ফ্রান্সে দিন কাটে যেভাবে

আনোয়ারুল মণ্ডল ফ্রান্স:

এক এক করে দিন পেরিয়ে সপ্তাহ, সপ্তাহ পেরিয়ে মাস আর মাস পেরিয়ে বছর। দীর্ঘ এক বছর ফ্রান্স এর রাজধানী প্যারিস, এরপর জেলা শহর প্যারপিনিয়তে! সেই ফেব্রুয়ারী ২০১৪। পায়ে পায়ে আগানো। অনেক গুনী-জ্ঞানী বাংগালী জনের সাথে পরিচয়। অনেক পোড়া-মর্শ। নেহায়েত অমিল হবে না বাংলাদেশী বাংগালীর সাথে ফ্রান্স এর বাংগালীর। স্বাভাবিক ভাবে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে, অফিস আদালতে যা কিছু দেখা যায় তার ছাপ সব বাঙ্গালী অধ্যশিত এলাকাতেই পাওয়া যায়। মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস, বার্সেলোনা, প্যারিস ভ্রমণ থেকে সত্যিকার অর্থে এমনই মনে হয়। অবশ্য সে নিয়ে আমার কোন অনুযোগ বা অনুরাগ নেই। কেননা মিলতো থাকারই কথা। তানা হলে তো ব্যতিক্রম হয়ে যায়। আমার লেখার বিষয়টা অবশ্য এটা না তথাপি অনধিকার চর্চা।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থার, এমন এক জায়গায় আমাদের অবস্থান, যেখানে আমরা একে অপরকে সম্বোধন করতে পর্যন্ত অভ্যস্থ না। ছোট বেলা থেকে পরিবারের মধ্যে, এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতেও আমরা শিশুদের সম্বোধন করা সেখাই না। অনুন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের বাস্তব ভিত্তিক শিক্ষা দেয় নাই সে কারনেই আজ আমরা অন্যকে সম্বোধন করতে জানিনা। জানিনা, এ ৬ বছরে আদৌও কোন পরিবর্তন হয়েছে কি না? শিশুকাল থেকেই আমরা  সুপ্রভাত, শুভ বিদায়, শুভ সন্ধ্যা, শুভ রাত্রি ইত্যাদি সম্বোধন মুলক শব্দের সাথে অভ্যস্ত না। সেকারণে বড় হয়েও সচরাচর এগুলোর ব্যবহার আমরা করতে পারি না। বাঙ্গালী হিসেবে যা সত্যিই আমাদের জন্য লজ্জা জনক। অথচ ফরাসী, ইংলিশ, আইরিশ স্কটিশদের দেখেছি পরিচিত অপরিচিতদের মধ্যেও চোখাচোখী হলেই সম্বোধন করতে ছাড়ে না। এমনকি  সামান্য সময় পেলে প্রাসংগিক কিছু কথাও বিনিময় হয়ে যায়। খুব ছোট বেলা হতেই এ শিক্ষা তারা পরিবার ও স্কুল থেকে পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে যায়। সেকারনে শব্দগুলো আপনা থেকেই চলে আসে স্বাভাবিক ভাবেই।
089(1)
ইউরোপ নিয়ে আমাদের অনেকই অনেক রকম ধারনা পোষণ করি। অনেকেই মনে করে ইউরোপে চাইলেই অনেক কিছু হাতের নাগালে পাওয়া যায়, এ ধারনা যে একেবারেই সঠিক না তা নয়। তবে যেকোন বিষয়ই বাংলাদেশের চেয়েও অনেক অংশে পরিছন্ন। ইংলিশ, ফরাসী বা ইউরোপিয়ানদের বোকা ভাবার কোনই কারন নাই। যদিও এমন ধারনা অনেকেই পোষণ করে। তবে ভদ্রতাকে যদি বোকামী মনে করা হয় তাহলে অন্য কথা। বাংলাদেশেও এক ধরনের জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন ভদ্রলোক আছে যারা ভদ্রতাকে বোকামী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। বিশেষ কিছু কারনে পরিবার, প্রতিবেশী, পথচারীদের প্রতি আবেগ বা অনুভূতি এদের একটু কমই বৈকি কিন্তু এর অর্থ কিন্তু দায়িত্ব হীনতা নয়। দায়িত্ব এর ব্যাপারে এক ঘটনা মনে পরে গেল।
