বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচ সংকটে ধুঁকছে বোরো: বাড়ছে অন্যান্য ফসল

নিজস্ব প্রতিবেদক:

দিনের পর দিন সার-কীটনাশকের দাম ও শ্রমিক খরচ বাড়ছে। ধানের ন্যায্য মূল্যও মিলছে না। ফলে বোরো চাষে ক্রমেই আগ্রহ হারাচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা। ধানের বদলে তারা গম, আলু, তুলাসহ অন্যান্য ফসল চাষের দিকে ঝুঁকছে। কোথাও কোথাও ধানি জমিতে মাছ চাষের পুকুর বানানো হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও বোরো মৌসুমে ধানের বদলে অন্য ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে কৃষকদের।

 

এ ছাড়া বরেন্দ্র অঞ্চলে কয়েক বছর ধরে গভীর নলকূপ স্থাপনেরও অনুমোদন দিচ্ছে না সরকার। অথচ এই অঞ্চলে বোরো চাষে সেচের প্রধান উৎস ভূ-গর্ভস্থ পানি। সব মিলিয়ে চলতি বোরো মৌসুমেও এই অঞ্চলে ধান চাষ গত বছরের চেয়ে কম হবে বলে মনে করছেন কৃষিসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ পরিস্থিতিতে খোদ কৃষকরাই বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

 

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র মতে, ২০১২ সালে রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় ধান চাষ হয়েছিল আট লাখ ৮৪ হাজার ৭৪১ হেক্টর জমিতে। পরের বছর বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় আট লাখ ৫২ হাজার ১২৮ হেক্টর জমিতে। এরপর কোনো কোনো জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে দু-এক মৌসুমে ধান চাষ কিছুটা বাড়লেও সার্বিকভাবে রাজশাহীতে বোরো চাষের পরিমাণ কমছে। এখন আট জেলায় বোরো চাষ হচ্ছে প্রায় ছয় লাখ হেক্টর জমিতে।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরও রাজশাহী অঞ্চলের চার জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় সাড়ে ৩৪ হাজার হেক্টর কম জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। সেবার রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর মিলে তিন লাখ ৪০ হাজার ৪৪ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়, যেখানে তিন লাখ ৭৪ হাজার ৬৬১ হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ২০১২ সালেও চার জেলায় বোরো চাষ হয়েছিল তিন লাখ ৭৪ হাজার ৬৬১ হেক্টর জমিতে।

 

২০১৪ সালে রাজশাহীতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৯ হাজার ৭১ হেক্টর জমিতে, তবে চাষ হয়েছে ৬৮ হাজার ৮৬ হেক্টরে। নাটোরে ২০১৩ সালে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৭ হাজার ৪২৫ হেক্টর জমিতে, চাষ হয়েছে ৫৭ হাজার ২২৫ হেক্টরে।

 

২০১৫ সালে নওগাঁয় বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ দুই হাজার ৩২১ হেক্টরে, চাষ হয়েছে দুই লাখ এক হাজার ৯৯৫ হেক্টরে। গত বছর রাজশাহীতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৯ হাজার ৪১১ হেক্টরে, চাষ হয়েছে ৬৬ হাজার ৪৯০ হেক্টরে। নওগাঁয় লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ৯৮ হাজার ৪৬৩ হেক্টর, চাষ হয়েছে এক লাখ ৮৯ হাজার ৫৩৫ হেক্টর।

 

চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬৯ হাজার ৪১২ হেক্টর জমিতে। এ পর্যন্ত আবাদ হয়েছে ২৮ হাজার ২৬ হেক্টরে। এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৪৬ হাজার ৭৩৫ হেক্টর, নাটোরে ৫৬ হাজার ৩৬০ হেক্টর এবং নওগাঁয় এক লাখ ৯৮ হাজার ৪৬৩ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

 

রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার সব কটি উপজেলা অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৯২ সালে গঠিত হয় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। ২০১৫ সালের আগস্টে বিএমডিএর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী। বিএমডিএর চেয়ারম্যান পদে যোগ দিয়েই আকরাম হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, ধান চাষ করতে গিয়ে ক্রমেই ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে তিনি তখন আরো বলেন, নতুন করে আর একটি গভীর নলকূপও বসানো হবে না। ফসলে সেচের কাজে পানির অভাব পূরণ করতে ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহারকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। প্রয়োজনে ক্যানেল করে নদী থেকে পানি আনা হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হবে। কিছুদিন আগেও বিএমডিএ চেয়ারম্যান বলেছেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে নতুন গভীর নলকূপ বসানোর অনুমতি দেওয়া হবে না।

 

জানা গেছে, ২০১৩ সালের পর থেকেই এই অঞ্চলে গভীর নলকূপ বসানোর অনুমোদন দিচ্ছে না কৃষি মন্ত্রণালয়। আবার সেচের কাজে ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহারের সুযোগও যথেষ্ট পরিমাণে সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে বোরো চাষ কমছেই।

 

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মাণ্ডইল এলাকার কৃষক আলী আকবর বলেন, গত বছর তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। তবে এবার চাষ করবেন সর্বোচ্চ তিন বিঘায়। শ্রমিক খরচের পাশাপাশি ডিজেলসহ সার ও কীটনাশকের দাম অব্যাহতভাবে বাড়ায় এবং ধানের দাম না পাওয়ায় আগের মতো ধান চাষে আগ্রহ পাচ্ছেন না। এবার ধানের পরিবর্তে গম আর আলু চাষ করছেন। আগামীতেও এগুলোই বেশি করে করবেন।

 

গত বছর প্রায় ১২ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেছিলেন তানোর উপজেলার রাতৈল গ্রামের কৃষক জাহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, এবার ৯ বিঘা জমিতে ধান চাষ করবেন। বাকি জমিতে আলু চাষ করছেন।

 

মোহনপুর উপজেলার মোহনপুরের মৌগাছি এলাকার কৃষক হযরত আলী বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে ধান চাষে খরচ হয় অন্তত ১৫-১৬ হাজার টাকা। কিন্তু ধান বেচে পাওয়া যায় ১১-১২ হাজার টাকা। ফলে বিঘাপ্রতি ধান চাষ করে লোকসান গুনতে হয় অন্তত তিন-চার হাজার টাকা। এ কারণে ধান চাষে কৃষকরা দিনের পর দিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তবে এভাবে ধান চাষ কমলে অবশ্যই খাদ্য ঘাটতি সৃষ্টি হবে। ভাতের বিকল্প হিসেবে এখনো আমরা অন্য খাবারের প্রতি তেমন অভ্যস্ত নই। ’

 

বাজার ঘুরে জানা গেছে, গত বছর ধান ওঠার সময় বাজারে দাম ছিল ৬০০ থেকে সর্বোচ্চ ৭২০ টাকা মণ। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ৯২০ টাকা মণ দরে সংগ্রহের কথা বললেও রাজশাহী অঞ্চলের অন্তত ৯৫ শতাংশ কৃষকই সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারেনি। হাট থেকে কৃষকের ধান কিনে নিয়ে সরকারি দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা কৃষক সেজে সরকারের কাছে বিক্রি করেছেন। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় ওই সময় খবরও বেরিয়েছে। তাতে কোনো লাভ হয়নি। কৃষকরা বঞ্চিতই থেকে গেছে। লোকসান পোষাতে পারেনি তারা।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ধান চাষে টানা লোকসানের কারণে রাজশাহী অঞ্চলে ধানি জমি কেটে পুকুর খননেও ঝুঁকছে কৃষকরা। বিঘাপ্রতি বছরে ৩০-৪০ হাজার টাকায় মাছ চাষিদের কাছে জমি ইজারা দিচ্ছে তারা। মাছ চাষিরা সেই জমিতে পুকুর কাটছে। গত তিন-চার বছরে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে বিশেষ করে রাজশাহীতে ধানি জমিতে শত শত পুকুর কাটা হয়েছে। ফলে ধান চাষের পরিমাণ কমছে। পুকুর খনন ঠেকাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা ছাড়াও নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবু বন্ধ হচ্ছে না পুকুর কাটা।

 

রাজশাহী অঞ্চলের কৃষি অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ফজলুর রহমানও স্বীকার করলেন ধান চাষ গত বছর কমেছে। তিনি বলেন, ‘এবার হয়তো কমবে না। ধানের পরিবর্তে কৃষকরা অন্য খাদ্য-ফসল চাষে ঝুঁকছে। এতে দেশে বিকল্প খাদ্যেরও সুযোগ হচ্ছে। কাজেই খাদ্য ঘাটতির আপাতত কোনো ঝুঁকি দেখছি না।

স/আর