বাগমারা প্রতিনিধি: রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় সম্প্রতি আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি দেখা দিয়েছে। এতে জনমনে চরম উদ্বেগ বেড়ে গেছে। এসব ঘটনায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর চরম অবহেলা ও গাফিলতির কারণে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পূর্ব শত্রতার জের ধরে পান বরজে অগ্নি সংযোগ, স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন, সৎ মায়ের হাতে শিশু সন্তান হত্যা সহ প্রতিনিয়ত ধর্ষন, চুরি, মাদকের বিস্তার,হামলা, ভাংচুর, সংঘর্ষ, ও জমি দখলসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ড সংঘটিত হচ্ছে। এতে জনমনে চরম আতংক ও উৎকন্ঠা বিরাজ করছে।
বাগমারা থানার দেওয়া তথ্য মতে, বাগমারায় দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে গত দু’দিনে ৩ কৃষকের পান বরজ পুড়ে ভষ্মীভূত হয়ে গেছে। গত বুধবার রাতের পর আবারো গনিপুর এলাকায় মকছেদ আলী নামের এক কৃষকের পান বরজ পুর্ব শত্রুতার জের ধরে আগুন পুড়িয়েছে প্রতিপক্ষরা। এ নিয়ে এলাকায় পান বরজ চাষিরা আগুন আতঙ্কে রয়েছেন।
গত বুধবার দিবাগত রাতে ওই এলাকায় পূর্বশত্রুতার জের ধরে আয়েন উদ্দীন নামের এক কৃষকের পান বরজে আগুন দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সময় কৃষকের পান বরজের পাশে আরো একটি পান বরজ পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে গেছে। এতে করে আয়েন উদ্দীনের প্রায় ৪ লক্ষ ও পাশের পান বরজ কৃষক সাইদের ২ লক্ষ টাকার ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
এর পর আবারো বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে একই ইউনিয়নের বাসুবোয়ালিয়া গ্রামে মকছেদ আলী নামের কৃষকের পান বরজে পূর্বশত্রুতার জের ধরে প্রতিপক্ষ আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে করে মকছেদ আলী ১ বিঘা জমিতে থাকা পানের বরজ পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। আগুনে পান বরজ পুড়ে গিয়ে প্রায় ৭ লাখ টাকার ক্ষতি সাধিত হয়েছে। পানবরজ ভস্মীভূত ঘটনায় এলাকায় হা-হা-কার রুপ ধারণ করেছে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার বাগমারায় এক শিশুর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। ওই শিশুর নাম মারুফ হাসান (৭)। সে উপজেলার শুভডাঙ্গা ইউনিয়নের বিনোদপুর গ্রামের শাহজাহান আলীর ছেলে। মৃত্যু বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার বাবা, দুই চাচা ও সৎ মাকে থানায় নেওয়া হয়েছে।
পুলিশ ও এলাকা সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার সকালে শিশু মারুফ হাসানকে বাড়িতে সৎমায়ের কাছে রেখে তার বাবা শাহজাহান আলী কাজের জন্য বাইরে যান। পরে নির্জন ঘরে শিশুটিকে নিয়ে গিয়ে সৎ মা মুক্তা বেগম তাকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে বলে প্রতিবেশিরা জানান। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে মা মারুফা বেগমও বাবার বাড়ি থেকে ছুটে আসেন। ছেলেকে মেরে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এমন অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে শিশুর লাশের সুরাতহাল প্রতিবেদন প্রস্তত করে। ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।
এর আগে গত ২২ এপ্রিল প্রতিপক্ষরা হামলা চালিয়ে স্কুল ছাত্র ছেলের সামনেই পিতাকে কুপিয়ে খুন করে বীরদর্পে চলে যেতে সক্ষম হয়। জানা গেছে ওই দিন বিকেলে গনিপুর ইউনিয়নের মাধাইমুড়ি গ্রামের কৃষক হাবিল কাজী (৪৪) পানবরজের কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিল। সাথে ছিল তার স্কুল পড়ুয়া ছেলে শওকত হোসেন (১৪)।
এ সময় প্রতিপক্ষরা জমি সংক্রান্ত পূর্ব শত্রুতার জের ধরে হাবিল কাজীর উপর হামলা করে তাকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা নিশ্চিত করে বীরদর্পে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে হামলাকারীরা। ওই ঘটনায় নারী সহ আরো ১০ দশ মারাত্বক আহত হলে তাদেরকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়।
এই ঘটনার আরো দুই দিন আগে টিপু সুলতান (২৮) নামে এক পান ব্যবসায়ীক তুলে যায় দুর্বত্তরা। প্লাস দিয়ে টিপুর হাত ও পায়ের নখ তুলে ফেলে এবং টিপুর কাছে থাকা তিন লক্ষ টাকা ছিনিয়ে নেয়। ওই ঘটনায় টিপু বাগমারা থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করে। পরে ওই ঘটনায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে পুলিশ পান ব্যবসায়ী টিপুর এজাহার আমলে নিয়ে পাঁচ আসামীকে গ্রেফতার করে।