একদিন ফুটবল খেলতে গিয়ে আমার ছেলের নিক্যাপ (হাটুর গোল হাড়) স্থানচ্যুত হলে ছেলের সমবয়সী একজন বন্ধু দৌড়ে এসে বাসায় খবর দেয়। আমরা দৌড়ে সেখানে গিয়ে দেখি এম্বুলেন্স ও ডাক্তার এসে আমার ছেলের চিকিৎসা করছে। আমরা দুর্ঘটনা স্থলে পৌছার মিনিট দুই/তিনেক এর মধ্যে বাড়তি চিকিৎসার জন্য এম্বুলেন্স হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
এদেশের সরকার তাদের জনসাধারনের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান এর জন্য অপেক্ষা করে। একজন ১৮ ঊর্ধ্ব ব্যক্তি যদি বেকার হয় তাহলে সে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা থেকে মোটেও বঞ্চিত হয় না। একারনেই আন্তীয় তথা সাধারনের কাছে অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত সহযোগিতা নেয়ার প্রয়োজন পরে না। ফলে পারিবারিক বন্ধন তথা সুসম্পর্ক বজায় থাকে। পরিবার বা পরিবারের বাইরের কারো সাথে প্রভু ভৃত্যের সম্পর্ক তৈরী হয় না। এমনকি কারো কাছে আন্তমর্যাদা লুটিয়ে দিতে হয় না।
একবার এক গ্রামে ঘুরতে গিয়ে আমাদের সাথে এক ফরাসী মেয়ের পরিচয় হয়। অল্প সময়ে তাঁর সাথে আমাদের হৃদ্রতাও গড়ে উঠে। কথোপকথন এর এক পর্যায়ে জানতে পারি, আমরা একই ট্রেনে বাসায় ফিরবো। অবশ্য মেয়েটি আমাদের এক ষ্টেশন আগেই নেমে যাবার কথা। তো ট্রেনের যে আসনে বসে আমরা গল্প করছি, ঠিক তার পাশের আসনেই বসে, গল্প করছে চার ষাটোর্ধ পুরুষ ও মহিলা। এই পুরুষ-মহিলারা বেশ চুটিয়ে আড্ডা আর এক অপরের সাথে গল্প করছিল। এই গল্পের ফাঁকে আমাদের সাথের মেয়ে স্টেফানী ওদের কিছু কথা অনিচ্ছাকৃত ভাবে শুনে ফেলে। আর সাথে সাথেই তার দুঃখ প্রকাশ! ”উহ লা লা! আমি নিশ্চয়ই হেল অর্থাৎ দোযখে যাব”।
আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করলো কেন তুমি এমন কথা বলছ হঠাৎ? সে জানাল, আমি অনেক অন্যায় করে ফেলেছি, পাশের চার ষাটোর্ধদের আলোচনা আমি শুনে ফেলেছি। খুব স্বাভাবিক কারনে আমি চিন্তা করলাম, কোথায় আমরা আরও কান পেতে দেই অন্যের কথা শোনার জন্য আর এরা কিনা অনিচ্ছাকৃত ভাবে শুনে ফেলার জন্য বলে, হেল বা দোযখে যাবে। একই রক্ত মাংস অথচ পারিবারিক, সামাজিক আর প্রাথমিক শিক্ষার বদৌলতে মানুষিকতায় আমাদের সাথে  কত তফাৎ।
097
আমরা জেনে শুনে, স্বার্থ হানীর কথা বিবেচনা করে ঘটনা পরিবর্তন করে ফেলি। এমনও দেখা যায়, কোন লাভ বা সমস্যাই নেই তথাপি অযথা মিথ্যা বলছি। একটু খেয়াল করলে বেশ বোঝা যায়, আমাদের দৈতানুভুতি। অন্তর আর বাহির এক না। অথচ এদেশীয়দের অন্তর-বাহিরের মধ্যে কোন তফাৎ দেখি না। একারনেই হয়ত এরা দীর্ঘায়ু পায়। কেননা এদের মাথায় তো দুশ্চিন্তার বোঝা থাকে না, যা আমাদের মাথায় সর্বক্ষণ ভরপুর।
ফরাসী অফিস আদালত গুলোতে কর্মকর্তা কর্মচারীরা বসে, জনসাধারণের সমস্যা সমাধান তথা সেবা দেয়ার জন্য। কখনোই দেখা যায় না তারা বিরক্ত বা মুখ গোমড়া করে বসে আছে। কখনই বলে না, আজ না কাল, কাল না এক সপ্তাহ পর, এমন কোন নিয়ম বা বিষয়ই এদের নেই। নেই বাড়তি দুই টাকা কামানোর চিন্তা। যখন যা হওয়া প্রয়োজন তাই হচ্ছে। কি সাধারন প্রশাসন, কি পুলিশ প্রশাসনে। এখানকার সরকারী বিশেষ বিশেষ অফিস যেখানে প্রাত্যহিক কাজকর্মের জন্য জনসাধারন আসে, সেখানে সবাই লাইনে দাড়িয়েই সেবা নেয়। সেবা প্রদানের জন্য প্রয়োজন ভেদে ডেস্ক আছে। প্রতিদিনের জন্য নির্ধারিত কিছু কর্মকর্তা আছেন যারা লাইনে দাঁড়ান ব্যক্তিদের প্রয়োজন জেনে, নির্ধারিত ডেস্ক এ পাঠিয়ে দেন সেবা গ্রহনের জন্য। ব্যাংক, বীমা সহ বেসরকারী অফিস ও সংস্থা গুলো সেবা নিয়ে যেন বসে আছে। কোন কর্মকর্তার সাথে যদি সাক্ষাৎকার নির্ধারিত থাকে তবে নির্দিষ্ট সময়েই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারী তার নিজস্ব রুম হতে উঠে এসে আপনাকে অপেক্ষমাণ রুম হতে তার রুমে নিয়ে যাবে। আর এইটা এখানকার সমস্ত অফিস বা কার্যালয়ের সাধারন নিয়ম।
মেয়র/কাউন্সিলর এর দপ্তর গুলোতে সহকারী সমাজকর্মীরা, জনসাধারণ এর সেবায় নিয়োজিত। নির্বাচিত রাজনৈতিক মেয়রদের কাজ জনসাধারণের কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে প্রয়োজনীয় কর্ম পদ্ধতি, আইন কানুন তৈরী করা আর কর্মকর্তা কর্মচারীর কাজ সেই কর্ম পদ্ধতি জনসাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া। এখানে তোষামোদি বা পরিবার ত্রান্ত্রিকতার কোন সুযোগ নেই।
নির্বাচন পদ্ধতি অত্যন্ত সু-শৃঙ্খল। নির্বাচনে সাধারন জনগনের অংশ গ্রহন নেই বললেই চলে। সম্ভব হলে শুধু নির্বাচনের দিন ভোট দেয়া জনগনের কাজ। এই কিছু দিন আগে এক মেয়র নির্বাচন দেখলাম। প্রশাসন নির্ধারিত কোন কোন রাস্তার কর্নারে প্রার্থীদের ক্ষণস্থায়ী একটা স্ট্যান্ডে একটা পোস্টার আঁটানো। যে কজন পার্থী সে কটা স্ট্যান্ড। ভোট শেষে সেগুলো প্রার্থীরা নিজ দায়িত্বে সরিয়ে নেয়। দেয়ালে, গাছে, পরিবহনে অর্থাৎ যত্রতত্র পোস্টার লাগানোর কোন অনুমতি নেই। নেই অনুমতি মিছিল বা মিটিং করার। বিশেষ ভাবে খেয়াল না করলে বোঝার উপায় নেই ভোটের পরিবেশ। এমন কি ভোটের পরও কোন আনন্দ মিছিল নেই। নেই বিরোধীদের সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। মারামারি, হানাহানি সেতো অনেক অনেক দুরের কথা।
এনজিও গুলো সত্যিকার অর্থে বসে আছে অসহায়দের সেবা দেয়ার জন্য। দাপ্তরিক কি অর্থনৈতিক, যে কারনেই তাদের কাছে যাওয়া হোক না কেন তারা তা সর্বাত্মক ভাবে সমাধানের চেস্টা করবে। মোটকথা তারা শোষণের জন্য বা অর্থ আয়ের ধান্দায় বসে না। তারা বসে থাকে, অসহায় ও দুর্বলদের সহায়তা করার জন্য।
এখানকার পুলিশরা বন্ধুত্ব সুলভ আচরণেই অভ্যস্ত। শ্রেণী ভেদে সুসম্মান বা অসম্মান করার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে, এই ফরাসী পুলিশদের নেই। নেই সাধারণের সাথে দুর্ব্যবহার করার রীতি। মানুষকে কখনো এরা গরু বা অন্য প্রানী ভাবতে পারে না। পুলিশ অফিস, বাংলায় যাকে থানা বলে, সেখানে ঢুকার জন্য কোন অনুমতির প্রয়োজন নেই। ২/৩ জন ব্যক্তি বসে আছে, সমস্যা শুনে সমাধান দেবার জন্য। তারও আগে ২/১ জন অপেক্ষা করছে আগতদের সমস্যা জেনে নির্ধারিত লাইনে ভাগ করে দিতে। এমনকি সেখান থেকেও আগত কেউ কেউ সমাধান নিয়ে চলে যায়। ডেস্ক পর্যন্ত যেতেই হয় না।
এক কাজের জন্য দুই বা ততোধিক বার যাবার প্রয়োজন নেই। নেই আমাদের থানার মত অনুন্নত ব্যবস্থা। সাধারন লোকজন দেখলেই গরু বা জন্তুর মত তাড়ানোর চেস্টা তারা কখনই করে না। ওজন বুঝে সম্মান বা অসম্মান দেখানো কিম্বা দুটাকার বিনিময়ে বৈধকে অবৈধ অথবা অবৈধকে বৈধতা দেয়া তাদের রীতি নীতির বাইরে। এ সমস্ত কর্মকাণ্ড এদের রীতি বা ইচ্ছে কোনটার মধ্যেই পরে না। বোঁজ(Bonjour!) সম্বোধন করে, হাসি মুখে কথা বলা এদের এক ঐতিহ্য। যা আমাদের থানা পুলিশদের কাছে পাওয়া আর পূর্ণিমার চাঁদ হাতে পাওয়া একই বই তফাৎ হবে না। তারা যেন দেয়ার জন্যই এসেছে, নেয়ার জন্য নয়। কি থানা পুলিশ, কি রেলওয়ে পুলিশ অথবা হাইওয়ে পুলিশ।
একটা ঘটনা না বলেই পারছি না। সেদিন রাতে ঠিক রাত না সন্ধ্যা ৬টা হবে। সাইকেলসহ এক ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে বের হয়েছিলাম রাতের প্যারপিনিয় দেখতা। তো প্যারপিনিয় ষ্টেশনের প্লাটফর্মে আমরা সাইকেল চালিয়ে ষ্টেশনের কিছু ছবি তুলে অন্য গন্তব্যে যাচ্ছিলাম। এমন সময় চার পুলিশ পেছন থেকে আওয়াজ দিল, বোঁ সোয়া মসিউ (Bon soir Monsieur শুভ সন্ধ্যা জনাব) আমি ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম! আমি কি? তারা হাঁ বলে, হন হন করতে করতে এসে আমাদের দুজনকে ঘিরে ধরল। ভদ্রতার সাথে জানাল প্লাটফর্মে বাইসাইকেল চালানো অবৈধ আর প্রশ্ন ছবি তুললাম কেন। সংগে সংগে আমি দুঃখিত হলাম বাসাইকেল চালানোর জন্য আর ছবি তোলার ব্যাখ্যা দিলাম। আমাদের আইডি দেখে  হাস্যজ্জল কথোপকথন সেরে বিদায় নিল। ১৯৯৩ এর এক ঘটনা বাংলাদেশের।
আমার ভাগ্নে হারিয়েছে বাসা থেকে। আমি আর বন্ধু খোজাখুজি সেরে রাত তিনটার দিকে গাবতলি থেকে মোঃপুর এর বাসায় ফিরছিলাম। কল্যাণপুর এ পুলিশ আমাদের থামিয়ে ঘড়ি খুলে তাদের দিতে বলল। নানান প্রকৃতির প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে আমার ঘড়ি সংক্রান্ত সাক্ষাৎকার চলল। প্রায় ১/২ ঘন্টা পর মহোদয়েরা আমাদের বাসায় ফিরার অনুমতি দিল। বাংলাদেশ পুলিশের অন্যায় ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের কথা সারা দিন-রাত এমনকি একজন মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত লিখলেও শেষ হবে না। পক্ষান্তরে ফরাসী পুলিশ এর শুনাম আজীবন গাইলেও শেষ করা যাবে না। হাইওয়ে পুলিশও তেমনি যেমন এদের রাস্তাঘাট। অন্যায় করেছেন তো জরিমনা গুনতে হবে তা আপনি যেই হোন! রাজনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক এর চামচা!
এই সেদিনের কথা। হঠাৎ এক বিশেষ প্রয়োজনে আমাদের ৪৫৪ কিমি দূরে যেতেই হবে। এদিকে বেলা আড়াইটায় এক সাক্ষাতকার নির্ধারিত আছে। পরদিন আমাদের পাঠশালা খোলা দেড়টা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত। চিন্তা ঠিক সকাল নটায় গিয়ে সেই সাক্ষাৎকারটা পরিবর্তন করে আমরা গাড়ী নিয়ে বেড়িয়ে পরবো। ঠিক পনে নটায় ফোন দিয়ে আমার সাক্ষাৎকার সময় পরিবর্তন হল। সাড়ে দশটায় আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতে হবে বিকাল তিনটা দশ মিনিটে। টুকটাক ব্যস্ততা আর গাড়ীতে তেল ভরে বেলা ১১টায় রওনা দিলাম। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা টোল রোডে ঢুকে পরলাম। গতি সীমা ১৩০কিমি আর আমার বাহনও ঠিক ১২০ থেকে ১৩০ কিমি গতিতে চলছে। কোথাও কোন সিগন্যাল নেই। নেই ভাঙ্গাচুরা রাস্তা। গাড়ীর গেয়ার ফেলা আছে ৫ এ আর ক্লাস বা ব্রেকে তো পা দেবার দরকার নেই।
মাঝে মাঝে রাস্তা নেমে গেছে নিকটবর্তী শহরে আবার শহর থেকে উঠেও এসেছে। সে এক দারুন কায়দা। যারা নামছে ও যারা উঠছে উভয়েই অন্যান্য গাড়ীর গতিকে কোন ভাবেই বাধাগ্রস্ত করছে না। সুতরাং অন্যান্য গাড়ীর সেই ১২০/১৩০কিমি গতিতেই চলছে। রাস্তায় বিশ্রাম করা ও ঘুম দুর বা নাস্তা করার জন্য প্রায় ৪০কিমি পর পর একধরণের পার্কিং আছে যেখানে কোন দোকান পাট নেই। আবার এ রকম দুই পার্কিং এর মাঝে আছে সার্ভিস ষ্টেশন যেখানে জ্বালানী ও খাবার দাবার পাওয়া যায় এমনকি থাকার হোটেল আছে এসব সার্ভিস ষ্টেশনে। সুদৃশ্য এ সার্ভিস ষ্টেশন দেখে মনে হয় যেন কোন শহরে ঢুকেছি। ক্রসিং গুলো কখনও নীচে, কখনও উপর দিয়ে পার করা, যাতে কোন বাহনের গতি পরিবর্তন করতে না হয়।
২৩০ কিমি ড্রাইভ করে এক পার্কিং এ দাঁড়ালাম হালকা নাস্তা আর সামান্য বিশ্রামও হয়ে গেল। এর পর এক সার্ভিস ষ্টেশনে দাড়িয়ে জ্বালানী নেয়া হল। এ দুইয়ে প্রায় ৪৫ মিনিট সময় গাড়ী চালনা থেকে বিরত ছিলাম। ৩টা ৪৫মিনিটে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে প্রায় ঘন্টা খানেকের মধ্যে নির্ধারিত কাজ সেরে পুনরায় ফিরে আসার প্রস্তুতি নিলাম। ফিরে আসার পথেও মনোরম পরিবেশে দুবার দাঁড়িয়েছিলাম জ্বালানি আর বিশ্রাম এর জন্য।  ৪টি বড় বড় শহর ডিঙ্গিয়ে আমরা ফিরে এলাম রাত ১১টায় নিজ বাসভবনে। এর মধ্যে আমাদের খরচ গেল ১৭০ ইউরো। ৮০ ইউরোর টোল আর ৯০ ইউরোর জ্বালানি। ২ঘন্টা ৩০ মিনিটের বিশ্রাম সহ ১২ ঘন্টার ড্রাইভ। দেশের সাথে তুলনা করা বোকামীই বটে। তবে আপনারা যারা আমার এ লেখাটা পড়বেন তারা সহজেই পার্থক্য অনুধাবন করতে পারবেন। এতো গেল ব্যক্তিগত বাহনের কথা। চলুন না দেখি সরকারী বাহনের পরিস্থিতি। ট্রেনের চালক কখনই কোন বড় দুর্ঘটনা ছাড়া ২/১ মিনিট দেরী করে না। ঠিক দুর পাল্লার বাসও তাই। এছাড়া ইউরোপ এর অধিকাংশ দেশেই কার, মাইক্রোবাস, ট্রাক জাতীয় গাড়ীও প্রয়োজনে নির্ধারিত সময়ের জন্য ভাড়া নিয়ে নিজে ড্রাইভ করে প্রয়োজন মিটিয়ে নির্ধারিত সময়ে ফেরত দেয়া যায়।
সামাজিক ব্যবস্থায় পুলিশ ও প্রশাসনের কোন নিপীড়ন নেই। নেই রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা মাস্তান কর্তৃক হত্যা। পুলিশ বা প্রশাসনের লোক ঘুষ নেবে বা দেবে এটা কেউ স্বপ্নেও দেখে না। বাংলাদেশে একদিনে যে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে এখানে সারা বছরেও তা ঘটতে দেখা যায় না। খাদ্য-দ্রব্যে ভেজাল এখানে কেউ কল্পনাও করে না। পরিবহনে নিজস্ব দায়িত্বেই সবাই টিকিট করে যদিও খুব অল্প সময়ই চেকার উঠে। একেবারে টিকিট ছাড়া যে কেউ গাড়ীতে আরোহন করে না তা কিন্তু না। এমন কেউ মাসে একবার ধরা পরলেই পরিবহনের শ্রেণী অনুযায়ী যে জরিমানা গুন্তে হয়, তা পুরো মাসের টিকিট খরচের সমান। শহরে যত্রতত্র গাড়ী পারকিং করার এক্তিয়ার কারো নেই। শহরের রাস্তায় যানজট হয় না তা নয় কিন্তু পরিছন্ন ও নিয়ম মেনে চলার কারনে খুব দ্রুত যানজট কেটে যায়। নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌছানোর জন্য রয়েছে পরিবহন নিশ্চয়তা। প্রতিনিয়ত মৃত্যু সড়ক দুর্ঘটনা নেই। নেই কেনা কাটায় দামাদামি ও বাড়তি সময় নষ্টের সম্ভবনা।
সরকার কর্তৃক পণ্যের যথাযথ মান নিয়ত্রন ব্যবস্থা থাকায় ইচ্ছে হলেই যাতা বাজারে উঠানো যায় না। যায় না, ইচ্ছে হলেই ব্যবসা করা বা কিছু বিক্রি করা। তবে, অবৈধ অভিবাসীদের অনেকে জীবন বাঁচাতে আইন ভেঙ্গে টুকটাক ব্যবসা করে যা পুলিশ প্রশাসন সময়ে বন্ধের চাপ দিলেও মাঝে মাঝে সুযোগও দেয়।
আইন ও আইনের প্রয়োগ এখানে যথাযথ, অযথা কোন আইন নেই, নেই তার অপপ্রয়োগ। যাকিছু তার সবটুকুই জন কল্যাণে। কিভাবে জনকল্যাণ ও জনগনের সুযোগ সুবিধা বাড়ান যায় তা নিয়ে এদের ভাবনা। এরা যা কিছু করে বা করে রেখেছে তার সবই জনকল্যাণ মুখী।
স/আর