বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দিয়েছিল ভারত

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে দুনিয়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৯৭২ সালে মার্কিন কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সম্পর্কে বলেছিলেন যে এটা একটা ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’। ইতিহাস কিন্তু তাঁকে ভুল প্রমাণিত করেছে। এটা ঠিক প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নানা বিষয়ে পিছিয়ে ছিল। বিশেষত অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রশ্নে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের পরও অনেক আর্থিক অসাম্য এই দুই দেশের মধ্যে একটা ইতিহাসের বোঝা হয়ে এসেছিল। কিন্তু পাঁচ দশক পর আজ বাংলাদেশের পার ক্যাপিটাল জিডিপি সেটা কিন্তু পাকিস্তানের থেকে অনেক ওপরে। সামাজিক যে ইন্ডিকেটর বলি তাপীয় কিন্তু পাকিস্তানের থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে। যেমন—লাইভ এক্সপেক্টান্সি অব বার্থ, স্কুলে যাওয়ার বয়স, লিঙ্গ ব্যবধানের সুযোগ—এসব বিষয় কিন্তু সেই বাস্কেট কেসের অতীতের গঞ্জনা সেটা কিন্তু এশিয়ার একটা সাফল্যের কাহিনিকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে বাংলাদেশ।

আজ সেই ৬ ডিসেম্বর। যে ৬ ডিসেম্বরে ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে তার মর্যাদা ঘোষণা করেছিল। সেই দিন ভারতের সঙ্গে ভুটানও একইভাবে একই সুরে তা মেনে ছিল। কিন্তু বেশির ভাগ দেশ এই স্বীকৃতি দিতে সময় নিয়েছিল। কয়েক বছর সময় নিয়েছিল চীন। আজ এত বছর পরে কথা বলা যায়, যেমন ৬ ডিসেম্বর ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার জন্য একটা কলঙ্কিত দিন। ঠিক বিপরীতে বাংলাদেশের এই দিনটি একটা শুধু ঐতিহাসিক দিন, স্মরণীয় দিন নয়। এই দিনটা ৫০ বছর পরও বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর সব রকমের বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো। সেই ৬ ডিসেম্বরের যুদ্ধ প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মাস্টার স্ট্র্যাটেজি ছিল। এই স্ট্র্যাটেজিতে তিনি সফল হলেন। আজ এত বছর পর বোধ হয় সেই ৬ ডিসেম্বরকে নতুন করে স্মরণ করার সময় এসেছে। শুধু অতীতের পৃষ্ঠাটা পড়ার জন্য নয়; ভবিষ্যতে একটা নতুন বিশ্বাস, আস্থা ও অঙ্গীকার নিয়ে এগোনোর প্রত্যয় করার জন্য।

