‘ব়্যাংকিংয়ে ২০০ পার করতে যা করা দরকার, সালাহউদ্দিন তাই করবে’

আগামী ৩ ডিসেম্বরের বাফুফে নির্বাচনে সভাপতি হিসেবে ফেবারিট হিসেবে ধরা হচ্ছে কাজী সালাহউদ্দিনকে। যিনি গত ১২ বছর ধরে এই পদে আছেন। ২০১৬ সালে কাজী সালাহউদ্দিনের প্রকাশ্য ঘোষণা ছিল, এটিই তার শেষ নির্বাচন। কিন্তু চার বছর পর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের আরেক নির্বাচনে ঠিকই সভাপতি প্রার্থী তিনি! এক যুগে বাংলাদেশ ফুটবলের দৃশ্যমান উন্নতি না হওয়া সত্ত্বেও এমনটা কেন? যোগ্য বিকল্প না থাকাই কি বড় কারণ?

গত নির্বাচনে সালাহউদ্দিনের বিরোধী পক্ষ হুট করে প্রার্থী করে কামরুল আশরাফ খান পোটনকে। তিনি সংসদ সদস্য, সার ব্যবসায়ী। কিন্তু ফুটবলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। এ কারণে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সারের ডিলারদের দিয়ে সারাদেশে ফুটবলের উন্নতির কথা বলে হাসির পাত্র হন। ভোটের মাঠে সালাহউদ্দিনের সামনে টিকতে পারেননি। সে নির্বাচনে সালাহউদ্দিনের প্যানেলের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন রুহুল আমিন তরফদার। নির্বাচন জয়ের এক-দেড় বছরের মাথায় ফুটবলে তার উপস্থিতি ও প্রভাব বাড়তে থাকে।

মহানগরীর প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় বিভাগের ফুটবল আর জেলা ফুটবলের পৃষ্ঠপোষকতায় রুহুল আমিন চলে আসেন সংগঠকদের সামনের সারিতে। তার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহায়তায় ৫৪ জেলার ফুটবল লিগ আয়োজন হয়। খরচ করেন কোটি কোটি টাকা। এক সময় হয়ে ওঠেন সালাহউদ্দিনের প্রতিদ্বন্দ্বী। এবারের নির্বাচনে বাফুফে সভাপতি পদেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন প্রবলভাবে। কিন্তু এ বছরের গোড়ার দিকে হুট করেই নিজেকে সরিয়ে নেন। পরে সহ-সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা শোনা গেলেও এখন নিজেকে ফুটবল থেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছেন তরফদার।

এরপর নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েও শেষ মুহূর্তে সরে আসেন আরেক সাবেক ফুটবল তারকা বাদল রায়। কিন্তু সময়মতো প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করায় এই ফুটবলার সংগঠকের নাম ব্যালট পেপারে থাকবে। শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে সরে দাঁড়ানোয় বাদল রায়ের পালে হাওয়া কমে গেছে। বাফুফে সভাপতি পদে তৃতীয় প্রার্থী শফিকুল ইসলাম মানিক। আগে থেকে কোনো আওয়াজ ছাড়া হুট করেই দাঁড়িয়ে যান সাবেক এ ফুটবলার ও বর্তমানের কোচ।

এই যখন অবস্থা, তখন আরেকবার বাফুফে প্রেসিডেন্ট হওয়ায় ফেভারিট সালাহউদ্দিন। যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রবল সরব ‘সালাহউদ্দিন আউট’, ‘বয়কট সালাহউদ্দিন’, ‘সালাহউদ্দিন হটাও ফুটবল বাঁচাও’ শ্লোগানে। বাফুফে তো বটেই, এমনকি ফিফার ফেসবুক পেজেও নিজেদের উচ্চকিত উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন তারা প্রবলভাবে। কিন্তু তাতে কি বাফুফেতে পরিবকর্তন আসবে? নাকি বিকল্পের অভাবে আবারও ‘ফাঁকা মাঠে গোল’ দেবেন একসময়ের তুখোড় সেন্টার ফরোয়ার্ড সালাহউদ্দিন?

ফুটবলের সঙ্গে প্রায় ছয় দশক জড়িয়ে থাকা গোলাম সারোয়ার টিপু বাফুফে নির্বাচন নিয়ে কথা বলতেই নারাজ। এটি তার কাছে মনে হচ্ছে খামখেয়ালীপনা, ‘এ নির্বাচন নিয়ে কথা বলতেই ইচ্ছে করে না। যেখানে হারুন সাহেবের (হারুনুর রশিদ) মতো লোক, যিনি বাফুফের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন, এমপি ছিলেন, তিনি সদস্যপদে নির্বাচন করছেন আর আমিরুল ইসলাম বাবু সহসভাপতি পদে নির্বাচন করছেন। এমন নির্বাচন আমার কাছে খামখেয়ালীর মতো মনে হচ্ছে।’

সালাহউদ্দিনের উপর তীব্র বিরক্তিও ফুটে ওঠে জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার ও কোচের কথায়, ‘সালাহউদ্দিন তো ১২ বছরে আমাদের ফুটবলকে একটা দুর্দান্ত জায়গায় নিয়ে গেছে। এখন ফিফা ব়্যাংকিংয়ে ২০০ পেরোনোর জন্য যতটুকু দরকার, ততটুকু করবে। এই তো! ব়্যাংকিংয়ে ১৪৪ থেকে এখন ১৮৭। এখানে উন্নতি তো আছে, কারণ, ১৯৭ পর্যন্ত নেমে গিয়েছিল। ১০ ধাপ এগুনোর উন্নতি আছে। আসলে হারুন সাহেবের মতো লোক যেখানে সদস্যপদে নির্বাচন করছেন, তা নিয়ে কী বলবো! হয় উনি নির্বাচন করবেন না, করলে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করবেন। এখন তো ভাবেসাবে মনে হচ্ছে, সবাই মিলে দল পাকানোর মতো।’

হারুনুর রশিদ বাফুফে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করলে মানাতো বলে দাবি টিপুর। এমনিতেই সামগ্রিক অর্থে সালাহউদ্দিনের বিকল্প কী আছে? প্রশ্নের উত্তর প্রশ্ন দিয়েই দেন তিনি, ‘আমি এখন একটা প্রশ্ন করি। ধরুন, একটা খাবারের ব্যাপারে জানি যে, সেটি খারাপ। আমি কী সেটি খাবো? না জেনে খারাপ খাবার খেতে পারি। যদি জানি এ খাবারটা নষ্ট হয়ে গেছে, এটি খেলে পেটে সমস্যা হবে; আরেকটি খাবার ভালো নাকি খারাপ জানি না, গন্ধ-টন্ধ পাচ্ছি না–তাহলে কোনটি বেছে নেবো, আমাকে বলুন? এখানেই তো উত্তর আছে।’

টিপু বরং ভাবছেন পরিবর্তনের কথা। সালাহউদ্দিনের জায়গায় অন্য যে কেউ এলে বাংলাদেশ ফুটবলের অবস্থা বর্তমানের চেয়ে খারাপ হবে না বলে দাবি তার, ‘প্রথমবার সালাহউদ্দিন যখন নির্বাচন করেন, তখন তার প্লেয়িং ব্যাকগ্রাউন্ড, সুন্দর চেহারা, অর্ধেক বাংলা অর্ধেক ইংরেজি মিলিয়ে কথা বলে সবাইকে ইমপ্রেস করেছেন। নির্বাচত হয়ে গেলেন। প্রথমবার গেল, দ্বিতীয়বার গেল, তৃতীয়বার গেল, এরপরও যদি আমাদের বোধোদয় না হয়, তা হলে ঠিক আছে। চলুক। ১২ বছর দেখার পরও বলছি বিকল্প নেই। ‘

তিনি আরও বলেন, ‘আমার কথা হলো, এর চেয়ে খারাপ আর কী হবে! ফিফা ব়্যাংকিংয়ে এখন আমরা ১৮৭ নম্বরে। ফিফা সদস্য ২১০। এর চেয়ে খুব বেশি খারাপ আর কী হবে! এখন টম-ডিক-হ্যারি যে-ই বাফুফে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসুক, এখনকার চেয়ে ভালো না হলেও খারাপ হওয়ার খুব সুযোগ তো নাই। পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখার কোনো সুযোগ নেই। বাদলের শরীর ভালো না, আবার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সেটি প্রত্যাহার করলে আগেই করা উচিত ছিল। সময় পেরিয়ে যাবার পর কেন? আর মানিকের মধ্যে ১০০% সততা আছে। এখন ও কার্যকর হবে কিনা, ভালো করবে কিনা, তা জানি না। তবে এর চেয়ে খারাপ আর কী করবে!’

শফিকুল ইসলাম মানিক হুট করেই দাঁড়িয়ে গেছেন নির্বাচনে। বলা যেতে পারে, তেমন কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই। নিজেই বলেছেন তা, ‘ঠিক প্রস্তুতি না। তবে মনের অজান্তে হয়তো ভেবেছি। এবার দেখলাম, প্রার্থী হবার জন্য যারা কাজ করছিলেন, তারা একে একে সবাই বিদায় নিয়েছে। প্রতিবাদমুখর যারা ছিলেন, তারাও পিছিয়ে যাচ্ছেন। নমিনেশন পেপার যখন বিক্রি হচ্ছে, তখনই ভেবেছি, আমি বাফুফে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের চিন্তা করতে পারি কিনা, আমি নিজে এ পদের উপযুক্ত কিনা। তখন মনে হয়েছে, হ্যাঁ, কেন নয়?’

এক যুগ আগের সালাহউদ্দিনের সঙ্গে নিজের বর্তমান অবস্থানের তুলনা করেন মানিক। আর তাতে নিজেকে পিছিয়ে রাখছেন না খুব একটা, ‘১২ বছর আগে উনি যখন বাফুফে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন, তখন ওনার অবস্থান কী ছিল? উনি বাংলাদেশের গ্রেট এক ফুটবলার। কিন্তু সংগঠক ছিলেন না। মাঝেমধ্যে কোচিং করিয়েছেন, মাঝেমধ্যে ছেড়ে দিয়েছেন। ১২ বছর আগের সালাহউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আমার নিজের বর্তমান সময়কে তুলনা করলে উনি শুধু এগিয়ে থাকবেন গ্রেট প্লেয়ার হিসেবে।’

নির্বাচনে তাই ‘আউটসাইডার’ হয়েও নিজের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখেন মানিক। শুধু চান নির্বাচন যেন সুষ্ঠু হয়, ‘যদি ভোটারদের অনাকাঙ্খিত বা মনের বিরুদ্ধে কিছু না করতে হয়, তাহলে আমার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। অল্প কিছু ভোটের ব্যাপার তো। এর সুযোগ নিতে পারে অনেকে। আমি বলছি না, অর্থের বিনিময়ে বা বল প্রয়োগ করে ভোট কিনুক। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। যদি কাউন্সিলররা মনের ইচ্ছে প্রয়োগ করতে পারে, তাহলে আমার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।’

– ডয়চে ভেলে অবলম্বনে

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