বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর মাসে জন্মদিনের ভাবনা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

জাতির জনক, বাংলাদেশের স্থপতি, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনটি তার পরিবার জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস হিসেবে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। এতেই বোঝা যায় কেন সেটাকে জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ইতিহাসের এই মহানায়কের জন্মদিনটি রাজধানী থেকে শুরু করে যেখানে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সেই টুঙ্গিপাড়াসহ সর্বত্র যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গেই পালন করা হয়।

আমি ১৯৮০ সালের ২১ জানুয়ারি নাক, কান, গলা রোগের ওপর এমএস ও পিএইচডি করার জন্য তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেনের বন্দরনগরী অডেসায় যাই। সেখানে ২২ এপ্রিল মহামতি লেনিনের জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠানটি আমার মনে এক অবিস্মরণীয় দাগ কাটে। লেনিন শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্মদাতা ছিলেন না, তিনি মার্কস-এঙ্গেলসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজতান্ত্রিক চেতনার এক মহান মূল্যবোধ নিয়ে ১৯১৭ সালের বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

মহামতি লেনিনের জন্মদিনটি আমার সোভিয়েত ইউনিয়নে পদার্পণের তিন মাসের মাথায় পালিত হয়। আমি তখন রুশ ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি নাক, কান, গলা (ইএনটি) বিভাগে কাজ করি। সেদিনটি কিভাবে পালন করা হবে এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। আমার গাইড প্রফেসর দ্রাগমেরেস্কি আমাকে বললেন, দাদুর জন্মদিন পালিত হবে, সুতরাং তুমি এখানে এসো।

বিষয়টি আমার কাছে কেমন জানি ধোঁয়াটে মনে হল। যা হোক, অতি উৎসাহভরে সেই হোস্টেল থেকে দু’বার ট্রাম পরিবর্তন করে অডেসার রিজিওনাল হাসপাতালে আমার কর্মস্থলে পৌঁছে যাই। ওখানে পৌঁছে দেখি সে কী বিশাল কর্মযজ্ঞ। পরিবেশ রক্ষকরা রাস্তাঘাট, বাগান সব পরিষ্কার করছে, ড্রেন পরিষ্কার করছে এবং বড় বড় সার্জনরা নিজ নিজ ডিপার্টমেন্টে বসে রোগী দেখছে। সকাল ৮টায় রোগী দেখা শুরু হয়েছে। যতক্ষণ রোগী থাকবে ততক্ষণ তারা রোগী দেখে যাবেন। টিকিট দেয়া বন্ধ হবে না। এবং যে চারটি অপারেশন থিয়েটার ইএনটি ডিপার্টমেন্টে ছিল, অন্যান্য দিন দেখতাম হয়তো তার দুটোতে অপারেশন হচ্ছে, বাকি দুটো খালি আছে। সেদিন দেখলাম চারটাতেই অপারেশন হচ্ছে।

মজার ব্যাপার হল, অন্য সময় প্রতিদিন যে অপারেশন হতো সেদিন মনে হল তার দুই বা তিনগুণ অপারেশন বেশি হয়েছে। আমি আমার প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা আজকের ছুটির দিনে লেনিনের জন্মদিন (২২ এপ্রিল) পালন করছ কেন? ২২ এপ্রিল তো চলে গেছে। কিন্তু তোমরা আজ শনিবার কেন এটা উদযাপন করছ? তিনি জবাব দিলেন, এটা ‘লেনিনস্কি সুবতনিক’, অর্থাৎ ছুটির দিনটাকে আমরা লেনিনের জন্মদিন উপলক্ষে কর্মের মাধ্যমে উৎসর্গ করি। অমনি সেটা আমার স্মৃতির মণিকোঠায় বিশাল স্থান দখল করে নিল।

১৯৮৩ সালে আমি দেশে ফিরে আসি। তারপর থেকে আমি এই চিন্তা-চেতনা নিয়ে কাজ করতে থাকি। আমার ধারণা ছিল, কোনোদিন যদি পারি তাহলে আমিও দিবসটিকে অর্থাৎ আমার জাতির জন্মদাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনটিকে ওই রকম একটা কর্মময় জন্মদিন হিসেবে পালন করব। অথবা জন্মদিনের পরের একটা শুক্রবার সবাই কর্মের মাধ্যমে উৎসর্গ করব। এবং এই কর্মময় দিনটিকে পালন করতে হলে আমার মতো মানুষের বুদ্ধি বা বিবেচনা যে কেউ নেবে না, সেটাও আমি খুব ভালোভাবে জানি।

