত ৩০ অক্টোবর বাঘার খোর্দ্দ বাউসা গ্রামের ওই আমবাগান পরিদর্শনে যান। তারা পাখিদের বাসা ভাঙা যাবে না বলে জানান।

এছাড়া মহাপরিচালকের নির্দেশে একই দিন ঘটনাস্থলে যান র‌্যাব-৫ এর অধিনায়ক মাহফুজুর রহমান। এসময় বাগানে থাকা পাখির বাসা ভাঙা যাবে না এবং এখন থেকে র‌্যাব বাগানটি পর্যবেক্ষণ করবে বলেও জানান। এরইমধ্যে বিষয়টি উচ্চ আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রজ্ঞা পারুমিতা রায়। এরপর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে আদেশ দেন।

খোর্দ্দ বাউসা গ্রামকে কেন অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চান হাইকোর্ট। পাশাপাশি অভয়ারণ্য ঘোষণা করলে ওই আমবাগান ইজারাদারদের কী পরিমাণ ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে তা ৪০ দিনের মধ্যে জানাতে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক ও বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরপরই জরিপ চালিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে রাজশাহী জেলা প্রশাসন।