বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোলাকুলি আমার জীবনের বড় স্মৃতি: মেয়র লিটন

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কোলাকুলি আমার জীবনের বড় স্মৃতি।

আজ ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও কলঙ্কতম একটি অধ্যায়। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে এক সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহিদ এএইচএম কামরুজ্জামান হেনার সন্তান, রাজশাহী সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির ইতিহাসে একটি শোকাবহ দিন। ঘটনার সময় আপনি পড়াশোনার জন্য কলকাতায় ছিলেন। কখন কিভাবে জানলেন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে।

এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন : বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সময় আমি এবং আমার ছোট ভাই এএইচএম এহসানুজ্জামান স্বপন কলকাতার কাছে নরেন্দ্রপুর আরকে মিশন স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করতাম। আমি তখন একাদশ শ্রেণির ছাত্র। আর আমার ছোট ভাই স্বপন অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করতেন। ৭৫-এর ১৪ আগস্ট রাতে এবং ১৫ তারিখের উষালগ্নে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ভবনে যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় সেদিন ছিল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। দিবসটি উপলক্ষ্যে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিও নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। সকাল থেকেই আমরা দুই ভাই স্বাধীনতা দিবসের এসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করি।

কর্মসূচি শেষ হলে কলেজের কয়েকজন শিক্ষক ও সহপাঠী আমাদের দুই ভাইকে আলাদা করে ডাকেন। তারা আমাদের বলেন, বাংলাদেশে একটি বেদনাদায়ক এবং দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনা সম্পর্কে তোমরা কিছু শুনেছ কিনা। আমরা জানতে চাইলাম, বাংলাদেশে কী ঘটেছে? আমরা তো কিছুই জানি না। তখন শিক্ষকরা বললেন, তোমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এটিই ছিল আমাদের কাছে শোকাবহ ১৫ আগস্টের নৃশংসতার প্রথম খবর। এ খবরে আমরা দুই ভাই ভীষণভাবে ভেঙে পড়ি। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও সহপাঠীরা আমাদের সান্ত্বনা দেন। পরের দিন খবরের কাগজ ও আকাশবাণীর খবরে আমরা বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের সদস্যদের নিষ্ঠুর ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শিশু শেখ রাসেলও ঘাতকদের বুলেট থেকে বাঁচতে পারেনি-এ খবর আমাদের হৃদয়কে ভেঙে খান খান করে দেয়।

১৫ আগস্টের ঘটনার ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর দেশে ঘটেছিল নৃশংস জেলহত্যার ঘটনা। কবে আপনারা এসব শোকাবহ ঘটনার বিস্তারিত জানতে পারলেন। এসব ঘটনার পর আপনাদের অবস্থান, আশ্রয় ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে কেমন ধরনের উদ্বেগ ছিল?

এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন : পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান কারাগার। সেই কারা প্রকোষ্ঠে রাতের অন্ধকারে ৭৫-এর ৩ নভেম্বর আমার বাবা শহিদ এএইচএম কামরুজ্জামান হেনাসহ জাতীয় চার নেতাকে নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর ৫ নভেম্বর রাতে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান স্বামী লোকেশ্বরা নন্দ স্যার আমাদের দুই ভাইকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একটি গাড়িতে করে কলকাতা শহরের গাড়িয়াহাটের গোলপার্কে অবস্থিত রামকৃষ্ণ মিশন কালচারাল ইনস্টিটিউটে নিয়ে যান। আমরা তখনও কিছুই জানতাম না। গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি আমাদের বলছিলেন, সবার বাবা-মাকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়। এ অনিবার্যতা আমাদের সবাইকেই মানতে হয়। তবে আমরা দুই ভাই তখনও বুঝতে পারিনি তিনি কেন এমন কথা বলছেন?

পরের দিন ৬ নভেম্বর সকাল ৯টায় স্বামী লোকেশ্বরা নন্দ স্যার, মিশনের গেস্টরুমে আসেন। এ সময় তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আনন্দবাজার, যুগান্তর, অমৃতবাজার ও দৈনিক বসুমতিসহ আরও কয়েকটি খবরের কাগজ আমাদের পড়তে বলেন। সংবাদপত্রগুলো পড়তে গিয়ে আমরা ছবিসহ দেখলাম বাংলাদেশের জাতীয় চার নেতাকে কারা প্রকোষ্ঠে চরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে হত্যা করা হয়েছে। অনেকক্ষণ আমরা শুধু কাঁদছিলাম। বিদেশে আমাদের কোনো স্বজন নেই। দেশে বাবা নেই। মা-বোনসহ পরিবারের সদস্যরা দেশে কোথায় কি অবস্থায় আছেন-সেই চিন্তা আমাদের আরও অস্থির করে তোলে। অনেকদিন আমরা পরিবারের খোঁজ নিতে পারিনি। কারণ নিরাপত্তা তখন আমাদের জন্য একটি বড় প্রশ্ন হয়ে উঠল।

জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহিদ কমারুজ্জামানের সন্তান হিসাবে বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে কতটুকু দেখেছেন-কোনো স্মরণীয় স্মৃতি মনে করতে পারবেন?

এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন : ১৯৭৪ সালে আমরা দুই ভাই ভারতে থেকে ঢাকায় ঈদুল ফিতরের ছুটিতে এসেছিলাম। তখন আমার বাবা মন্ত্রীদের জন্য বরাদ্দকৃত বাসভবনে থাকতেন। ঈদের দিন নামাজের পর সকাল ১০টার দিকে আমরা দুই ভাই বাসভবনে বাইসাইকেল চালাচ্ছিলাম। সে সময় একটি বড় কার বাসভনের ভেতরে প্রবেশ করে। তখনও বুঝতে পারিনি কী হচ্ছে? গাড়ি থেকে নেমেই বঙ্গবন্ধু হেনা হেনা বলে ডাক দেন। তখন আমরা বুঝতে পারি তিনিই বঙ্গবন্ধু। এ সময় আমার বাবা দ্রুত দোতলা থেকে নেমে আসেন এবং বাবার সঙ্গে তিনি কোলাকুলি করেন। এ সময় আমাদের দুই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বঙ্গবন্ধু বাবাকে প্রশ্ন করেন-হেনা এ দুটি তোর ছেলে না? বাবা হ্যাঁ বলার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন-এদিকে আয়। এরপর তিনি আমাদের দুই ভাইয়ের সঙ্গে আলিঙ্গন করলেন। এটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি। কারণ আমি জাতির পিতার সঙ্গে বুক মিলিয়েছি। এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে।