বাংলা গালির ব্যুৎপত্তি-ব্যাকরণ

আমরা যে একটি ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের অধিবাসী এবং সত্যিকার অর্থেই সংস্কৃতিপ্রবণ জাতি তার প্রমাণস্বরূপ অনেক সূচক রয়েছে। এখানে সেসবের যে একটিকে তুলে ধরব, তার দিকে খেয়াল করলে বিস্মিত ও আনন্দিত না হয়ে পারা যায় না। আমাদের রক্তস্নাত বাংলা ভাষার ভিত্তি যে কত বনেদি, এর দৃঢ় শিকড় যে কতটা গভীরে প্রথিত, তা তার অপরিশীলিত শব্দভাণ্ডারের বিপুলতার দিকে দৃকপাত করলে সহজেই অনুমান করা যায়। এই অপরিশীলিত বা অশ্লীল শব্দগুলো সমাজ চলতি গালাগাল, খিস্তি-খেউড়ের সঙ্গে সম্পর্কিত।

ভাষা বাস্তবতায় যাবতীয় অকথ্য শব্দ তাই বাঙালির মনোভাব প্রকাশের বাহন হিসেবে অলঙ্ঘনীয় অবলম্বন। বাংলা ভাষা এতটাই সমৃদ্ধ যে অশালীন শব্দ বা গালিগালাজ মূল্যায়ক বাগধারা বা লোকশ্লোকও আমাদের সাহিত্যে লক্ষ্য করা যায়। যেমন—এক দেশের বুলি/আরেক দেশের গালি। এখানে দেশ বলতে ‘অঞ্চল’ বা ‘জনপদ’কে বোঝানো হয়েছে। আমরা যেমন গ্রামের বাড়িকে ‘দেশের বাড়ি’ বলে থাকি। গালি বা ভব্য ভাষা শব্দ, ভালো বা মন্দ, পাপ বা পুণ্য বিশ্লেষণে আমাদের অন্যতম প্রধান বাউল দার্শনিক লালন ফকিরের গানের বাণী এই রকম—‘এই দেশে যা পাপ গণ্য, অন্য দেশে পুণ্য তা-ই/পাপ-পুণ্যের কথা আমি, কাহারে সুধাই/… দেশ সমস্যা অনুসারে, ভিন্ন বিধান হতে পারে। সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে পাপ-পুণ্যের নাই বালাই। ’ …অর্থাৎ তাঁর সিদ্ধান্ত হলো, ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য, শ্লীল-অশ্লীল, গালি-আদর এসবের যাবতীয় বোধই আপেক্ষিক। লক্ষ্য করলেই তাঁর কথার সত্যতা পাওয়া যাবে। আমাদের একই তো দেশ, একই তো ভাষা, অথচ এক অঞ্চলে যা ভব্য, অন্য অঞ্চলে তা অসভ্য, এক এলাকায় যা অশ্লীল, গালি—অন্য সমাজ-জনপদে তা মোটেই অকথ্য নয়, গালি নয়। যেমন—ধরা যাক ‘মাগি’ শব্দটি। সভ্য মহলে এটি একটি উৎকৃষ্ট গালি। কিন্তু রংপুর এবং তার সন্নিহিত অঞ্চলগুলোর গ্রাম-অগ্রাম-নির্বিশেষে, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব পর্যায়ে ‘বউ’কে অবলীলায় ‘মাগি’ বলার চল রয়েছে। ওই যে আমাদের সমাজবীক্ষক বাগধারা বা লোকশ্লোকটি—‘এক দেশের বুলি/আরেক দেশের গালি। ’

বাংলাদেশে এবং রীতিরকম বাংলা সাহিত্যে তুচ্ছাত্মক কটাক্ষ করতে গালি হিসেবে মাগি শব্দটির প্রয়োগ-প্রচলন রয়েছে। সাঁইজি লালন ফকির তাঁর একটা গানে বলেছেন—‘কারে বলো মাগি মাগি/মাগির হাত এড়াতে পারে/কোন বা সহযোগী। /ব্রহ্মাবিষ্ণু নারায়ণে/এলো মাগির বোঝা টেনে/তাই না বুঝে আমলোকে/বাঁধালো ঠকঠকি। ’ সুতরাং তাঁর গীতবাণীতে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে আমাদের সমাজে মাগি বলে যে গালাগাল রয়েছে বা নারীদের মাগি বলে তুচ্ছ এবং অসম্মান করার যে বেহুদা মনোভাব রয়েছে তা গর্হিত। ‘মাগি’ শব্দটিকে গালি হিসেবে প্রয়োগের হাজারটা উদাহরণ রয়েছে আমাদের সমাজ-সাহিত্যে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাসে তুচ্ছাত্মক তাচ্ছিল্যজ্ঞাপক গালি হিসেবে চরিত্রের প্রয়োজনে ‘মাগি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন (পৃ. ৬৭৯, ৬৮৩, রবীন্দ্র রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, বিশ্বভারতী, পৌষ ১৪১৭)। ‘মিনসে’ শব্দটিও পাওয়া যায় ওই একই উপন্যাসের ৬৮৪ পৃষ্ঠায়। শামসুর রাহমান তাঁর ‘এই মাতোয়ালা রাইত’ কবিতায় ‘খানকি মাগী’, ‘হালায়’, ‘মাদদির পো’, ‘হোগা’ শব্দগুলোকে সমাজচিত্র হিসেবে লাগসইভাবে ব্যবহার করেছেন।

আমাদের সমাজে প্রচলিত গালিগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যৌনগন্ধি এবং নারীকে অসম্মান করার প্রবণতায় দূষিত। যেমন—ঢাকা শহরে ‘খানকির পোলা’, এ যেন খুব গাসওয়া, উঠতে-বসতে দ্বিধাহীন। কুষ্টিয়ায় ‘বাঁড়া’, ‘বাঁড়ার’ ‘বাল’ কথাটির ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে গালি হিসেবে। আসলেই যখন প্রসঙ্গত এই ‘বাল’ শব্দটির ব্যবহার ও ব্যুৎপত্তি-ব্যাকরণ নিয়ে বলা বোধ করি এখানটায় বেশ মানিয়ে যাবে। ‘বাল’ খুবই নিষ্পাপ একটি শব্দ। আরবি, ফারসি, হিন্দি, উর্দুতে ‘বাল’ স্রেফ চুল বা কেশ। আমাদের বাংলায় এসে এর অর্থ হয়ে গেল যৌনকেশ। হলোই বা, তাহলে সেটা গালি বা খিস্তির সমকক্ষ হলো কেন, সেটা ফনোলজিস্টদের গবেষণার বিষয় বটে। রংপুরের পীরগঞ্জের গেঁয়ো ঝগড়ায় শুনেছি—‘ফোঁড়া মাঙের বাল মোর, খুব পাইস, বাঙি ফাটাইবার পাইস। ’ কোনো কোনো শব্দ একেবারে নির্দোষ, এমনকি বিশেষ গুণী-শরিফ হওয়া সত্ত্বেও কেন কোন অভিশাপে সমাজ-রাজনৈতিক কারণে তা গালিতে পরিণত হয়েছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন যেমন আছে, সেসবের আশ্চর্য মূল্যবান এবং ইতিহাসগর্ভা-উত্তরও কিন্তু রয়েছে। তার কিছু আমরা যেমন জানি-বুঝি, ঠিক উল্টোভাবে কিছু আবার জানিও না—বুঝিও না। যেমন—মীরজাফর, মোস্তাকি, রাজাকার, বেলুচিস্তানের কসাই। এখানে ওই ব্যক্তির এবং বাহিনীর নামবাচক। প্রতিটি শব্দের অর্থই অভিজাত ও মানবকল্যাণী। কিন্তু সোশিওপলিটিক্যাল ঐতিহাসিক হীন-নিচু অমানবিক আচরণের জন্য তাদের শরিফ নামগুলো উৎকৃষ্ট গালিতে পরিণত হয়েছে। আর একটি নামের সার্থক অর্থের পরিবর্তন ঘটে নেতিবাচক—ঘৃণ্য অর্থ ধারণ করার পেছনে রয়েছে ব্যাপক ইতিহাস বা জঘন্য সব ঘটনা। আবার কিছু শব্দ আছে বোধ হয় শুরুতেই (বা কোনো কারণে) একেবারে বিপরীতাত্মক অর্থে এমনভাবে প্রয়োগ হয়ে আসছে যে খুবই আপত্তিকর। যেমন—প্রপাগান্ডা বলতে আমরা ‘অপপ্রচার’ই তো বুঝি। কিন্তু তা আসলে ইতিবাচক বা ধনাত্মক প্রচারণার বাইরে কিছু নয়। আমরা যদি কোনো সভায় প্রধান অতিথি মন্ত্রী মহোদয়কে এই বলে সম্বোধন করি যে মাননীয় ধুরন্ধর মন্ত্রী মহোদয়, তাহলে কেমন হবে? আমরা কিন্তু ধুরন্ধর