স্রষ্টা আমার প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী আমাকে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন, তখনই এই বাস্তবতার নিরিখে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে কিছু সেবা দেয়া যায় কিনা সে ব্যাপারে সচেষ্ট হলাম। যেহেতু ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ আমি দায়িত্ব নিয়েছি, আমার দুর্ভাগ্য ২০০৯ সালের ১৭ মার্চটা আমি পালন করার সুযোগ পাইনি আমার মনের মতো করে। ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস এবং বঙ্গবন্ধু যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত সেই পুণ্যস্থানে যদিও উপস্থিত ছিলাম, তারপরও যেন একটা কর্মের অতৃপ্তি আমার প্রাণে বারবার বেজে উঠছিল। যা হোক, সেই থেকে আমি চিন্তা করতে থাকলাম ২০১০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রি চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা করব।

আমার শুভাকাক্সক্ষী বঙ্গবন্ধুর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাশীল যেসব সহকর্মী ছিলেন, তাদের মধ্যে এ ভাবনা সঞ্চারিত করতে শুরু করলাম। ২০১০ সালের মার্চ মাসের শুরুতেই তৃতীয় শ্রেণী, চতুর্থ শ্রেণী, দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মচারীসহ আমার সহকর্মী সব ডাক্তারের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান করে সিদ্ধান্ত নিই- ১৭ মার্চ আমি যে করেই হোক একটা ফ্রি হেলথ সার্ভিসের ব্যবস্থা করব। এবং সেই ফ্রি হেলথ সার্ভিসের ব্যবস্থা করার জন্য যা যা করা দরকার- সব আনুষঙ্গিক বিষয় সঙ্গে নিয়ে এলাম। আমার প্রোভিসি অধ্যাপক শহীদুল্লাহকে দায়িত্ব দিলে তিনি হাসপাতাল পরিচালককে নিয়ে নেমে পড়লেন।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রি. জে. এমএ মজিদকে যখন আমি বললাম, এই কাজটা সুন্দরভাবে করে দিতে হবে, তখন তিনি সহাস্যে বললেন, স্যার আমার ওপর আপনি দায়িত্ব দিয়ে দিন। প্রোভিসি শহীদুল্লাহ সাহেব আমাকে ইতিমধ্যে বলেছেন, আমি সত্যিই তার প্রশংসা না করে পারছি না, প্রচণ্ড পরিশ্রম করে, নির্ভুলভাবে কোনোরকম ত্রুটি ছাড়া সেই দিনটি পালনের ব্যবস্থা তিনি করে দিয়েছিলেন।

তার আগে আমি আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় চিকিৎসকদের অনেককে নিমন্ত্রণ করলাম যেন তারা এসে আমার রোগী দেখার এই প্রক্রিয়ায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব, অধ্যাপক মাহমুদ হাসান, অধ্যাপক শাহলা খাতুন, অধ্যাপক এম আর খান। প্রত্যেকেই এসেছিলেন। সেদিন রোগী দেখার যে আনন্দ উৎসব হল, সেটা যেন পহেলা বৈশাখের মতো একটা প্রাণের মেলা হয়ে গিয়েছিল। রোগীদের প্রফুল্লতা, তাদের সচেতনতা এসব দেখে তাদের সহযোগিতা আমার মনে এক বিরাট সাহস ও বিশ্বাস জুগিয়েছিল, আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পক্ষে। যা হোক, পরে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এই চিকিৎসাব্যবস্থা চালু করেছেন সরকারি হাসপাতালগুলোতে।

গত বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৭ মার্চ দিনটি পালনের জন্য আমি বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট কর্তৃক পরিচালিত শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে হাসপাতালকে বেছে নিলাম। কারণ সেখানে আমি অনেক দিন ধরেই অর্থাৎ হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে প্রতি মঙ্গলবার রোগী দেখতে যাই। এবং অনেক রোগীকে সেখানে সাহায্য বা চিকিৎসা দিতে পারি। কারণ তারা শিল্প এলাকার বঞ্চিত হতদরিদ্র না হলেও দরিদ্র ক্যাটাগরিতেই পড়েন। নিু আয়ের লোকজন, খেটে খাওয়া শ্রমিক-কৃষক, যাদের দেখে আমি খুব পরিতৃপ্তি পাচ্ছিলাম। তাই হাসপাতালের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার মালয়েশিয়ান ভদ্রমহিলা, যিনি একজন ক্যান্সার সার্ভাইভার এবং আমার প্রতি তার বেশ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রয়েছে, তাকে বললাম এবারের ১৭ মার্চ চল আমরা এই হাসপাতালে একটু সুন্দরভাবে দিনটি পালন করি। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনার পরামর্শ কী? আমি বললাম, দেখ এবার আমরা শুধু ফ্রি রোগী দেখব না, আমাদের প্রেসক্রিপশনের ওপর ভিত্তি করে যদি কেউ হাসপাতালের ডিসপেনসারি থেকে ওষুধ কিনে, তাদের আমরা ৫ শতাংশ কনসেশন দেব। এবং যদি কেউ এই হাসপাতালে নির্দেশিত প্রেসক্রিপশনের ওপর লেখা কোনো ল্যাবরেটরির টেস্ট করতে চায়, তাহলে তাদের ২০ শতাংশ কনসেশন দেয়া হবে। তাছাড়া সকাল থেকেই হাসপাতালের কর্মীরা প্রত্যেক শিশুকে একটা করে বেলুন দেবে, একটু খাদ্য বা পানীয় দেবে এবং হাসপাতালটাকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাজিয়ে একটা উৎসবমুখর দিন হিসেবে রোগীদের সেবা দিতে চেষ্টা করবে। আমি জানি না, সিইও কেন একবাক্যে আমার সব কথা গ্রহণ করলেন। তিনি মালয়েশিয়ায় তার প্রধানের সঙ্গে আলাপ করেছেন কিনা জানি না। ১৭ মার্চ খুব ভোরে সেখানে গিয়ে দেখলাম, আমি যা বলেছি তা-ই হচ্ছে। শেষাবধি অত্যন্ত প্রশান্তির একটা মন নিয়ে আমার নাক, কান, গলা বিভাগের যেখানে রোগী দেখার কথা সেখানে উঠে গেলাম। দেখলাম অসংখ্য রোগী অপেক্ষা করছে। আমার সহকর্মী, আমার সঙ্গে যে গত ১০ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আমার চেম্বারে কাজ করেছিল, ডাক্তার জুয়েল, ইতিমধ্যেই রোগী দেখা শুরু করে দিয়েছে। দু’জন মিলে আমরা ১১৯ জন রোগী দেখলাম। দেখলাম রোগীরাও অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে এই দিবসটাকে, এই সেবাটাকে গ্রহণ করেছেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্য হল, আমারই এক সহকর্মী বলল, ‘স্যার আপনি যে পদ্ধতি চালু করেছেন, স্বল্পসংখ্যক চিকিৎসক এটা পছন্দ করেননি।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? ‘এবার দিনটা তো পড়েছে শুক্রবার, শুক্রবারে তো অনেক ডাক্তার ঢাকা শহর ছেড়ে বিভিন্ন শহর, উপজেলা বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে রোগী দেখতে যান। যেখানে মেডিকেল কলেজ আছে, সেখান থেকে সবাই গ্রামাঞ্চলে রোজগারের জন্য যান। তারা আজকে যেতে পারবেন না, তাই।’ এ কথা শুনে মনে হল, আমি কি খুব বড় একটা অপরাধ করেছি?

তারপরও যদি অপরাধ করে থাকি সেটা কি এতই বড় অপরাধ যে ৩৬৫ দিনের একটি দিন শুধু পেরিফেরিতে না গেলে রোগীরা সেবাবঞ্চিত হবে বা আমার সামান্য উপার্জনটা কমে যাবে। সবকিছু মিলে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি যা করেছি, আমার বিবেক তা বলে দিয়েছে, আমি একটা ভালো জিনিসকে অনুকরণ করেছি এবং সেটাকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি।

ডাক্তারদের মধ্যে এই ক্ষোভটা হয়তো বা থাকত না। যদি ওই ১৭ মার্চ রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের সব কর্মী রাস্তায় নেমে রাস্তাটা ঠিক করত। ওয়াসার কর্মীরা তার পানির লাইনগুলো ঠিক করত। পরিবেশ বা পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ঢাকাকে পরিষ্কার রাখার জন্য উঠেপড়ে লাগত, তাহলে সবাই এটা সানন্দে গ্রহণ করত। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গীতায় বলা হয়েছে, ‘কর্ম বন্ধনের কারণ নয়, অহংকার ও কামনাই বন্ধনের কারণ। মোক্ষের জন্য চাই অহংকার ও ফলাশক্তি ত্যাগ, কর্মত্যাগ নয়। কেহই কখনও ক্ষণকাল ও কর্ম না করিয়া থাকিতে পারে না, প্রকৃতির গুণে অবশ হইয়া সবাই কর্ম করিতে বাধ্য হয়।’

ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক; সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি