বাংলাদেশের ঠিকানা ব্যবহার করে লেখাপড়া করছেন রোহিঙ্গারা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:  মিয়ানমারের মংডুর তুলাতুলি এলাকার গুড়া মিয়ার ছোট ছেলে রহমত উল্লাহ।  সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে রহমতের পরিবার বাংলাদেশে এসে  আশ্রয়ে নিয়েছে। যদিও ২০১২ সাল থেকেই বাংলাদেশে আছেন এই তরুণ। তখন থেকেই তিনি বাংলাদেশে লেখাপড়া করছেন। বর্তমানে চট্টগ্রামের রাত্তারপুল এলাকার মজিদিয়া ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসার শিক্ষার্থী তিনি।

রহমত প্রথমে নগরীর বহদ্দারহাট আবাসিক এলাকার পাশে অবস্থিত ‘দারুল মারিফ মাদ্রাসায়’ পড়তেন।  গত বছর তিনি মজিদিয়া ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষা দেন । বর্তমানে আলিম প্রথম বর্ষে পড়ছেন রহমত।

ওই মাদ্রাসায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রহমত মাদ্রাসায় ভর্তির সময় তার বাবা-মায়ের সঠিক নাম ব্যবহার করলেও ঠিকানা দিয়েছেন বাংলাদেশের। বাড়ির ঠিকানায় লেখা আছে, গ্রামের বাড়ি টেকনাফের কানজর পাড়া। বাবার নাম গুড়া মিয়া, আর মায়ের নাম ফরিদা খাতুন। তার দাখিল পরীক্ষার রোল নম্বরের জায়গায় লেখা আছে-২৩২০২৬।

কিভাবে বাংলাদেশের মাদ্রাসায় ভর্তি হলেন জানতে চাইলে রহমত কিছুই বলতে রাজি হননি। তার দাবি,‘শুধু সে-ই নয়, তার মতো আরও অনেক রোহিঙ্গা তরুণ নগরীর বিভিন্ন কলেজ,মাদ্রাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছেন। এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও কয়েকজন পড়াশোনা করছেন।’

রহমত বলেন,‘আমাদের এলাকার যাদের টাকা-পয়সা আছে, তাদের অনেকের ছেলে সন্তান চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করছেন। গত বছর আমার গ্রামের এক ব্যবসায়ী তার ছেলেকে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি করিয়েছেন।’

মিয়ানমারের ঠিকানা ব্যবহার করে ওই ছেলেকে ভর্তি করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা পরিচয় দিলে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভর্তি করতে চায় না। তাই বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয় দিয়ে আমাদের ভর্তি হতে হয়।’

এ বিষয়ে মজিদিয়া ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. ওসমান গনি  বলেন,‘আমরা কোনও রোহিঙ্গাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করি না। তবে কেউ যদি বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয় দিয়ে ভর্তি হয়, তখন আমাদের পক্ষে তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না।’

রহমতের বিষয়ে তিনি বলেন,‘সে তো বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ভর্তি হয়েছে। আর আমাদের এই প্রতিষ্ঠান থেকে সে দাখিল পরীক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু এর আগে তো সে আরও দু’টি সরকারি পরীক্ষা দিয়েছে। সেগুলো কিভাবে দিলো?

শুধু এই তরুণ নয়,তার মতো অসংখ্য রোহিঙ্গা তরুণ পরিচয় গোপন করে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন। অনেকে  সরকারি-বেসরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে এখন বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াশোনা করছেন।

বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে এরকম কয়েকজন রোহিঙ্গা যুবকের পরিচয় পাওয়া গেছে।  এদের একজন চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে পাস করা রোহিঙ্গা মো. ইউনুস। ২০১৩ সালে পাস করেন তিনি। কবির হোসেন নামে আরেক রোহিঙ্গা যুবক ২০১২ সালে  একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে পাস করেছেন। বর্তমানে তিনি মালয়েশিয়ায় রয়েছেন।

স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক পূর্বদেশের স্টাফ রিপোর্টার এম এ হোসাইন জানিয়েছেন,তার এক বন্ধুর সঙ্গে ইরফান নামে এক রোহিঙ্গা তরুণ আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। ২০০৬ সালে ওই রোহিঙ্গা তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ২০১০ সালে তিনি মাস্টার্স শেষ করে বর্তমানে চাকরি করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,এসব রোহিঙ্গা তরুণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সময় ক্যাম্পের ঠিকানা ব্যবহার করেননি। তারা সবাই বাংলাদেশের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচয়পত্র জোগাড় করে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন।

এ বিষয়ে মোহাম্মদ ইউনুস জানান, কুতুপালং ক্যাম্পের ঠিকানা ব্যবহার করে উচ্চ শিক্ষা শেষ করেছেন তিনি। তার দাবিক্যাম্পের স্কুলে শুধু সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা যায়। তারপর আর সেখানে পড়াশোনার  সুযোগ নেই। এরপর যারা পড়াশোনা করেন, নিজের পরিচয় গোপন করে করতে হয়।

যারা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন তারা কিভাবে ভর্তি হন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘অনেকে টেকনাফের বাসিন্দা পরিচয় দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। আবার কেউ কেউ ক্যাম্পের পরিচয় দিয়েও ভর্তি হন। তবে যারা ক্যাম্পের পরিচয় দিয়ে ভর্তি হন , তাদের পরিচয় ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা জানলেও তারা অন্য শিক্ষার্থীদের কাছে প্রকাশ করেন না।’

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের রেজিস্ট্রার কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ কাশেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা কোনও রোহিঙ্গাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করি না। রোহিঙ্গারা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে, এ ধরনের কোনও তথ্য আমার জানা নেই। যদি কোনও রোহিঙ্গা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে থাকেন, তবে তারা পরিচয় গোপন করে অবশ্যই বাংলাদেশি নাগরিক পরিচয় দিয়ে ভর্তি হয়েছেন।’

তিনি বলেন,‘আমাদের সঙ্গে চীনভারতশ্রীলঙ্কামালদ্বীপনাইজেরিয়াসোমালিয়া এসব দেশের সঙ্গে চুক্তি আছে। ওইসব দেশের শিক্ষার্থীরা আবেদন করলে এবং আমাদের রিকোয়ারমেন্ট পূর্ণ হলে, আমরা শুধু তাদের ভর্তি করাই।’

তিনি আরও বলেনএখন যেহেতু বিষয়টি জেনেছি, তাই পরবর্তীতে শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর সময় আমরা তাদের পরিচয় আরও যাছাই-বাছাই করবো। বিশেষ করে যারা কক্সবাজার অঞ্চল থেকে আসবে, তাদের ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করবো।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে ১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে ক্যাম্পে থাকা শিশু-কিশোররা পড়াশুনা করতে পারে। ওই স্কুলগুলোতে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত তারা পড়াশোনা করতে পারে। এর বাইরে যারা পড়াশোনা করে, তাদেরকে পরিচয় গোপন করে বাংলাদেশি নাগরিক পরিচয় দিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি,  ক্যাম্পে থাকা ৬০-৭০ শতাংশ কিশোরই ওই স্কুলগুলোতে পড়াশোনা করে থাকে। তাদের পাঁচ শতাংশ পরবর্তীতে পড়ালেখা চালিয়ে যায়। এরা মূলত নিজেদের বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয় দিয়ে উখিয়া,কক্সবাজারসহ আশপাশের এলাকার স্কুলগুলোতে ভর্তি হয়। এরপর যাদের পরিবারের টাকা-পয়সা আছে, তারা চট্টগ্রাম শহর ও কক্সবাজারের বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হয়ে অনার্স ও মাস্টার্স করছেন। গড়ে প্রতি বছর ৭০-৮০ জন রোহিঙ্গা তরুণ বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স করে বের হচ্ছেন।

 

সূত্র: বাংলাট্রিবিউন