বছর দশেক পর হয়তোবা একদিন! নৌশিন নাওয়াল সুনম

মাঠ-ঘাট , গাছপালা , বাড়িঘর সব পেছনে ফেলে দ্রুতগতিতে ছুটে চলছে ট্রেনটা। বুঝি আকাশকে পেছনে ফেলাই তার ইচ্ছা। চলছে ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে গতি যত বাড়ছে ঝাঁকুনি কমছে। বৃষ্টি হবে হবে মনে হচ্ছে। অন্ধকার আকাশ পুরো বিকেলটাকে সন্ধ্যা সাজিয়ে রেখেছে। জানালায় মাথা রেখে আকাশের খেলা দেখছে নীল , পাখিদের খেলা দেখছে, গাছগুলোকে এক পায়ে পেছনের দিকের দৌড়তে দেখছে। খুব বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে। ইস ঐ ধান ক্ষেতগুলোর শেষ বাড়িটা যদি তার বাড়ি হত !
দারুন মজা করে ভিজতে পারত। তার পাশেই আছে পুকুর। বৃষ্টির সময় পুকুরে গোসল করা সে যে কি আনন্দের বিষয়-তা যে না করেছে, সে কোনদিন বুঝবে না। এ কথা নীলদের ১৪ বছর বয়সী কাজের মেয়ে আসমা তাকে বলেছিল একদিন। নীলের ভীষন আফসোস হচ্ছে, আসমা প্রকৃতির যে আনন্দ উপভোগ করেছে, নীল তা-আজও করতে পারেনি। কোনদিন পারবে কিনা তাও জানা নেই। নিয়তির কি অদ্ভুত খেলা। আকাশের খেলা , গাছপালার খেলা আর নিয়তির খেলা দেখতে দেখতে নীলের মনটাও কেমন মেঘলা হয়ে যায়।
ট্রেনটা আরো দ্রুত ছুটছে……… স্বামী স্ত্রী আর ৩/৪ বছরের বাচ্চা নিয়ে সামনের সীটে বসা ছোট একটা পরিবার। ও দিকে কোনো খেয়ালই নেই নীলের। সমস্ত মন-প্রাণ তার জানালার বাইরে। এই বুঝি বৃষ্টি নামল। ছোট্ট বাচ্চাটাকে হঠাৎ কেউ ‘বাবু’ বলে ডাকতেই চমকে ওঠে নীল। মূহুর্তে তার সমস্ত চেতনা আন্দোলিত হয়ে ওঠে। চেতন মন ঝাঁপিয়ে পড়ে অবচেতন মনের আনাচেকানাচে ‘বাবু’ খুঁজতে থাকে। এই শব্দ সে জীবনে বহুবার শুনেছে। কিন্তু এমন তো হয়নি কখনো ! আজ এমন হচ্ছে কেন ! মনে পড়েছে… সাথে সাথে বৃষ্টি শুরুহয়েছে প্রচন্ডবেগে। নীল বিভোর হয়ে ভিজতে থাকে, বৃষ্টিতে না অবচেতন মনের স্মৃতিপটে।
‘বাবু ‘নামে কেউ একজন তাকে ডাকত একসময়। সে প্রায় বছর দশেক আগেকার কথা। খুব অল্প সময়ে তার সাথে ভালই ভাব হয়েছিল নীলের । তখন সে ভার্সিটির ছাত্র। নীলের সাথে খুব সহজে ভাব হয়না কারোর। কারন সে খুব খুটিয়ে খুটিয়ে মানুষকে বিশ্লেষণ করে। এই বিশ্লেষণে খুব কম লোক টিকতে পারে। আর যারা টেকে তারা আজীবনের জন্যই টিকে যায়। শুধু ওই একটা মাত্র লোক, যে বিশ্লেষণে টিকেও আজীবন টিকতে পারেনি বন্ধু হয়ে।’ বাবু ‘বলে ডাকা ছেলেটার সাথে জীবনে বহুবার সামনাসামনি দেখা হলেও চেহারা মনে পড়ছে না আজ। খুব রাগ হচ্ছে। সহজে কারো চেহারা ভোলেনা সে। ছেলেটা লিখত মোটামুটি মানের। জানালার কাঁচ বন্ধ করতে হলো ভিতরে বৃষ্টির পানি আসছে।”
বাবু “বলে ডাকা ছেলেটার নাম মনে পড়েছে। একসময় দিনে দু’বেলা ঝগড়া হতো দু’জনায়। টাইম করে, সকাল ১১টা আর বিকেল ৫টায়। তবু সে ঝগড়ার জন্য দুজনেই উৎসুক অপেক্ষায় থাকত বোধহয়। বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সরলতা আর বোকামি ছাড়া কিছুই খুজে পেতনা নীল। দিনে চল্লিশ বার করে বলত, আমি তোমায় আর ফোন দেব না-এটাই শেষ। ফাজলামোটাও বুঝত না ছেলেটা। নাকি বুঝত কিন্ত বুঝতে দিত না যে সে বুঝত, জানি না। আজ তার কথা এতো মনে পড়ছে কেন। এটা ঠিক না।
নীলের খুব বৃষ্টি ছুঁতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে সীট থেকে উঠে ট্রেনের দরজার কাছে যায়। বন্ধ দরজার গ্লাসের জানালা খোলে। বৃষ্টির ফোঁটা প্রচন্ড গতিতে তার গায়ে ছিটকে আসে। সে জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে দেয়। বৃষ্টির ফোঁটা ছোঁয় , মনে মনে আওরাতে থাকে, বাবু… বাবু… বাবু… (জীবন থেকে নেয়া )