বড় অংকের ঋণ দিতে যেসব নিয়মনীতি রয়েছে ব্যাংকগুলোর?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বাংলাদেশে বেসরকারি একটি ব্যাংকে বড় অংকের ঋণ দেয়া নিয়ে অনিয়মের খবর প্রকাশের পর বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ঋণ অনিয়মের বিষয়টি তারা ‘মনিটরিং ও সুপারভিশন’ করবে।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে যে, ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে কোম্পানি খুলে  ইসলামী ব্যাংক থেকে ২৭০০ কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। তবে সেই সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়ে ইসলামী ব্যাংক জানিয়েছে, যথাযথ নিয়মনীতি মেনেই ঋণ দেয়া হয়েছে।

এর আগেও বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি খাতের  ব্যাংকগুলো থেকে নিয়মনীতির বাইরে বড় অংকের ঋণ বিতরণের অভিযোগ উঠেছে।

তার অনেক  ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ারও উদাহরণ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, মালিকপক্ষের চাপ ও রাজনৈতিক প্রভাবে এসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।

কিন্তু ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ বিতরণে কী ধরনের নিয়ম-কানুন রয়েছে? নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে কতটা নজরদারি করে।

বড় অংকের ঋণ কীভাবে দেয়া হয়?

সাবেক ব্যাংকার মোঃ নুরুল আমিন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানভেদে শাখা বা কর্মকর্তারা কত টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারবেন বা ব্যবসা করতে পারবেন, এসব নির্ধারণ করা থাকে।

যেমন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ে এক থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ বিতরণের ক্ষমতা দেয়া থাকে। আবার কোন কোন বাণিজ্যিক বড় শাখায় ব্যবস্থাপকদেরও ঋণ বিতরণের সীমা দেয়া হয়।

কিন্তু এর বেশি হলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমতির দরকার হয়।

নুরুল আমিন বলছেন, ‘’বাকি সমস্ত কিছু বোর্ড থেকে পাস হতে হয়। উদাহরণ হিসাবে যদি বলি, বাংলাদেশে এখন প্র্যাকটিস হলো, ব্যাংক ভেদে এক কোটি থেকে পাঁচ কোটি, কোন কোন বিশেষ ব্যাংকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়ার ক্ষমতা  ম্যানেজমেন্টকে দেয়া আছে। কিন্তু এর বেশি হলেই সমস্ত ঋণ আবেদনে বোর্ডের অনুমোদন লাগে।‘’

নিয়ম অনুযায়ী, কেউ বড় অংকের ঋণ পেতে চাইলে সংশ্লিষ্ট শাখায় যোগাযোগ করেন।

সেখান থেকে তার আবেদন পর্যালোচনা, যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’যদি ঋণের প্রপোজাল (প্রস্তাব) আসে, ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট সেটা যাচাই-বাছাই করে দেখে।‘’

এ সময় তাদের ব্যবসায়িক ইতিহাস, ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা, অতীত ঋণের ইতিহাস, খেলাপি বা বকেয়া ঋণ আছে কিনা, প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কার্যক্রম, ঋণটি কি উদ্দেশে ব্যবহার করা হবে, তার প্রমাণ ইত্যাদি পরীক্ষা করে দেয়া হয়।

এরপর সব কিছু ঠিক থাকলে সেটির বিষয় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বা পরিচালনা পর্ষদে তোলা হয়।

সেখানে অনুমোদন পাওয়া গেলে ঋণ ছাড় করা হয়।

ঋণের আকার বড় হলে অনেক সময় একাধিক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে ঋণ দিতে পারে।

সেক্ষেত্রে একটি ব্যাংক প্রধান ভূমিকা পালন করে। তবে এ ধরনের ঋণের ক্ষেত্রেও সবগুলো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বোর্ডের অনুমোদন থাকতে হয়।

কিন্তু বাংলাদেশে সম্প্রতি আলোচিত একাধিক ঋণের ক্ষেত্রে এসব নিয়মনীতি অনুসরণ না করার অভিযোগ উঠেছে।

‘’কিন্তু যখন কোন ঋণ নির্দেশিত হয়, সুপারিশে হয়, কোন কারণে হয়, তখন এই নিয়মগুলো অনেক সময় ঠিকমতো পালন করা হয় না।  হয়তো ঋণ আগে দিয়ে দেয়, বিতরণ করে দেয়া হয়, পরে প্রসেস করে বোর্ডে পাস করানো হয়.’’ তি বলেন।

ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে তদারকি কতটা জোরদার থাকে?

সাধারণত ব্যাংকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দপ্তর যাচাই বাছাই করা, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা দেখা শেষে প্রতিবেদন দিয়ে থাকে।

সেটা পর্যালোচনার পর ব্যবস্থাপক বা বোর্ড ঋণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়।

ব্যাংকের পক্ষ থেকে এসব আবেদন নিরীক্ষাও করা হয়ে থাকে।

তবে সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, কাগজে পত্রে নিয়মকানুন বা গাইডলাইন থাকলেও, অনেক সময় বিশেষ তদবির বা রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সেসব নিয়ম ঠিকমতো অনুসরণ করা হয় না।

সাবেক ব্যাংকার নুরুল আমিন বলছেন, ‘’যখন বোর্ড এবং ম্যানেজমেন্ট একটা সমঝোতা বা বোঝাপড়া হয়, তখন সেখানে কোন নিয়মনীতি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে অনিয়মের বিষয় হলে ব্যবস্থা নেয়া, বাংলাদেশ ব্যাংকে জানানো-ইত্যাদি নিয়মের কথা থাকলেও সেটা আর পালন করা হয় না। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কোন এমডি ব্যাংক কোম্পানি আইনের লঙ্ঘনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্ট করেছে, এমনটা আমার জানা নেই।’’

ঋণ তদারকিতে কী করে বাংলাদেশ ব্যাংক

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, একসময় বড় অংকের ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকে জানানো বা পূর্ব অনুমতি নেয়ার নিয়ম থাকলেও বর্তমানে সেটি তুলে দেয়া হয়েছে।

ফলে কোন গ্রাহককে ঋণ দেয়া বা না দেয়ার সিদ্ধান্ত পুরোপুরি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক নিয়ে থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি কিছু করে না, কিছু গাইডলাইন আছে যে, কতো টাকা কীভাবে দেয়া যাবে, এক্সপোজার লিমিট কি হবে। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিজেদের মতো করে এটা করে।‘’

তবে  বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রতিমাসে একবার শাখাগুলো পরিদর্শন করা হয়।

বড় শাখাগুলো নিয়মিত ভিত্তিতে পরিদর্শন করা হয়।

এছাড়া প্রতি ১৫ দিনে বা মাসে একবার ব্যাংক থেকে অফসাইট প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এলসিগুলো প্রতিদিন জানা যায়।

‘’কিন্তু দৈনন্দিনভাবে এই কাজগুলো দেখার কোন ব্যবস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকে নেই। অডিটে এসে ধরা পড়লে হয়তো তখন তারা ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন,’’ বলছিলেন নুরুল আমিন।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়ম রয়েছে, বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের কোন সদস্য ১০ লাখ টাকার ওপরে বা শেয়ারের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিলে এখনো বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে হয়। এর বাইরে অন্য কোন ঋণ, খেলাপি ঋণ বা পুনঃ তফসিল করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকে জানানোর বাধ্যবাধকতা নেই।

এই নিয়মের কারণে অনেক সময় মালিকপক্ষ বা বোর্ডের সদস্যরা বেনামে ঋণ নেন বলে অভিযোগ আছে।

দুই হাজার একুশ সালে এরকম অভিযোগ ওঠার পর ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

তার আগে বেসিক ব্যাংক ও সাবেক ফারমার্স (এখন পদ্মা) ব্যাংকের ক্ষেত্রেও এমন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল।

সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘’বেশ কয়েক বছর যাবৎ ব্যাংকিং খাতে এ ধরনের প্রভাব তৈরি করা হয়েছে। এরকম একটা চাপ তো আছেই। আমার সময়েও চাপ ছিল, কিন্তু সেটা নিয়ে আমরা কথা বলতাম, আলোচনা করতাম। ব্যাংকিং খাতে আসলে সুশাসন নেই। ব্যাংকারদের সংগঠনগুলোও নানারকম লবি করে, স্টেটমেন্ট দেয়। তাদের কারণেও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রভাবিত হয়। আর রাজনৈতিক ইস্যু তো আছেই। রাজনৈতিক কানেকশন আছে, তারা নানাভাবে সুবিধা পায়।‘’

‘’আসলে বাংলাদেশের ব্যাংক যে পুরোপুরি পেশাদারিভাবে চলে, ফাইন্যান্সিয়াল ডিসিপ্লিন কঠোরভাবে পালন করে, সেটা আমি বলবো না। সেখানে একটা দুর্বলতা আছে,’’ বলছেন ড. আহমেদ।

বড় ঋণে অনিয়ম হলে কি করে বাংলাদেশ ব্যাংক?

সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, এরকম অনিয়ম হলে ব্যবস্থা নেয়ার আন্তর্জাতিক কিছু রীতিনীতি আছে। এছাড়া কোন বিষয় আলোচিত হলে বা গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে তারা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারে।

‘’প্রথমে অনিয়মের বিষয়ে তারা তদন্ত করে দেখবে। এরপর তাদের জবাব জানতে চাইবে। তাতে সন্তুষ্ট না হলে তারা ওই ব্যাংকের বিরুদ্ধে বা ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। চাইলে এমডিকে সরিয়েও দিতে পারে,‘’ তিনি বলছেন।

দুই হাজার একুশ সালে ঋণ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডির দায়িত্বপালনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

সেখানে ঋণ বিতরণেও নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি শীর্ষ পদে কর্মকর্তা নিয়োগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।

সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলছেন,  ‘’বাংলাদেশে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান এতগুলো হয়েছে যে, সেটা পুরোপুরি নজরদারি করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু যেভাবেই হোক, এটা করা তাদের দায়িত্ব, সেটা তাদের করতে হবে।‘’

ইসলামী ব্যাংকে দুই হাজার সাতশো কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে  সেই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আবুল কালাম আজাদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘’বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট যে গাইডলাইন আছে, সেই মোতাবেক মনিটরিং ও সুপারভিশন করা হয়। সকল ব্যাংকই তার মধ্যে আছে। ইসলামী ব্যাংকও সেই আওতায় থাকবে। আশা রাখি, তারই আলোকে মনিটরিং ও সুপারভিশন করা হবে।‘’

‘’বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে স্পেফিকিক টার্মস অফ রেফারেন্সের ভিত্তিকে মনিটরিং ও সুপারভিশন করা হয়। সেই বিষয়টাও খেয়াল রাখতে হবে,’’ তিনি বলছেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা