বাংলাদেশ ছাত্রলীগ গৌরব ও ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ইতিহাস নিয়ে অক্ষুন্ন রয়েছে

আব্দুস সাত্তার
বাংলা ও বাঙালীর স্বাধীনতা ও স্বাধিকার অর্জনের লক্ষেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জন্ম হয়েছিল।  গৌরব ও ঐতিহ্যের এ প্রাচীনতম ছাত্র সংগঠনটি জন্ম লাভের পর থেকে নানারকম ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়েও এ সংগঠনটি বিশ্বের দরবারে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে স্বমহিমায়। বিভিন্ন সময় এ ছাত্র সংগঠনটির গায়ে কালিমা লাগানোর চেষ্টা অতীতে করা হয়েছিল, বর্তমানেও করা হচ্ছে। এর পরেও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির মুল নীতি থেকে কখনও বিচ্যুত হয় নি এবং অগামীতেও হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

 

বর্তমান সরকারের ক্ষুধা, দারিদ্রমুক্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের সহযোগী সঙ্গী হিসেবে সারাদেশে নিরলস কাজ করেছে এই ছাত্রসংগঠনটি। অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অগ্রসেনানীর দায়িত্ব পালন অব্যাহত রেখেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিল তিল করে হাতে গড়া বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৬৯তম বছরে পর্দাপণ করেছে।
মূল দল আওয়ামী লীগের জন্মের এক বছর আগেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল গৌরব ও ঐতিহ্যের এ ছাত্র সংগঠনটি ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নেতৃত্বেই ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে আনুষ্ঠানিকভাবে এর যাত্রা শুরু হয়। তৎকালীন তরুণও জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবের প্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতায় এক ঝাঁক মেধাবী তরুণের উদ্যোগে সেদিন যাত্রা শুরু করে ছাত্রলীগ। ৬৯তম বছরে ছাত্রলীগের ইতিহাস হচ্ছে জাতির ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা, মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়ন, স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনা, গণতন্ত্র প্রগতির সংগ্রামকে বাস্তবে রূপদানের ইতিহাস। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সংগ্রামে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব দিয়েছে। আর ছাত্রলীগের সবচেয়ে বড় অর্জন মহান স্বাধীনতা লাভ। এজন্য ছাত্রলীগের শতশত নেতাকর্মীকে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা অজর্নের জন্য তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা  চরম আত্মত্যাগ দিয়েছিল বলেই পাকিস্তানী হানাদান বাহিনী ও তাদের এদেশীয় রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের  বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে  আনা সম্ভব হয়েছিল। ছাত্রলীগের এ অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে  লেখা থাকবে।

 
১৯৪৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তাানের প্রথম বিরোধী দল হিসাবে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগে’র আত্মপ্রকাশ ঘটে, যা পরে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে এ  দেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়। এজন্যই ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বাঙালী জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ।

 
ছাত্রলীগ মানেই আন্দোলন সংগ্রামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই ছাত্র সংগঠনটির নেতৃত্বে  ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সব আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবন যৌবনের প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের  নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে বাঙালীর ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা, ‘৫৪-এর সাধারণ নির্বাচনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ পরিশ্রমে যুক্তফ্রন্টের বিজয় নিশ্চিত, ‘৫৮-এর আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ‘৬২-এর শিক্ষ আন্দোলনে ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা, ‘৬৬-এর ৬ দফা নিয়ে ছাত্রলীগের  নেতাকর্মীদের দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া, ৬ দফাকে বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রলীগের  নেতৃত্বে পাকিস্তানী শাসকের পদত্যাগে বাধ্য করা এবং বন্দীদশা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করা, ‘৭০-এর নির্বাচনে ছাত্রলীগের অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসমরে ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ, স্বাধীনতা পরবর্তী সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রলীগের অসামান্য অবদান দেশের ইতিহাসে  লেখা থাকবে চিরকার।

 
ইতিহাসের ধাপ পেরিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেয়া সংগঠনের নেতাকর্মীরা পরে জাতীয় রাজনীতিতেও  নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখনও দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান জাতীয় রাজনীতির অনেক শীর্ষনেতার রাজনীতিতে হাতেখড়িও হয়েছে ছাত্রলীগ থেকে।
মহান বিজয় দিবস ২০১২ উপলক্ষে সারাংপুর প্রকাশনী রাজশাহী থেকে ‘অভ্যুদয় বাংলাদেশ’ নামে একটি স্মারক স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা ও এক সময়ের রাজপথ কাপানো তুখোড় ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ তাঁর ‘উত্তাল ঊনসত্তর’ প্রবন্ধে তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ‘৬৯- এর ১৪ ফেব্রুয়ারি, পল্টন ময়দানে ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি (ডাক)-এর জনসভা দিনটি আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন, স্মৃতিমধুর দিন। ওইদিনই ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় মৃত্যুর প্রহর  গোনা বঙ্গবন্ধু আমাকে কারাগারে দেখতে চেয়েছিলেন। আজও মনে পড়ে, আমরা বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার গাড়িতে করে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আবদুর রউফসহ ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি থেকে ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাচ্ছি। গাড়ি ড্রাইভ করছিল  শেখ কামাল। পাশে উপবিষ্ট ছিলেন শেখ হাসিনা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী)। কতদিন পর বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পাব সে উত্তেজনার পথ  যেন শেষই হচ্ছে না। দেখা হতেই বঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে টেনে নিয়ে কপালে চুম্বন করে প্রাণ ভরে দোয়া করলেন। আমি তাঁর বিশাল হ্দৃয়ের মধ্যে হারিয়ে গেলাম। কত বড় মনের মানুষ। মানুষকে নিমিষেই আপন করে নেওয়ার তাঁর যে কী সম্মোহনী শক্তি, তা ভাবলে আজও আমি উদীপ্ত হই, মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি পাই। তিনি আমাকে বললেন, ‘আজকের পল্টনের জনসভায় তুইও বক্তৃতা দিবি।’ আমি বললাম ‘আজ তো আমাদের (ডাকসু বা আপসু’র ) জনসভা  না, আজ ডাক- এর জনসভা। আমার বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ কোথায়।’ বঙ্গবন্ধু বললেন ‘মঞ্চের পাশে সাংবাদিকরা যেখানে বসে তুই সেখানে বসবি। আমার বিশ্বাস জনতাই তোকে চাইবে।’ হলোও তাই। সভার শুরুতে নুরুল আমিনের নাম সভাপতি হিসেবে প্রস্তাব করলে উপস্থিত লাখো জনতা ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখান করে জনগণ আমাকে মঞ্চে তুলে দেয়। জনতার এ শ্লোগান ব্যক্তি তোফায়েলের প্রতি ছিল না। এ ছিল ১১-দফার প্রতি তাদের অকুন্ঠ সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ।’

 
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে বার বার তাঁকে কারাগারে  যেতে হয়েছে। আনুমানিক প্রায় ১৪বছর  কারাগারের প্রকোষ্ঠে অতিবাহিত করেছিলেন। আর এতে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবসহ বঙ্গবন্ধুর ছেলেমেয়েরা বাবার আদর ভালোবাসা থেকে বরাবরই বঞ্চিত হয়েছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমানের নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করে বলেছেন, ‘ একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছ্ িহাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ আব্বা’ বলে ডাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে ,“হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে একটু আব্বা বলি।” আমি আর রেণু দু’জনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম,“ আমি তো তোমারও আব্বা।” কামাল আমার কাছে আসতে চাইতো না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে  ভুলে যায়! আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে?
বঙ্গবন্ধু নিজের পরিবারে জন্য কখনও ভেবে দেখেন নি। তিনি শুধুই স্বপ্ন দেখতেন বাংলার মা, মাটি ও মানুষকে নিয়ে। বঙ্গবন্ধু এতো সাদামাটা জীবনযাপন করতেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাকিস্তান ভাগ হওয়ার আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু শহীদ হোসেন সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবের সাথে আন্দোলন করেছিলেন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান।  এরপর পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পরেও কোনো লাভ হলো না। পাকিস্তান স্বাধিনতার পর থেকে এই বাংলার জনগণের সাথে বৈষম্য শুরু করেছিল। ফলে সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়ল এই বাংলা। এর পরে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয়ে অবশেষে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জিত হয়।

 
১৯৭৫ সালের পনের আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সপরিবারে হত্যা করে একাত্তরের দোসরদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় কিছু বিপথগামী আর্মিরা। ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তার আদর্শ, উদারতা, ন্যায়পরাণতা জাতি চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। আর বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার কাজ করে চলেছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এদেশের আপামর মেহনতী মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করার জন্য।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গৌরব ও ঐতিহ্যের সুনামকে অক্ষ্মুন্ন রাখতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রত্যেক নেতাকর্মীকে সজাগ থাকতে হবে। কেননা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে গড়া এই সংগঠনটির শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করার প্রত্যাশা করছি। আর যারা ছাত্রলীগের নামে সংগঠন পরিপন্থী কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা কঠোর ভাবে নিতে হবে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।  এই অপপ্রচারকারীদের সম্পর্কে সবসময় খেয়াল রাখতে হবে।
২০০৮ সালে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে কসাই কাদের মোল্লার রায় কার্যকর করা হয়েছে। আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য জামাত-শিবির দেশে বিদেশে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আর নেপথ্যে থেকে প্রশয় দিচ্ছে বিএনপি।

 
আর এদেরকে রাজপথে মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সকল ইউনিট গুলোকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো সজাগ রাখতে হবে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ছাত্রলীগের সাবেক একজন কর্মী হিসেবে আমি সবাইকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।

স/অ