বলতে বাটপার, কূটবুদ্ধিসম্পন্ন, ধূর্ত, চালবাজ, মতলববাজ, শেয়ানা, খারাপ লোককেই বুঝি। কিন্তু অভিধান বলছে—‘ধুরন্ধর’ মানে হচ্ছে দক্ষতার সঙ্গে কার্যভার বহন করতে সক্ষম এমন কর্মকুশল মানুষ। অথচ সমাজে ধুরন্ধর হলো আক্রমণাত্মক শিষ্টাচারবহির্ভূত একটি গালিবিশেষ। আর ‘চোর’ হলেই খারাপ লোক এমন তো না-ও হতে পারে। এই কাজে লিপ্ত হওয়ার পেছনে কী কারণ বা বিদিশা-পথ হারানো রয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে কাজটি খারাপ হওয়া সত্ত্বেও জড়িত লোকটি খারাপ না-ও হতে পারেন। অতএব গড়-গড়ান্তি ‘চোর’ সমাজে একটি গালিসূচক শব্দ হবেই, চূড়ান্ত বিচারে তা নাও তো হতে পারে। হ্যাঁ, ঘুষখোর, জুয়াচোর, মিথ্যাবাদী, চোগলখোর, সুদখোর, অবৈধ দখলদার— এগুলো গালি হিসেবে গণ্য যে তারা আসলেই নিকৃষ্ট। কিন্তু মানুষ কেউ এতটাই অবিচারি ও মেধানিষ্ঠুর যে কিছু নিষ্পাপ প্রাণীর নামকে মানুষের জন্য গালি হিসেবে স্থির করে ফেলেছে। যেমন—কুকুর, কুত্তার বাচ্চা, শুয়োর, বলদ ইত্যাদি। কেন, এই ধরনের অবিচারের শিকার হওয়া অবোলা প্রাণীগুলোর দোষটা কী? কুত্তার বাচ্চা বললে যাকে বলা হলো, আসলে তার মায়ের সম্ভ্রমকে যে হানি করা হলো, এটা মানুষের মেধার কত বড় বর্বরতা! শুয়োর, বলদ, কুকুর এই নামগুলো গালি হিসেবে ব্যবহার করাটা মানুষের পক্ষে কতটা সাজে সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যায় কি? আমরা ঘৃণা করি—পৃথিবীর এমন কোনো প্রাণী তো তার জন্য বেঁধে দেওয়া প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে যায় না। মানে সে কোনো অবস্থায়ই তার সীমা লঙ্ঘন করে না। বরং সেদিক দিয়ে মানুষই সবার চেয়ে অগ্রগামী যে সে মেধার বর্বরতা করে এবং তার জন্য মান্য সব নিষেধ ও অনুমোদনকে নির্লজ্জভাবে বুড়ো আঙুল দেখায়। এর পরও সে স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ এবং অন্য অনেক প্রাণীই তাদের বিবেচনায় গালি দেওয়ার নামবাচক। মানুষ এত বড় বেহায়া হয়েও আয়নার সামনে দাঁড়ায় না, কোনো আত্মমূল্যায়ন করে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসে ‘বেহায়াগিরি’ (রবীন্দ্র রচনাবলী, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৪৯০, পৌষ ১৪১৭), ‘ড্যাম শুয়ার’ (প্রাগুক্ত, গোরা, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৪৩৯) এবং ‘পশুবৎ মূঢ়’ (প্রাগুক্ত, গোরা, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৪০৬) এই গালিগুলোর প্রয়োগ বা ব্যবহার করেছেন। যিনিই এগুলো প্রয়োগ করুন, আসলে তিনি তো উদ্দেশ্যমূলকভাবে ওটা করেননি, আমাদের সমাজ-পরিবার মানবচেতনার সামগ্রিক অন্ধত্ব তাকে লিখতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে বা তাকে লিখতে বাধ্য করেছে। কিন্তু প্রশ্ন তো জাগেই—প্রাণীগুলোর দোষটা কী? অবশ্য জসীমউদ্দীন যখন বলেন যে—‘ওরে মুখপোড়া ওরে ও বাঁদর/গালিভরা মা’র এমনি আদর। ’ তখন গালি হওয়া সত্ত্বেও তা মায়ের ভালোবাসা আর আশীর্বাদেরই শীতল প্রস্রবণ হয়ে দাঁড়ায়। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যখন তাঁর ‘প্রথম গালি’ কবিতায় সেই মায়াময় গালিটি ছোট বোনকে দিয়ে বড়দিকে দেওয়ান, তখন তা গালি হওয়া সত্ত্বেও অপূর্ব-অসাধারণ সুন্দর হয়ে হৃদয় স্পর্শ করে এবং অন্তরে ঢেউও দোলা জাগায়। দিদিই অনেক ছোট, তার ছোট বোনটি আরো ছোট, কেবল কথা শিখেছে, ভালো করে উচ্চারণ করতে পারে না। দুই বোনে তো মিলেমিশেই থাকে। সেই তাদেরই পুতুল খেলায় খুনসুটির মন কষাকষি। রেগে গিয়ে ছোট্ট বোনটি আরেক পিচ্চি বড়দিকে গালি দিল ‘দিদি টুমি টুই’। ‘তুই’ একটা গালি। তাও ভুল উচ্চারণে এবং শিশু বোনটির দুই-আড়াই বছরের সমগ্র জীবনে প্রথম গালি! তাই এর চেয়ে মধুর গালি এবং এর চেয়ে মনোমুগ্ধকর বিদ্রোহ আর কী হতে পারে। একেই বলে ভাষার মাহাত্ম্য এবং কবিত্বের কারুকাজ!

এবার ধরা যাক সারা দেশে প্রচলিত একটি গালি নিয়ে বীক্ষণ—‘ভোদাই’। ভোদাই মানে বোকা, আলাভোলা, হাবলা, হাবাগোবা। তাহলে সেটা কেন গালি? এবং বেশ অপমানসূচক! ‘স্টুপিট’ বললে কিন্তু অতটা গায়ে লাগে না, কিন্তু ‘ভোদাই’ বললে অন্তরে বড় জ্বলে যায়, অথচ একই তো কথা! চোখ বড় বড় করে মেয়েদের দিকে তাকালে তার জন্য গালি হলো ‘ঢেলাবারানি’। যে নির্লজ্জ তাকে গাল দেওয়া হয় ‘চমশখোর’—চমশ মানে চোখ, এই চমশ থেকেই ‘চশমা’। কেন ঢেলাবারানি? সৌন্দর্য পান করার অধিকার কি তার নেই। যাঁকে ‘ঢেলাবারানি’ বলা হয়, তিনিও যদি দেখতে মনোহরা নারী বা পুরুষ হন, তাহলে তাঁর দিকেও তো মানুষ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়! তাকাক—ক্ষতি কী?

বহির্দেশ থেকে পোষাক, যন্ত্রপাতি বা অন্যান্য ব্যবহার্য এলে তার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বা সে সবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের সংস্কৃতিও যে আসে তা অবধারিত। সংস্কৃতির একটা বৈশিষ্ট্য যে অপসংস্কৃতি, তার সংক্রমটা ঘটে বেশি। মানে ওই যে কথাটা ‘স্বাস্থ্য নয়, রোগরই সংক্রামক’। তাই লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমাদের মধ্যে অনেক গালির ব্যবহার আছে যা এসেছে বিদেশি বা বিদেশিদের ভাষা থেকে। যেমন—‘বানচোত’ বানচোত এসেছে কোনো মুসলিম শাসন আমলে। গালিটি এই উচ্চারণে আসার আগের কর্ম হলো ‘বাহেনচোদ’ এবং এরও আগের মূল শব্দটি হলো ‘বাহিনচোদ’। উর্দু আর হিন্দিতে তো অবশ্যই বোধ করি ফার্সিতেও বাহিনচোদ মানে বোনকে যে পুরুষ ধর্ষণ করে। আরো আছে যেমন : ‘উল্লুক কা পাঠে’, ‘গিদ্দার কি বাচ্চে’, ‘শালে বাঙ্গালে’, বেঈমান ইত্যাদি। ইংরেজরা যে আমাদের দেশকে বহুদিন শাসন-শোষণ করেছে তাদের কাছ থেকে আমরা অনেক আপত্তিকর গালি শিখেছি, যা পরিবর্তিত আকারে সমানে বিদ্যমান। যেমন : খেলাধুলা বা অন্য