এর কিছু দিন আগে উপডজেলা বিহানলী এলাকার বিলসৌতি বিল এলাকায় বিলের দখল ও মাছ চাষ নিয়ে প্রতিপক্ষরা অ্যাকসন, আ্যাকসন বলে সাবেক ইউপি সদস্য আজাহার আলীর ৫টি সেচ যন্ত্রে অগ্নিসংযোগ করে তা পুড়িয়ে দেয়া হয়। এরও একদিন আগে পূর্বশত্রতার জের ধরে গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের সমসপাড়া গ্রামে আনিছুর রহমান (৪২) নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে মারাত্বক জখম করে প্রতিপক্ষরা। পরে প্রতিবেশিরা তাকে উদ্ধার করে বাগমারা মেডিকেলে নিয়ে গেলে সেখানে তার অবস্থার অবনিত হলে আনিছুর করে রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে ভর্তি করা হয়। এখনও তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ঘটনায় আনিছারের মা ফাতেমা বেগম বাদী হয়ে ছেলেকে হত্যা চেষ্টায় বাগমারা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
সর্বশেষ গত ২৯ এপ্রিল ভালোবেসে বিয়ে করে মাত্র দেড় মাসের মাথায় পাষন্ড স্বামীর হাতে খুন হন গৃহবধু সাবিনা থাতুন(২৩)। এই ঘটনায় পুলিশ লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠিয়েছে এবং হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার সন্দেহে স্বামী সোহাগ হোসেন(১৮) ও শাশুড়ি রুপালী বেগম(৩৫) কে আটক করেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার চানপাড়া গ্রামের কলেজ পড়ুয়া সোহাগ হোসেন(১৮) সাথে মাঝগ্রামের স্বামী পরিত্যাক্তা নারী সাবিনা ইয়াসমীনের মুঠোফোনের মাধ্যমে পরিচয় ও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গত দেড় মাস আগে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
প্রতিবেশিরা জানান, গত শুক্রবার রাতে সেহরী খাওয়ার সময় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে তিব্র বাকবিতন্ডা হয়। পরে সকালে প্রতিবেশিরা গৃহবধু সাবিনা খাতুনের মৃত্যু হয়েছে জানতে পারেন। এই ঘটনায় গৃহবধুর মা ছামেনা বিবি অভিযোগ করেন , স্বামী ও শাশুড়ী তার মেয়েকে গলা টিপে হত্যা করেছে। বিয়ের পর থেকে তারা তাকে মেনে নিতে পারেনি। এই ঘটনায় ছামেনা বিবি বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
এদিকে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সোনাডাঙ্গা ইউপি’র চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আজাহারুল হক, যোগিপাড়া ইউপি’র কামাল হোসেন, গোবিন্দপাড়া ইউপি’র চেয়ারম্যান বিজন সরকার, নরদাশ ইউপি’র চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন, গনিপুর ইউপি’র চেয়ারম্যান এ্যাড. মনিরুজ্জামান রঞ্জু ও একই ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ অভিযোগ করে বলেন, সম্প্রতি বাগমারায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়তই বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ড সংঘটিত হচ্ছে।
অথচ এসব অনাকাঙ্খিত ঘটনার কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। এলাকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখার স্বার্থে পুলিশ প্রশাসনের আরো দায়িত্বশীল ভুমিকা পালন করা প্রয়োজন বলে বাগমারা উপজেলা চেয়ারম্যান অনিল কুমার সরকার দাবি করেন।
তিনি বলেন, এই সমস্ত বিষয় গুলো মাননীয় এমপি সাহেবকে প্রতিনিয়ত অবহিত করা হচ্ছে। তিনিও বিষয়গুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আগামী ৭ মে তিনি বাগমারায় আসবেন । তখন এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে এবং সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাক আহম্মেদ বলেন, ১৬টি ইউনিয়ন ও দুইটি পৌরসভার সমন্বয়ে গঠিত এ উপজেলায় সাড়ে চার লক্ষাধিক লোকের বাস। বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রন করতে পুলিশকে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হয়। কাজেই এখানে বিচ্ছিন্নভাবে দুই-একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটতে পারে। এই করোন মহামারিতেও পুলিশ এসব অনাকাঙ্খিত ঘটনা নিয়ন্ত্রনে দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাগমারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শরিফ আহম্মেদ জানান, সার্বিক ভাবে আমাদের সামাজিক নানান ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে অবক্ষয় ঘটেছে। তুচ্ছ কারণে পানবরজে অগ্নিকান্ড এটাই তার প্রমান। এসব থেকে উত্তোরণের জন্য আমাদের আরো ভুমিকা নিতে হবে। জেলা প্রশাসনকে বিষয়গুলো অবগত করা হয়েছে। দ্রুত আমরা এসব অনাকাঙ্খিত ঘটনা নিয়ন্ত্রনে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।