বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে হবে

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ে। এ স্থবিরতা কাটিয়ে বৈশ্বিক উৎপাদন ও ভোগ চাহিদা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার আগেই গত ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিশেষ করে জ্বালানি তেল, গ্যাস, গম, ভুট্টা, ভোজ্যতেল, সার ইত্যাদির সরবরাহ চেইন ও রফতানি বাধ্যগ্রস্ত হয়। এর প্রভাবে প্রায় সব দেশেই মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস লক্ষণীয় হয়ে ওঠে।

বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মূল্যস্ফীতি বিগত আট-নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের কাছাকাছি এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মূল্যস্ফীতি ৬-৭ শতাংশ অতিক্রম করে। মূল্যস্ফীতির কারণে উন্নয়নশীল দেশের অনেকেই নিজ নিজ দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপের মিত্রদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে শুধু রাশিয়া নয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বৈরি পরিস্থিতির প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকও নেতিবাচক ধারায় পতিত হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের অর্থনীতিও অনেকটা চাপের মুখে। এ প্রসঙ্গে দেশে নানাজন নানামুখী আলোচনায় মেতে উঠেছে। গঠনমূলক আলোচনা ভালো, তবে জেনে না জেনে অহেতুক আতঙ্ক ছড়ানো হলে অর্থনীতিতে আরো নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

উপযুক্ত বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কিছু সূচক ও উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হলো।

মূল্যস্ফীতি

বিবিএসের সাম্প্রতিক হিসাব মতে, জুন মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বিগত নয় বছরের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরো বেশি। বেসরকারি হিসাব মতে, দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতি বর্তমানে সরকারের নীতিনির্ধারকদের উদ্বেগের বিষয়। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের কৃষির প্রতি আরো নজর দিতে হবে। সার, কৃষি যন্ত্রপাতি, সেচের বিদ্যুৎ ইত্যাদিতে ভর্তুকি অব্যাহত ও নতুন ভর্তুকি অন্তর্ভুক্ত করে খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। কৃষি গবেষণার উৎকর্ষের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কালোবাজারি, অতিমুনাফা, মজুদদারি, কার্টেল প্রভৃতি রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। রেশনিং ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা অব্যাহত রাখা এবং সত্যিকারভাবে প্রাপ্য ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে।

মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও সুদের হার, রেপোরেট, কলমানি, ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের সুদের হার নয়-ছয় শতাংশই আছে। পরিবর্তনের আভাস থাকলেও এ হার এখনো অপরিবর্তিত আছে।

ঋণের সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথাই অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন। তবে দেশের উৎপাদনের খাতভিত্তিক প্রয়োজন ও ঝুঁকি বিবেচনায় ঋণের উচ্চসীমা ১২-১৪ শতাংশে নির্ধারণ করা যেতে পারে। সঞ্চয় উৎসাহিত করা এবং আমানতকারীদের মূল্যস্ফীতির চেয়ে অধিক হারে সুদ প্রদানের স্বার্থে আমানতের ওপর সুদের নিম্নসীমা ৯ শতাংশে ধার্য করা যেতে পারে। সুদের হার বৃদ্ধি করা হলে শিল্প উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাবের কথা বলতে পারেন। মূল্যস্ফীতি রোধে অর্থনীতিতে সাময়িক শ্লথগতি গ্রহণযোগ্য। তবে দীর্ঘমেয়াদে শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, ‘ইকোনমি অব স্কেল’ ইত্যাদির মাধ্যমে পুঁজির ২-৩ শতাংশ উচ্চমূল্য সমন্বয় করতে পারবেন।

বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদের হার বাড়ানো হলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তারল্য সংকট কমবে এবং লভ্যাংশ বাড়তে পারে। ফলে ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলা দূরীভূত হবে।

