বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সপ্তাহ ঘোষণা

নিজস্ব প্রতিবেদক:
আগামী ২২ মে ‘আন্তজার্তিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস’ উদ্যাপন উপলক্ষে ‘জাগাও বৈচিত্র্য, থামাও উষ্ণতা, বাঁচাও প্রাণ’ স্লোগানে প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সপ্তাহ ঘোষণার লক্ষে সংবাদ সম্মলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেসরকারী উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক, বরেন্দ্র শিক্ষা সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা কেন্দ্র-(বিইসিডিপিসি) এবং জনসংগঠনের যৌথভাবে আজ রোববার  সকাল ১০টায় রাজশাহী মহানগরীর মিয়াপাড়াস্থ রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার গিরিশ চন্দ্র হল রুমে  এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন, বরেন্দ্র শিক্ষা সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা কেন্দ্র-বিইসিডিপিসি’র সভাপতি জাওয়াদ আহমেদ রাফি। বারসিক বরেন্দ্র অঞ্চলের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী শহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন, সেভ দ্যা ন্যাচার অ্যান্ড লাইফ সোসাইটির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত কৃষক আঃ রহিমুদ্দিন, বিভাগীয় জয়িতা নারী রহিমা বেগম, পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চাকারী নারী মনিরা বেগম,পবা প্রেস ক্লাবের সভাপতি নাজমুল হোসেন, সাংবাদিক প্রমুখ।

এসময় উপস্থিত ছিলেন, বারসিকের কর্মসূচী কর্মকর্তা জাহিদ আলী, কৃষিবিদ অমৃত কুমার সরকার, বরেন্দ্র শিক্ষা সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা কেন্দ্র-বিইসিডিপিসি’র প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক শামীউল আলীম শাওন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক জরিনা খাতুন জরি, সাহিত্য সম্পাদক জিনাতুন নেছা জিনাত প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, আয়তনে ছোট হলেও বাংলাদেশ বৈচিত্র্য বৈভবে দুনিয়ায় অনন্য। ৩০টি কৃষিপ্রতিবেশ, ১৭টি হাইড্রলজিক্যাল অঞ্চল, ২৩০টি নদ-নদী, দুনিয়ার বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য, দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, হাজারো ধানের জাত, ৪৫ জাতিসত্তা নিয়ে পৃথিবীর বুকে এক আশা জাগানিয়া স্বপ্নভূমির নাম বাংলাদেশ। এখানে মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি, স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রজাতি ১১৩, পাখিপ্রজাতি ৬৩০, সরীসৃপ ১২৫, ২২ প্রজাতির উভচর, ২৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছ, সামুদ্রিক মাছপ্রজাতি ৪৭৫, ৩২৭ জাতের খোলসযুক্ত প্রাণী।

লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ পরিবেশ ও বনমন্ত্রণালয় ২০১০ সনে ৪র্থ প্রাণবৈচিত্র্য অবস্থানপত্র তৈরি করে। এতে দেশে ১৬ প্রজাতির এনডেমিক উদ্ভিদসহ প্রায় ৩,৬১১ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদের সংখ্যা নথিভূক্ত করা হয়েছে। অবস্থানপত্রে এক হাজার প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদের কথা বলা হয়েছে। বাঘের অঞ্চল হিসেবে খ্যাত বাংলাদেশ ক্রমেই বাঘশূণ্য হয়ে পড়ছে। শুধুমাত্র সুন্দরবনই এখন বাংলা বাঘের শেষ আবাস। ২০০৪ সনের এক জরিপে দেখা যায়, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০, ২০০৬ সনে দেখা যায় ২০০ এবং সর্বশেষ ২০১৫ সনের জরিপে বাঘের সংখ্যা জানা যায় ১০৬টি। বাঘের মতই কমছে ধানের দেশে ধানজাতের বৈচিত্র্য বলেও বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়।

লিখিত বক্তব্যে জানানো হয়েছে যে, সমগ্র বাংলাদেশের বুকে বিশাল এবং নানা বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ আলাদা বৈশিষ্ঠ্য সম্পন্ন বরেন্দ্র অঞ্চল। দেশের ৪৫ জাতিসত্তার মধ্যে দুই তৃতীয়াংশেরও বেশী বসবাস এই অঞ্চলে। প্রাণবৈচিত্র্য ও বহুসাংস্কৃতির পুরোধা আদিভূমি এই বরেন্দ্র অঞ্চল। কতোইনা বৈচিত্র্যে ভরপুর। কিন্তু দিনে দিনে নানামূখী কারনেই এর বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রাণের সাথে প্রাণের সহিংসতা, মাটির সাথে, বিলের সাথে, নদীর সাথে, সাংস্কৃতির সাথে সাংস্কৃতির সহিংসতা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।

বক্তব্যে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের সামগ্রীক পরিসংখ্যানে প্রাণ প্রকৃতি, জাতিসত্তা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতা এক অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে এই আদিভূমি। এখানে ঐতিহ্যেও ভরপুর। বাংলাদেশের সামগ্রীতে এই অঞ্চলের অবদান সবখানে, সবকিছুতে। তাই সাংস্কৃতিক ভিন্নতা ও প্রাণ-প্রকৃতি-বৈচিত্র্যে শ্রদ্ধাশীল স্বপ্নে বাংলাদেশ বির্নিমানে এই অঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীম। অন্যদিকে ভৌগোলিক ভিন্নতায় নানামূখী সংকটও তৈরী হচ্ছে এখানে। এই অঞ্চলের আদিপ্রাণীও কমে যাচ্ছে দিনে দিনে।

শুধুমাত্র ধান, মাছ, পাখি, বাঘ বা গাছ নয় বাংলাদেশে মানুষের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং ভিন্নতাও আজ বিপদাপন্ন বলে উল্লেখ করে বক্তব্যে বলা হয়েছে, এখানে লিচুতে বিষ দেয়া হয় পোকা মারার জন্য। কিন্তু মরে যায় মৌমাছি, এমনকি বিষ দেয়া লিচু খেয়ে মরেছে মানবশিশুও। বৈচিত্র্য আর ভিন্নতা নয়, এখানে বহুজাতিক বাজারই হয়ে ওঠছে মূখ্য। প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন ভোগবিলাসী জীবনের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে আগামীর প্রজন্মকে। মানুষ কেবলমাত্র মানুষ নয়, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তার চারপাশের জগত থেকে।

প্রকৃতির ভেতর বিদ্যমান প্রাণের বৈচিত্র্য এবং মানুষের সমাজে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আজ উভয়েই সংকটের মুখোমুখি। চলমান সংকটের পাশাপাশি  বৈশ্বিক উষ্ণতাজনিত জলবায়ু পরিবর্তন প্রাণবৈচিত্র্যের নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়াকে আরো সংকটময় করে তুলছে। এভাবেই নির্বিচারভাবে প্রতিদিন প্রাণবৈচিত্র্য দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হচ্ছে। তাই গ্রাম থেকে জাতীয় পর্যায় সকল স্তরে সকল মানুষের ভেতর প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে আরো বেশি দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল হওয়ার আহবান জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

 

এদিকে সংবাদ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস ২০১৭ উপলক্ষ্যে বারসিকের পক্ষ থেকে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

 

ঘোষিত কর্মসূচিগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রকৃতি-বন্ধন, সাংস্কৃতিক প্রচারাভিযান, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় তারুণ্যের শপথ, স্মৃতিময় প্রাণবৈচিত্র্য : প্রবীণ ও নবীনের শৈশব স্মৃতিকথন, ‘অচাষকৃত উদ্ভিদ সম্পর্কে জানি ও সংরক্ষণে ভূমিকা রাখি’ শীর্ষক বক্তৃতামালা এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন ও স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্য সংকট আলোচনা।

স/অ