ইন্দিরা গান্ধী ‘প্রোফাইল ইন কারেজ’ গ্রন্থের লেখক ট্রেভার ড্রেবারগ ১৯৭১ সালের অসাধারণ কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। ইন্দিরা গান্ধীর এই জীবনীতে তিনি জানাচ্ছেন যে ১৯৭১ সালের ৭ জুলাই হেনরি কিসিঞ্জার দিল্লি আসেন। দিল্লিতে এসে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর বিশিষ্ট উপদেষ্টাদের সঙ্গে দেখা করেন। বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেন যে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যদি যুদ্ধ হয়, তাহলে কিন্তু আমেরিকার পক্ষে ভারতকে সমর্থন করা সম্ভব হবে না। এ ধরনের যুদ্ধের মনোভাব থেকে ভারতের বেরিয়ে আসা উচিত। অর্থাৎ সেই সময় কিছুতেই আমেরিকা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ ঘোষণার পরিকল্পনাকে সমর্থন করতে পারছিল না। সেই সময় কিসিঞ্জার কিন্তু ঠিক ভারতে আসবেন বলে আসেননি। তিনি যাচ্ছিলেন তখন চীনে। চীনের সঙ্গে তখন নিক্সন বরফ গলাতে চাইছেন। সেই সময়ের তথ্য ঐতিহাসিক এবং অবিস্মরণীয়। আমাদের মনে আছে, গভীর রাতে একটা বিমানে ভারত থেকে তিনি চীন দেশে পাড়ি দেন। সেই সময় ডি পি ধরকে ভারতের কিসিঞ্জার বলা হতো। যাওয়ার আগে তিনি ডি পিকে বারবার বোঝালেন যেন এ রকম কোনো কাজ তিনি না করেন। ভারত তাঁর কথা শুনেছিল। তাঁর খুব খাতির-যত্ন করেছিল। এবং সেই সময় দিল্লির অশোকা হোটেলে খুব জাঁকজমকপূর্ণ একটা চায়নিজ ব্যাংকুয়েটের ব্যবস্থা করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টা পি এন হাকসার। সেই সব কথাও কিন্তু ট্রেভার লিখেছেন। কিসিঞ্জার চলে যাওয়ার পর কিন্তু ভারত ভারতের কাজ করেছে। ১৯৭১ সালে কিসিঞ্জারের চলে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো হঠাৎ সেখানে আসেন। আমেরিকা এবং চীনের যে বোঝাপড়ার প্রচেষ্টার সেই সময় রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কিন্তু অত্যন্ত মধুর। ভারত তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের ছাতার তলায় আছে। কূটনীতিক চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত তাঁর সাম্প্রতিকতম বই ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার দ্য ডেফিনিটিভ স্টোরি’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে যাঁরা সেই সময় ইন্দিরা গান্ধীর সবচেয়ে বড় উপদেষ্টা এবং think-tank ছিলেন এই পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করার বিষয়ে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সম্পূর্ণ সমর্থন করার জন্য সেখানে লিডিং যে ফিগার সেখানে ছিলেন তার মধ্যে একজন হচ্ছেন পি এন হাকসার। আর অন্যরা হলেন ডি পি ধর, পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউ, ‘র’ প্রধান আর এন কাউ। হাকসার প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যে কর্তৃত্ব পেয়েছিলেন সেই কর্তৃত্ব দিয়ে তিনি লিডিং রোল নিচ্ছিলেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারিও করা হয়। ডি পি ধর এবং কাউ মিলে একটা কোর গ্রুপ তৈরি করেন। তৎকালীন সেনাপ্রধান মানেক শকে সঙ্গে নিয়ে একটা সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পূর্ণ সমর্থন এবং কেন ভারত সেটা করছে, তা পৃথিবীর কাছে জানানোর জন্য সেই সময় ইন্দিরা গান্ধী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাঁর ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন, যাতে অন্যান্য দেশও ভারতকে সমর্থন করে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়।

সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া আর পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করা অথবা যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া—এই দুটি বিষয়কে তখন সুকৌশলে ভারত আলাদা রাখতে চাইছিল। ভারত কিন্তু প্রথমেই একটা all outযুদ্ধে পাকিস্তানের সঙ্গে যেতে চাইছিল না। অর্থাৎ ভারত শুরু করতে চাইছিল না। যাকে বলে ফার্স্ট শর্ট, সেটা ভারত নিতে চাইছিল না, করতে চাইছিল না। কিন্তু ভারত বুঝতে পারছিল যে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করলেই কিন্তু একটা সাংঘাতিক কাণ্ড হবে। এই ফর্মাল স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্তটা হয়েছিল ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। তখনই ভাবা হয়েছিল পাকিস্তান কিন্তু যুদ্ধ করবে। পাকিস্তান যদি যুদ্ধ করে, তাহলে ভারতেরও যুদ্ধ করার যুক্তি জোরালো হয়ে যাবে। ভারতও কিন্তু এই যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগেই। পাকিস্তান ৩ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণ হানল। তখন ভারতের পক্ষে যুদ্ধ করার আইনগত জাস্টিফিকেশনটাও বেড়ে গেল। গোটা দুনিয়ার কাছে ভারত দেখাতে পারল ভারত আক্রান্ত, তাই যুদ্ধে যেতে হচ্ছে। কিন্তু পাশাপাশি নয়াদিল্লি একটা কৌশল নিল। যেটা ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের যে ঘোষণা করার কথা ছিল, সেটা ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হলো। চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত তাঁর বইটিতে লিখেছেন যে এটা আসলে যুদ্ধ নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করা আর ‘অ্যাক্ট অব রিকগনিশন অব বাংলাদেশ’—এ দুটি বিষয়কে ভারত ডি-লিংক করতে চেয়েছিল। এই ঘোষণার পর বাংলাদেশের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সেটাও কিন্তু চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত লিখেছেন। তিনি উল্লেখ করছেন, সেই সময় কলকাতায় ইন্ডিয়ান লিয়াজোঁ অফিসের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন অশোক রায়। তিনি এ ব্যাপারে বাংলাদেশের নেতাদের ভারত স্বীকৃতি দিচ্ছে, এই তথ্য তাঁদের জানান। বাংলাদেশের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তার একটা রিপোর্ট তিনি পাঠান। ৬ ডিসেম্বর সকালে এটা বাংলাদেশের নেতাদের জানানো হয়। তখন বাংলাদেশের তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁরা এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে ভারতের এই ভূমিকায় তাঁরা আনন্দে কথা বলতে পারছিলেন না। অশোক রায় যে রিপোর্টটা পাঠান সেটা উল্লেখ করে চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত তাঁর বইয়ে বলছেন, অশোক রায় বলেছিলেন যে এই স্বীকৃতি প্রদানের কথাটা শুনে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কার্যত কেঁদে ফেলেছিলেন। একটা দীর্ঘ নীরবতার পর তিনি ভারতের এই ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন যে এটাতে ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক চিরকালের জন্য শক্তিশালী এবং মজবুত হয়ে গেল।

বাংলাদেশ ও ভারত ১৯৭১-এর যুদ্ধে বিজয় লাভ করেছিল। তারপর ৫০টি বছর কেটে গেল। আজ এত বছর পর একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে ভারত এবং বাংলাদেশের মৈত্রী কি আগামী দিনগুলোতেও একইভাবে মধুর থাকবে? নাকি নানা বিষয়ে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে নৈতিক অধঃপতন হচ্ছে? এখন আবার নানা প্রশ্নে নানা কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। ভারত কি পাকিস্তানকে ভাঙতে চেয়েছিল? বাংলাদেশের যে মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করাই কি তার পেছনে ভারতের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল? এসব প্রশ্ন অনেকে করছেন। কিন্তু এটা তো ঘটনা যে সেই সময় পুরোপুরি একটা মিড ফ্রি অ্যাকশনে যেতে ভারত ঝুঁকি নিয়েছিল। আমেরিকা-চীন-পাকিস্তানের পক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে রাজি ছিল না। কিন্তু ভারত সরাসরি তাদের সঙ্গে একটা সংঘাতে গিয়ে নাটকীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে একটা মস্ত বড় কাণ্ড ঘটিয়ে দিয়েছিল পৃথিবীর বুকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম দিকে এই মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করতে চাইছিল না বলে জানিয়েছিল। চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত তাঁর বইয়ে তিনি দেখিয়েছেন যে কিভাবে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পারসুয়েশনে যায়। ইন্দিরা গান্ধী নিজে পৌঁছে যান। সেখানে গিয়েও তিনি অনেক কথাবার্তা বলেছিলেন জাতি বাংলাদেশকে তাঁরা সমর্থন জানায়।

কিন্তু বাংলাদেশের একজন কূটনীতিক আমাকে একবার বলেছিলেন যে আপনার ভারত যখন এত কাণ্ড করল, তারপর কেন সিমলা চুক্তি স্বাক্ষর করতে গেলেন ইন্দিরা গান্ধী? চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত তাঁর বইয়ে দেখিয়েছেন এসব বিষয়ে অনেক মিথ ছিল। ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে সমর্থন করেছিল এবং স্বাধীনতাকে যেভাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল, এই ৬ ডিসেম্বরে সেখানে দাঁড়িয়ে বলা যায় যে ভারত কিন্তু বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দিয়েছিল। আজ এত বছর পরে তাই এই স্মৃতিচারণা খুব জরুরি। কেননা আগামী দিনে এই মৈত্রীর বার্তা নিয়ে এসব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দুই দেশের মধ্যেই জঙ্গি-কট্টরবাদী রয়েছেন। তাঁরা ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক মধুর হতে দিতে চান না। সংঘাতের মধ্য দিয়েই তাঁরা তাঁদের স্বার্থ পরিপূর্ণ করতে চান। কিন্তু এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী দুজনই এই কট্টরবাদী জনসমাজকে অবজ্ঞা করে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন। এটাই হলো সবচেয়ে বড় আশার কথা।

লেখক : নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