খেলাপি ঋণ

বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল সমস্যা খেলাপি ঋণের আধিক্য। ঋণ প্রদানে ব্যাংক কর্মকর্তাদের আরো সতর্কতার পাশাপাশি ঋণ আদায়ে আন্তরিকতা ও কঠোরতার বিকল্প নেই। খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের প্রতি সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতি নমনীয় নীতিমালা ঋণ আদায়ে অনুকূল নয়। এর আগে ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দিয়ে আরো একটি আদেশ জারি করে। আবার ঋণ পরিশোধের সময়ও আগের দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ আট বছর বৃদ্ধি করা হয়েছে।

বাংলাদেশে ব্যাংকঋণ নিয়ে পরিশোধ না করার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, এ সুযোগের ফলে তা আরো বাড়বে। কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কমবে, কিন্তু বাস্তবিক ব্যাংকের ঋণ আদায় বাড়বে না। বরং আগের খেলাপি ঋণ নিয়মিত করে এসব ঋণগ্রহীতা আরো ঋণ নিতে পারবেন। তাছাড়া খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের বিষয়ে ব্যবস্থা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব ব্যাংক পর্ষদের ওপর ছেড়ে দেওয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে পর্ষদ আরো স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে। কারণ বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকে ব্যাংক মালিক ও পর্ষদ সদস্যদের কেউ কেউ নামে-বেনামে খেলাপি ঋণগ্রহীতা। করোনা মহামারির কারণেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে, করোনাকালে অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা নতুন ঋণ দেয়া হয়েছে।

তারও একটি বড় অংশ অনাদায়ী হয়ে পড়েছে। চলতি মাসের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। এর আগে ২ শতাংশ জমা দিয়ে যারা ঋণ পুনঃতফসিল করেছে তাদের বাদ দিয়ে এ খেলাপি ঋণ হিসাব করা হয়েছে। বারবার সুবিধা দিয়ে খেলাপি ঋণ কমিয়ে ফেললে ঋণ আদায় করা কষ্টকর হবে। এক হিসাবে দেখানো হয়েছে, এভাবে পুনঃতফসিলীকরণ না করা হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হতো প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। আইএমএফের হিসাব মতে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা।

এমন অভিযোগও রয়েছে, ঋণখেলাপিদের অনেকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে অর্থ পাচার করে। এ অর্থ কখনো দেশে আসবে না এবং ব্যাংকের ঋণও পরিশোধ হবে না। খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সাবেক গভর্নর পরামর্শ দিয়েছেন। তাছাড়া সম্প্রতি আইএমএফও খেলাপি ঋণ আদায়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বলেছে।

মানি লন্ডারিং

বিদেশে অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। আমদানি-রফতানির ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। হুন্ডির মাধ্যমে সরাসরি ও প্রচুর অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটে। আবার বর্তমানে ডলারের সঙ্গে টাকার মূল্যের অবনমনের ফলে রফতানিকারকরা তাদের রফতানি মূল্য দেশে আনতে বিলম্ব করছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের নৈতিকতা এবং দেশপ্রেম বলতে কিছু নেই।

এবারের বাজেটে পাচারকৃত টাকা দেশে এনে বৈধ করার জন্য করছাড় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়ের বিপরীতে কোনো সাড়া পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বছরে বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়।

ঋণখেলাপি ও পাচারকারীদের চিহ্নিত করে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, এনবিআর ও দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

টাকার অবমূল্যায়ন

বাজারের চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে টাকার যৌক্তিক অবমূল্যায়ন প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত প্রতি ডলারের দাম ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা। কিন্তু ২৬ জুলাই খোলাবাজারে ১ ডলার ১১২-১১৩ টাকায় বিক্রি হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এলসি খোলার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত হারে ডলার বিক্রি করতে পারছে না। ব্যাংকগুলোকে ডিলারদের কাছ থেকে ১০৫-১০৬ টাকায় ডলার কিনতে হয়।

ফলে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিত বাজারে ডলার বিক্রি করা সত্ত্বেও ডলারের সংকট একশ্রেণির লোকের কারসাজি বলে অনেকে মনে করেন। যদিও বিগত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ১১ শতাংশ, তথাপি স্থিতিশীলতার জন্য আরো অবমূল্যায়ন প্রয়োজন। ফলে বিদেশে পর্যটন, চিকিৎসা ও বিলাসদ্রব্য আমদানি হ্রাস পাবে এবং আমাদের রফতানি লাভবান হবে। বিশ্বের প্রায় সব মুদ্রাই ডলারের বিপরীতে অবমূল্যায়ন হয়েছে। কাজেই টাকার অবমূল্যায়নে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।

রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি

কোভিডের মধ্যেও বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ, যা বাাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর কারণ হতে পারে কোভিডের সময়ে প্রবাসীরা লোক মারফত বৈদেশিক মুদ্রা না পাঠিয়ে বৈধপথে প্রবাসী আয় পাঠায়। দ্বিতীয়ত ২ শতাংশ সরকারি প্রণোদনা। এ সময়ে হুন্ডি ব্যবসা কম হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী বছরে হুন্ডির ব্যবসা পুনরায় চালু, খোলাবাজারে ডলারের দর বৃদ্ধি ইত্যদি কারণে বৈধপথে বৈদেশিক আয় বিগত বছরের তুলনায় কম এসেছে। সেজন্য প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়েছে (-১৫.১২ শতাংশ)। বৈধপথে বৈদেশিক মুদ্রা আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দর ও বাজারদরে সমতা বিধান প্রয়োজন।

বাণিজ্য ঘাটতি

গত অর্থবছরে (২০২১-২২) রেকর্ড পরিমাণ আমদানি ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮৩ বিলিয়ন ডলার এবং রফতানি আয় হয়েছে ৫২ বিলিয়ন ডলার। উচ্চ আমদানি ব্যয়ের পেছনে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। প্রথমবারের মতো রেকর্ড ৫২ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় হওয়া সত্ত্বেও বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে টান পড়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ

গত বছর আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার, যা বর্তমানে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। রফতানি আয় বৃদ্ধি ও ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রবাসী আয়ে রেকর্ড প্রবৃদ্ধিতে আমাদের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। ডলারের সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের ডলারের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে।

তাছাড়া গত ১২ জুলাই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) প্রাপ্য ১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। উপরন্তু বর্ধিত আমদানির চাপে রিজার্ভ ৪০ বিলিয়নের নিচে নামে। তবে এতে চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। বৈদেশিক মুদ্রার চাপ কমানোর জন্য সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেছে। ৫০ লাখ ডলারের ঊর্ধ্বে আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদনের বিধান করা হয়েছে।

রিজার্ভ নিয়ে প্রতিনিয়ত নানা আলোচনা হচ্ছে। আইএমএফের মতে, রফতানি উন্নয়ন তহবিলে (ইডিএফ) বিনিয়োগ করা ৭ বিলিয়ন ডলার, জিটিএফ ২০ কোটি ডলার, এলটিএফ ৩ কোটি ৮৫ লাখ ডলার, পায়রা বন্দরে প্রদত্ত ঋণ ৬৪ কোটি ডলার, বাংলাদেশ বিমানকে প্রদত্ত ঋণ ৪ কোটি ডলার এবং শ্রীলঙ্কাকে প্রদত্ত ২০ কোটি ডলার বাদ দিলে প্রকৃত রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হতে পারে।

বিগত দুই মাসে ডলারের সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বিক্রীত প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে রিজার্ভের পরিমাণ আরো কমে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে এ রিজার্ভে চার মাসের আমদানি ও উন্নয়ন ব্যয় নির্বাহ করা যাবে। তবে রিজার্ভে প্রতিনিয়ত বৈদেশিক মুদ্রাও আসছে। গত বছর প্রায় ৮ লাখ বাংলাদেশি নতুন করে চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন। ইউরোপের দেশগুলোয় রফতানি কিছুটা সংকুচিত হলেও চীনের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি কমবে না, বরং বাড়বে বলে আশা করা যায়।

বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি ও মন্দার হাতছানিতে পৃথিবীর বহু দেশেই রিজার্ভ কমেছে। চীনে গত সাত মাসে ২০০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ কমে ৩ হাজার ২৫০ বিলিয়ন থেকে ৩ হাজার ৫০ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। জাপানে ১০০ বিলিয়ন কমে ১ হাজার ৪০০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১ হাজার ৩০০ বিলিয়নে নেমেছে। সুইজারল্যান্ডে কমেছে ১১০ বিলিয়ন ডলার। আগের রিজার্ভ ৯৫০ বিলিয়ন থেকে বর্তমানে ৮৪০ বিলিয়নে নেমেছে। ছয় মাস আগে ভারতের রিজার্ভ ৬০০ বিলিয়ন ডলারের ওপর ছিল, বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৫৭২ বিলিয়ন ডলারে। পাকিস্তানের বর্তমান রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন এবং শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলারেরও কম।

কাজেই বাংলাদেশের রিজার্ভ এখনো সন্তোষজনক বিবেচনা করা যায়। সরকার যেসব ব্যয় সংকোচন, বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়, জ্বালানি ব্যবহারে মিতব্যয়িতা শুরু করেছে তা ইতিবাচক। তবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের আমদানি অব্যাহত রেখে সম্ভাব্য জ্বালানি সংকট মোকাবিলা করতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ স্থিতিশীল না হলে দেশীয় শিল্পের উৎপাদন বিঘ্নিত হবে। যেকোনো বিশ্বমন্দায় বাংলাদেশে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও ভোগ চাহিদা বর্তমান থাকায় আমরা বিরূপ প্রভাব বোধ করিনি। এবারো সম্ভাব্য বৈশ্বিক মন্দায় আমাদের অর্থনীতি সচল রাখতে হবে।

বৈদেশিক ঋণ

বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ জিডিপির প্রায় ১৩ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ২০২২ সালের রিপোর্টে বাংলাদেশকে ঋণ পরিশোধের দিক থেকে কম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ এ পর্যন্ত বাংলাদেশ কখনো বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বিলম্ব করেনি। অর্থ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের মধ্যে যে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে এর মাধ্যমে বাজেট বরাদ্দের বিপরীতে যথাসময়ে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর প্রাপ্য ঋণ পরিশোধিত হয়। আমাদের ঋণের ৮০ শতাংশই দীর্ঘমেয়াদি এবং স্বল্পসুদে গৃহীত। গ্রেস পিরিয়ডও বেশি। এ ঋণের ৭৫ শতাংশই সরকারের, বাকি ২৫ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নেওয়া। তবে ইদানীং বেসরকারি খাতে গৃহীত ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এর জন্য সরকারকে সভরেন বন্ড দিতে হয়।

সম্প্রতি সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বর্তমানে প্রতি বছর জিডিপির ১ দশমিক ১ শতাংশ হারে বিদেশী দায়দেনা পরিশোধ করা হয়। আগামী ২০২৬ সাল নাগাদ তা প্রায় দ্বিগুণ পরিশোধ করতে হবে। গত ১৯ জুলাই ২০২২ দৈনিক বণিক বার্তায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশি উৎস থেকে ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯৩ দশমিক ২৩ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের বেশ ক’টি প্রকল্প যেমন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল আগামী ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ চালু হয়ে বাণিজ্যিক উৎপাদন/রাজস্ব উপার্জন করবে। সেক্ষেত্রে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে এখন থেকে বড় আকারের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে (সরকারি বা বেসরকারি) প্রকল্পের লাভ-লোকসানের হিসাব (বা আইআরআর) পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করে নেয়া সমীচীন হবে। ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে উন্নয়ন-সহযোগীদের শর্তাদিও ভালোভাবে যাচাই করে দেখতে হবে, যাতে কঠিন শর্তের বেড়াজালে ভবিষ্যতে অসুবিধায় পড়তে না হয়।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট

বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই জ্বালানি সংকট এখন কঠিন বাস্তবতা। একদিকে মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে সরবরাহ চেইনে বিশৃঙ্খলা—এ উভয় সমস্যায় বাংলাদেশেও জ্বালানি তেল ও গ্যাস ব্যবহারে কৃচ্ছ্রসাধন করা হচ্ছে। ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ প্লান্ট বন্ধ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন তেল আমদানির এলসি খুলতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় সরকার দেশব্যাপী দৈনিক ২-৩ ঘণ্টা বাধ্যতামূলক লোডশেডিং করছে।

