বাকি আরও দুই গ্যাসকূপ খনন, বিদায় নিচ্ছে ‘সকার’

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করে অবশেষে বিদায় নিতে যাচ্ছে আজারবাইজানের গ্যাস উত্তোলন কোম্পানি ‘সকার’ (স্টেট অয়েল কর্পোরেশন অব আজারবাইজান)।

সম্প্রতি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানিকে (বাপেক্স) দেয়া এক চিঠিতে বাকি দুটি কূপ খনন না করে তাদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করার কথা জানিয়েছে। এতে দেশের পিছিয়ে পড়া নিজস্ব গ্যাস আহরণের কার্যক্রম আরও একধাপ পেছাবে বলে শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

বাপেক্সের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী তিনটি কূপ খননের কথা ছিল সকারের। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সময় ব্যয় করে তারা মাত্র একটি কূপ (খাগড়াছড়ির সেমুতাং গ্যাসক্ষেত্র) খনন করেছে। সেখানে তারা কোনো ধরনের গ্যাসের সন্ধান পায়নি।

এরপর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ এবং জামালপুরের মাদারগঞ্জে কূপ খননের জন্য কোম্পানিটি চুক্তিবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই দুটি কূপ খনন না করেই চুক্তি বাতিলের জন্য সরকারকে চিঠি দিয়েছে কোম্পানিটি। চুক্তি বাতিল করার আবেদনে কারণ হিসেবে বিল পরিশোধে বিলম্বের অজুহাত দেখিয়েছে ‘সকার’।

কিন্তু বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, এটি নিছক অজুহাত। সরকারি প্রক্রিয়ার কারণে অনেক কোম্পানির বিল পরিশোধে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিলম্ব হতে পারে। সেটা দু’পক্ষই বোঝে এবং সমঝোতার মাধ্যমে কাজ করে।

‘সকার’ আসলে কাজটি করতে চায় না বলেই অজুহাত খাড়া করেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল হান্নান বিল পরিশোধে কিছুটা বিলম্বের কথা স্বীকার করে সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, সেমুতাং কূপের জন্য সকারকে ১১০ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে।

কিন্তু বেগমগঞ্জ কূপটি খননের প্রস্তুতিমূলক কিছু কাজের জন্য সকার আরও ৫০ কোটি ডলার দাবি করেছে। এখন আলোচনার বিষয় সেটি।

বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, সকার কাজ করতে না চাওয়ার ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা পুষিয়ে নেয়ার জন্য মাদারগঞ্জে বাপেক্সই কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে। বেগমগঞ্জ কূপের বিষয়েও শিগগির সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, কোনো ধরনের কারণ ছাড়াই এতদিন পর হঠাৎ করে সকারের এ সিদ্ধান্তে দেশের জ্বালানি সেক্টরে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

তাদের অভিমত, বর্তমান সরকার উত্তোলনযোগ্য ও বিদ্যমান প্রাকৃতিক গ্যাস এবং আমদানি করা এলএনজির কথা মাথায় রেখে দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিকে সাজিয়েছে। তৈরি করেছে রূপকল্প। সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলেছে। কিন্তু এ অবস্থায় সকারের এ সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

জানা গেছে, কয়েক বছর আগে ‘সকার’ যখন বাপেক্সকে তিনটি কূপ খননের প্রস্তাব দেয় তখন এ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি কোনো কোনো মহলে ব্যাপক ইতিবাচক ও নেতিবাচক আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল।

এর একমাত্র কারণ ছিল দেশে কর্মরত অন্য বিদেশি কোম্পানির তুলনায় সকারের চুক্তিমূল্য ছিল দৃশ্যত অনেক কম। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অন্য বিদেশি কোম্পানি যেখানে প্রতিটি কূপের জন্য গড়ে ১৬০ কোটি (১৬ মিলিয়ন) ডলার দাম দিয়েছে সেখানে সকার দাম দিয়েছিল মাত্র ১১০ কোটি (১১ মিলিয়ন) ডলার।

কিন্তু ওই দামে যখন বাপেক্স সকারের সঙ্গে চুক্তি করে, তখন অভিজ্ঞ মহলের অনেকে বলেছিলেন এ দামে কোনো বিদেশি কোম্পানির পক্ষে কূপ খনন করা সম্ভব হবে না। এতে সকারকে বড় ধরনের লোকসান গুনতে হবে। অন্যথায় কাজ ফেলে চলে যাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রথম কূপ খননের পর সকারকে বড় ধরনের লোকসান গুনতে হয়েছে। এরপর তারা নানাভাবে চেষ্টা-তদবির করেছিল চুক্তিবদ্ধ দ্বিতীয় ও তৃতীয় কূপ খনন ব্যয় যথাক্রমে ১৫০ ও ১৬০ কোটি ডলার করার।

কিন্তু এতে সরকার রাজি হয়নি। এ ছাড়া প্রথম কূপ খননের কার্যক্রম দেখে এবং গ্যাস না পাওয়ায় খোদ জ্বালানি বিভাগেরই একটি পক্ষ চাচ্ছিল না সকার বাকি দুটি কূপ খনন করুক।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চুক্তি বাতিল করে চলে যাওয়ার আগে সকার বেগমগঞ্জ কূপের প্রস্তুতিমূলক কাজের জন্য যে ব্যয় দাবি করেছে, তার কতটা তাদের প্রাপ্য তা অবশ্যই হিসাব-নিকাশ করে দেখতে হবে। তাছাড়া, সেমুতাং কূপটি খননের জন্য তাদের সময় নির্ধারিত ছিল ১২০ দিন।

কিন্তু তারা লাগিয়েছে প্রায় ২৫০ দিন। কূপ খননের জন্য প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতিও তারা সরবরাহ করতে পারেনি। খনন যন্ত্রের (রিগ) ‘টপ ড্রাইভ’সহ কিছু কিছু অপরিহার্য যন্ত্রপাতি বাপেক্স তাদের সরবরাহ করেছে।

যেগুলোর ভাড়া সকারকে দিতে হবে। এখন এসব বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেনা-পাওনার হিসাব চূড়ান্ত করতে হবে।

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, সেমুতাং একটি চলমান গ্যাসক্ষেত্র। সেখানে অন্য কূপ থেকে গ্যাস তোলা হচ্ছে। এ রকম একটি ক্ষেত্রে কূপ খনন করে গ্যাস না পাওয়ার ঘটনা প্রায় অস্বাভাবিক।

তা সত্ত্বেও কেন গ্যাস পাওয়া গেল না, এ ক্ষেত্রে কোম্পানিটির কাজে কোনো কারিগরি ত্রুটি ছিল কি না- এসবও খতিয়ে দেখতে হবে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তারা জানতে পেরেছেন গ্যাস থাকার পরও কূপ খননে ভুল থাকায় এবং কূপের যেসব স্থান থেকে গ্যাস বেরোবে, সেসব স্থান খননের সময় বন্ধ হয়ে যাওয়া সেমুতাং থেকে ‘সকার’ গ্যাস উত্তোলন করতে পারেনি।

এদিকে ওয়েবসাইটে সকারের কার্যক্রম সম্পর্কে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কূপ খননকাজে কোম্পানিটির রেকর্ড তেমন ভালো নয়। কাসপিয়ান সাগরে কূপ খনন করতে গিয়ে তিন বছরে (২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬) সকার পাঁচটি দুর্ঘটনা (ব্লো-আউট) ঘটিয়েছে। এতে তাদের কয়েকজন কর্মী মারা গেছেন এবং অনেকে আহত হয়েছেন।