বর্ষা শেষে উজানের ঢলে পদ্মায় প্রতিদিন বাড়ছে পানি দেখা দিয়েছে বন্যা আতঙ্ক

নিজস্ব প্রতিবেদক:
ষঢ় ঋতুর দেশে হিসেবে আষাঢ়, শ্রাবন ভাদ্র মাসকে ধরা হয় বর্ষাকাল। বর্ষাকাল মানেই প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হবে। খাল-বিল মাঠ-ঘাট, পুকুর-পুষ্কুরনি বৃষ্টির পানিতে ভরে যাবে। থৈ থৈ পানিতে ভরে থাকবে নদী। কিন্তু এবার বর্ষাকালে এসবই ছিল অনুপস্থিত। বর্ষাকাল শুরু হওয়ার আগেই এবার গ্রীষ্মকালে প্রপচুর পরিমাণে বৃষ্টির দেখা মেলে রাজশাহীসহ সারাদেশে। কিন্তু গোটা বর্ষাকাল কেটে গেছে প্রায় বড় ধরনের বৃষ্টিহীন অবস্থায়। ফলে এবার তেমন পানি দেখা যায়নি। পানির ওভাবে এবার আউষ-আম ধানচাষেও বিঘ্ন ঘটেছে। এখনো একই অবস্থা বিরাজ করছে। শুধুমাত্র পদ্মা, তিস্তাসহ দেশের বড় কয়েকটি নদী ছাড়া। এই নদীগুলোও বর্ষা শেষে এখন ভরে গেছে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাজশাহীতে পদ্মা নদীতে গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে অব্যাহতভাবে যেভাবে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে রিতিমতো বন্যার আশঙ্কায় দেখা দিয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্রতিদিন ৪-৫ সেন্টিমিটার হারে পানি বাড়ছে। এতে বন্যা আতঙ্ক দেখা দেখা দিয়েছে। আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন পদ্মাতীরবর্তি ও বিভিন্ন চরাঞ্চলের মানুষ। এরই মধ্যে রাজশাহীর পদ্মাতীরবর্তি নিচু এলাকাগুলো ডুবে গেছে। নগরীর শ্রীরামপুর থেকে পঞ্চবটির বিভিন্ন এলাকা ডুবে গেছে। এছাড়াও পদ্মার ওপারে সীমান্তবর্তি চরগুলোতেও দেখা দিয়েছে বন্যা। যদিও নদীর পানি এখনও বিপদসীমা অতিক্রম করেনি। তবে এভাবে পানি বাড়তে থাকলে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে ধারণা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
রাজশাহী পাউবোর গেজ রিডার এনামুল হক জানান, প্রতিদিনই পদ্মার পানি চার-পাঁচ সেন্টিমিটার করে বাড়ছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে পদ্মায় রাজশাহীতে পানির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ১৭ দশমিক ১৬ মিটার। এর আগে শনিবার দুপুর ১২টায় রাজশাহী নগরীর বড়কুঠি পয়েন্টে পদ্মার পানির উচ্চতা ছিল ১৭ দশমিক ৪ মিটার। গত শুক্রবার ভোরে ছিল ১৬ দশমিক ৯৬ মিটার। সন্ধ্যা ৬টায় ছিল ১৭ মিটার। গত রবিবার সকালে ছিল ১৭ দশকি ৮ মিটার এবং সোমবার সেটি গিয়ে দাঁড়ায় ১৭ দশমিক ১৪ মিটার।
এনামুল হক জানান, রাজশাহী অঞ্চলে পদ্মার পানির বিপদসীমা ১৮ দশমিক ৫০ মিটার। এখন প্রতিদিন পানি বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এবার ভরা বর্ষায় পদ্মার বুকে অধিকাংশ স্থানে চর দেখা গেলেও বর্ষা শেষে উজানের পানিতে এখন পদ্মায় যেন ভরা যৌবন ফিরে পেয়েছে।
তিনি আরো জানান, ভারতীয় অংশে মহানন্দা নদীতে পানি বিপদসীমার মাত্র এক মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এভাবে পানি বাড়তে থাকলে আগামি ৭-৮ দিনের মধ্যে ভারতের মহানন্দা বিপদসীমা অতিক্রম করবে। তখন বাংলাদেশের পদ্মায়ও পানি আরো বাড়বে। এমনি বিপদসীমা অতিক্রম করে বন্যাও দেখা দিতে পারে। তবে বন্যা। এর আগে ২০১৬ সালে বছর রাজশাহীতে পদ্মায় সর্বোচ্চ পানির উচ্চত ছিল ১৮ দশমিক ৪৪ মিটার।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘প্রতিবছর বর্ষায় ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেওয়া থাকে। ফারাক্কা বাঁধের পানি ধরে রাখার সক্ষমতা ৫০ হাজার কিউসেক। এর অতিরিক্ত পানি ধরে রাখতে পারে না। ফলে বর্ষণের পানি ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে এসে পদ্মার পানির উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা আরো বাড়তে পারে। তবে বন্যা নিয়ে এখনো আমরা শঙ্কিত নয়। যদিও দিল্লি থেকে বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, রাজশাহীতে পদ্মায় পানি বাড়লেও বাঁধের কোথাও কোনো ধরনের ক্ষতি হলেই সেটি তাৎক্ষণিক অস্থায়ীভাবে সংস্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাতে করে বাঁধ ভেঙে পড়ে পদ্মার পানি শহরে প্রবেশ করতে না পারে। তবে রাজশাহীর বাধগুলো ১৯৮২ সালের দিকে তৈরী করা বলে সেগুলো এমনেিতই একটু হলেও দুর্বল হয়ে আছে। সেইদিক থেকেও আমরা সতর্ক আছি।’
এদিকে পানি বৃদ্ধি সঙ্গে সঙ্গে নগরীর পদ্মা নদীর তীল সংলগ্ন সিমলা পার্ক, লালন শাহ পার্ক, পদ্মা গার্ডেন, বড়কুঠি, কুমারপাড়া, আলুপট্টি এলাকায় বাঁধের উচ্চতার অনেকটা কাছাকাছি অবস্থান করছে পানি। নগরীর পঞ্চবটি, শ্রীরামপুরসহ বিভিন্ন নিচু এলাকাগুলোতে পানি উঠে গেছে। এছাড়াও চরাঞ্চলগুলোতে দেখা দিয়েছে বন্যা। রাজশাহীর মধ্যচর, বাঘা এবং গোদাগাড়ীর কয়েকটি চরে বন্যা দেখা দিয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
এদিকে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ভূতত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং পনি বিষেøশক চৌধুরী সারোয়ার জাহান সজল বলেন, ‘চীনের সাংহু নদীতে গত ৫০ বছরের মধ্যে রেকর্ড পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ওই নদীর পানি এসে ভারতের অরুণাচল ও আসামে এরই মধ্যে বন্যার সৃষ্টি করেছে। উজান থেকে নেমে আসা সেই পানি বাংলাদেশের পদ্মা, ও তিস্তায় এসে পড়ছে। এতে করে এসব নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি বন্যার আশঙ্কাও রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এবার গোটা বর্ষাকালে বৃষ্টির দেখা মেলেনি তেমন। কিন্তু গত বছর বর্ষার সময় প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি কারণে আমাদের দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এ এবার বর্ষার সময় বৃষ্টি না হওয়ায় মাঠ, ঘাট বা নদীগুলো প্রায় শুকিয়ে ছিল। এখন উজান থেকে নেমে আসা পানিতে ভরে গেছে পদ্মাসহ কয়েকটি নদী। এটি প্রকৃতির বিষ্য়মকর আচরণের কারণেই হচ্ছে। এক বছর ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে, তো আরেক বছর নাই বা বর্ষা শেষে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে হচ্ছে বন্যা।’
রাজশাহীর পবার বড়গাছী গ্রামের কৃষক আকবর আলী বলেন, এখনো বিলে ধানের জমিতে পানি নাই। কিন্তু এই সময়ে ধানের জমিতে প্রায় হাঁটু পানি থাকে। সেই পানিতেই ধানচাষ হয়ে যায়। অথচ গত তিন-চারদিন আগেও এবার ধানের জমিতে পানি সেঁচ দিতে হয়েছে। কিন্তু এখন শুনছি পদ্মায় নাকি পানি বেড়েছে ব্যাপক হারে। এমনকি বন্যাও হতে পারে। প্রকৃতি কখন কি আচরণ করছে বলা মুশকিল।