এ পরিস্থিতিতে শুধু গৃহস্থালি বিদ্যুৎ ব্যবহার নয়, বরং শিল্পোৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর প্রভাব দেশের রফতানিতে পড়তে পারে। যারা জেনারেটর বা ক্যাপটিভ পাওয়ার ব্যবহার করছে তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তবে জ্বালানি তেলের দাম জুনে প্রতি ব্যারেল ১১৬ ডলার থেকে বর্তমানে প্রায় কম-বেশি ১০০ ডলারে নেমে এসেছে। সরবরাহ স্বাভাবিক হলে দাম আরো কমতে পারে।

বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ গ্রহণ

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের খরচ নির্বাহের জন্য এবং বাণিজ্য ঘাটতি মেটানোর জন্য আইএমএফ ও জাইকার কাছ থেকে বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ গ্রহণের জন্য আলোচনা চলছে। লক্ষ্য রাখতে হবে, এ ঋণ যেন এসএমই সহায়তা, উৎপাদনমূলক প্রকল্প এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যবহূত হয়। কোনো ধরনের অনুৎপাদনশীল প্রকল্প, প্রশাসনিক ব্যয় বা ঋণ পরিশোধে যেন ব্যবহার না করা হয়। এ ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রেও শর্তাদি নির্ধারণে যৌক্তিক দরকষাকষি করা সমীচীন হবে।

রাজস্ব সংগ্রহ পরিস্থিতি

আমাদের দেশের প্রায় ৪ কোটি লোকের কর প্রদানের সামর্থ্য থাকলেও মূলত ২৫ লাখ লোক রিটার্ন জমার মাধ্যমে কর প্রদান করে থাকে এবং প্রায় ১ কোটি লোক পরোক্ষভাবে কর দেয়। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এশিয়ায় সর্বনিম্ন। এখনো কর-জিডিপি ৯ শতাংশের কাছাকাছি। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর গড় অনুপাত ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর কর-জিডিপির গড় অনুপাত ২৬ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর কর-জিডিপি ৯-১৯ শতাংশের মধ্যে।

২০২১ সালের মধ্যে আমাদের কর-জিডিপির অনুপাত ১৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০৪১ সালের মধ্যে এ অনুপাত ২৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। প্রতি বছর এনবিআরের রাজস্ব সংগ্রহে প্রবৃদ্ধি থাকলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না। ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৩ লাখ ২০০ কোটি টাকা রাজস্ব সংগৃহীত হলেও তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা কম।

এ অবস্থায় কর-জিডিপি অনুপাত তথা রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে কর ফাঁকি রোধ করতে হবে, করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে। এনবিআরের অটোমেশন দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।

প্রত্যক্ষ কর ও ভ্যাট সংগ্রহ অটোমেশন প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করলে রাজস্ব বাড়বে। প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে এনবিআরের জনবল বৃদ্ধি করে থানা পর্যায় পর্যন্ত কর অফিস সম্প্রসারণ করতে হবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ বৃদ্ধির জন্য অতি দ্রুত সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় দেশীয় ব্যাংক ও বিদেশী উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে দেশের ঋণের বোঝা আরো বাড়বে।

উপরের আলোচনায় দেশের অর্থনীতির যে সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হলো তাতে সাবধান হওয়ার প্রয়োজন আছে, কিন্তু আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ‘দেশের অর্থনীতি খাদের কিনারে’ কিংবা ‘শ্রীলংকার অবস্থার দিকে যাচ্ছে’ বলে যারা প্রচার করছে, তারা দেশবাসীকে অহেতুক আতঙ্কগ্রস্ত করে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এরূপ অপপ্রচারের কারণে দ্রব্যমূল্য, বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে টাকার মান এবং ব্যাংক ব্যবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। এ ব্যাপারে দেশবাসীকে সতর্ক থাকতে হবে।

মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া: সাবেক সিনিয়র সচিব; জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান; বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

 

 

সুত্রঃ জাগো নিউজ