যেকোনো বিষয়ে অপর পক্ষের সঙ্গে অন্যায় আচরণ বা খুনসুটি করলে তাকে গালি দেওয়া হয় ‘কান্টেলি’ বলে। ইংরেজি Scoundrely থেকে এসেছে শব্দটি। ঝামেলা সৃষ্টিকারী জটিল-কুটিল মেধার মানুষকে বলা হয় ‘খিটকেল’ Critical থেকে আসা শব্দ এটি। বোতেল মাগি এসেছে Brothel থেকে, লোটি মাগি এসেছে Noughty থেকে, বালেস্টর এসেছে Barrister এই রকমের বহু আছে। ‘চার শ বিশ’ এসেছে ইংরেজি ফোর টোয়েন্টির একেবারে বঙ্গানুবাদ হয়ে—এই ৪২০ হলো পকেটমার ধারা। বিশেষত ঢাকাসহ অনেক জেলায় চালু আছে ‘মাদারচোদ’ এই গালিটি। আরবি (সম্ভবত ফারসিও) ‘মাদা’ থেকে এসেছে ‘মাদার’ শব্দটি। এর অর্থ হলো নারী। সম্ভবত ইংরেজি Mother-এর সঙ্গে শঙ্করায়ন ঘটেছে শব্দটির। শেষ পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে যৌনতা করার বদনামস্বরূপ এই গালি। পাকিস্তানের বর্বর মিলিটারিরা বাঙালিদের এই গালি দিত সহি উচ্চারণে।

শালি, শালা এগুলো মধুর সম্পর্কের নিকটাত্মীয়, সম্বন্ধিও সম্মানজনক মুরব্বি আত্মীয়। কিন্তু এগুলো আমাদের সমাজে হরহামেশার গালি। এর পেছনের কারণ হলো শালি-শালা-সম্বন্ধি—এরা সবাই বউয়ের ভাই-বোন। অতএব, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পারিবারিক আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও এটি হচ্ছে ছেলে পক্ষের ব্রাহ্মণ্য বা নারী কিংবা কনে পক্ষকে তাচ্ছিল্য করার শামিল। ‘চোদনা’ গালিটিরও বেশ চল রয়েছে আমাদের জীবন-জবানে। এটি বলে কাউকে ভোদাই, বোকা, গাণ্ডু, হাঁদা, হাবলা বোঝানো হয়। কিন্তু অভিধান বলছে, এই শব্দটির অর্থ হলো—‘প্রেরণা’, ‘প্রবর্তনা’। কেন যে শব্দটির এভাবে জাতমারা গেছে ভাবনার বিষয়। এ রকমের বহু শব্দ আছে মূল থেকে গালিতে পরিণত হওয়ায় তার সামাজিক অর্থ আমূল পাল্টে গেছে বা ভীষণ উচ্চারণান্তর ঘটেছে।

শেষে বলা চলে, গালি অবশ্যই আমাদের ভাষা বাস্তবতায় জ্ঞান অন্বেষণের একটি উৎস বা গবেষণার আকর। কেননা তাতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষে সমাজজীবনের অনেক অজানা বা বিস্মৃত ইতিহাস লুকিয়ে আছে। লক্ষণীয় যে অনেক বিলম্বে হলেও বাংলা ভাষায় এরই মধ্যে ‘গালি অভিধান’, ‘বাংলা স্ল্যাং সমীক্ষা ও অভিধান’, ‘বাংলা অকথ্য ভাষা ও শব্দকোষ’, ‘অপরাধজগতের শব্দকোষ’, ‘যথাশব্দ’, ‘অশ্লীল লোকছড়ায় সমাজচিত্র’, ‘ধমনি (গালিসংখ্যা)’ ‘বাঙালনামা’—এজাতীয় বেশ কিছু বই প্রকাশ পেয়েছে। যা প্রমাণ করে—গালাগালের বিষয়টি পৃথিবীর ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধ ভাষার মতো বাংলা ভাষায়ও একটি গবেষণাযোগ্য বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। অতএব গালাগাল সরল এবং প্রাথমিক শ্রবণে খিস্তিখেউড়-মুখখারাবি হলেও গভীর বীক্ষণে ও ব্যুৎপত্তি-ব্যাকরণে তা সব তুচ্ছ জঞ্জালজ্ঞানে মূল্যহীন নয়।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