ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে রাবি শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

রাবি প্রতিনিধি:

প্রেমের সমপর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার হতাশায় রাবির এক প্রাক্তন ছাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘ফেসবুকে’ স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। বৃহস্পতিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) ভোর ৬টার দিকে নিজ বাসায় বিষপান করেন তিনি।

আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীর নাম ইশতিয়াক মাহমুদ পাঠান। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বাংলা বিভাগের ২০১০-১১ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি যশোরের আর এন রোডে। পিতা মৃত সৈয়দ আলী পাঠান ও মাতা সৈয়দা আমেনা বেগম। পাঁচ ভাই-বোনদের মধ্যে তৃতীয় সন্তান তিনি।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক সরকার সুজিত কুমার। তিনি বলেন, ‘অনেক আগের শিক্ষার্থী হওয়ায় সব কিছু এই মুহুর্তে বলতে পারছি না। তবে ওই শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগের এটা নিশ্চিত।’

ইশতিয়াকের চাচাতো ভাই রুশো জানান, ঘটনার পর রুমের দরজা ভেঙে তাকে বের করা হয়। পরে  আশঙ্কাজনক অবস্থায় প্রথম যশোর প্রিন্স হসপিটাল। তারপর যশোর সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার পর হেলিকপ্টার করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।

এদিকে, আত্মহত্যার আগে আবেগঘন এক ফেসবুক স্ট্যাটাস বর্ণনা করেছেন তার মৃত্যুর কারণ। স্ট্যাটাসে ইশতিয়াক মাহমুদ তার প্রেমঘটিত বিচ্ছেদের ফলে নিজের হতাশাগ্রস্থের কথা তুলে ধরেন। তাছাড়া আরেকটি স্ট্যাটাসে তিনি ‘বিদায় পৃথিবী’ লিখেছেন। যেটি ছিল তার সর্বশেষ স্ট্যাটাস।

স্ট্যাটাসটি হবহু তুলে ধরা হল

শুভ সকাল
লেখাটা যখন আপনারা পড়বেন, তখন আমি আপনাদের ছেড়ে অনেক দূরের, না ফেরার দেশের যাত্রী। আমি জানি, আপনাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা আমাকে ভালোবাসেন। হয়তো কোন কারণ ছাড়াই বাসতেন। খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলাম না হয়তো কারোর কাছে। তবে ছিলাম তো?
আবার অনেকেই আছেন যারা আমাকে ঘৃণা করতেন।
কেন করতেন??!
আপনাদের মধ্যেই কেউ একজন আমাকে মাথায় তুলে আবার ছুড়ে ফেলেও দিয়েছেন। তাতেও আমার কারোর বিরুদ্ধে আর কোনই অভিযোগ নেই।

আমার সমস্যা শুধু আমার নিজেকে নিয়ে। নিজের মনটাকে আর বুঝিয়ে রাখতে পারছিলাম না। মনের সাথে যুদ্ধ করে আমি
বার বার হেরে যাচ্ছিলাম। রোজই মৃত্য আমাকে তাড়া করছিলো। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না; সেই কবে থেকে। গত কিছু দিন আমি অসহ্য মানুষিক যন্ত্রণা সহ্য করেও বাঁচতে চেয়েছি। ভরপুর বেঁচে থাকার স্বাদ ছিলো। সম্বব্য সব মানুষের কাছে বেঁচে থাকার আর্জি জানিয়েছি। আমি বার বার বাঁচতে চেয়েছিলাম।

আমি সব সময় একজন সাহিত্যিক হতে চেয়েছিলাম। লর্ড বায়রন, দস্তয়েভস্কি’র মতো অসাধারণ গল্প, উপন্যাস লিখে পাঠকদের মুগ্ধ করে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুধু এই ভয়ংকর লিখাটাই লিখতে পারলাম। আমি সাহিত্য, ছোট গল্প আর কবিতা ভালোবাসতাম। এরপর একদিন?!
একদিন আমি একটা মানুষকেও ভালবেসে ফেললাম!।

কিন্তু সেদিন বুঝিনি মানুষকে ভালোবাসা সবচেয়ে বড় পাপ। শুধু মাত্র মানুষই ভালোবাসার বদলে ঘৃণা দেয়। মানুষকে ভালোবাসার কারণে পৃথিবীতে মানুষ যে পরিমাণ শাস্তিভোগ করেছে আর কিছু তে তার অর্ধেকও করেনি। ভালোবেসে কাছে আসার অপরাধে মানুষকে জীবন দিয়ে তার মূল্য দিতে হয়। বুঝিনি সেই মানুষটার অনুভূতি গুলো মিথ্যার ছিলো। প্রেম কে পাপ বানিয়ে ফেলা তার কাছে যৈতিক। কত সহজে সব পিষে দূরে ছুড়ে ফেললো। তার বিশ্বাসের রঙও কালো ধোয়ায় মোড়ানো ছিল। আমার নিজস্বতা আমি তার মধ্যে হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেখান থেকে আর ফিরে আসতে পারিনি। আমি পুরোপুরি বিলিন হয়ে গেলাম। দিনের পর দিন সে আমাকে নিঃস্ব হতে সাহায্য করেছে। এসব কিছুই বুঝিনি আমি। শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হল আমি কত বোকা!

যখন বুঝলাম; তখন দেখলাম দুঃখ পেয়েও ভালবাসা পাওয়া সত্যিই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন মানুষের সাথে অন্য একজন মানুষ কতো সহজে কি নিষ্ঠুরতা করতে পারে। একটি বিশ্বাস, একটু ভালোবাসা, এমনই সস্তা কোন জিনিস যে তার প্রতি এতো বেশি আবহেলা?

আচ্ছা!
মানুষের সাথে মানুষের আরচণ এমন হবে কেন? মানুষ নাকি সৃষ্টির সেরা জীব!

কখনো কোন মানুষকে পরিপূর্ণ ভালোবাসা ঠিক না। তাহলে নিজের জন্য আর একটুও ভালোবাসা অবশিষ্ঠ থাকে না। পরিপূর্ণ ভাবে কাউকে ভালোবাসলে পরিপূর্ণ নিঃস্ব হয়ে যেতে হয়। ছোট বেলা থেকেই একটু ভালোবাসা পাবার জন্য লালায়িত ছিলাম। তাই হয়তো আকাতরে অপাত্রে ভালোবাসা দিয়ে গেছি।বিনিময়ে শুধু ঘৃণা পেয়েছি। ভালোবাসা যে কি সেটা শুধু কাউকে পরম ভালোবাসলেই বোঝা যায়।

প্রথমবার এই চিঠি লিখছি।
এবং শেষ বারও। আমায় ক্ষমা করবেন, আমার কথার যদি অর্থ না বোঝেন? তাহলে ধরে নিবেন একটা পাগল ছাগল লোকের কথা এমনই হয়।আমার জন্ম একটা দুর্ঘটনার মতো। শৈশবের একাকীত্বের অভাব আমি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। হতে পারে পৃথিবী আমার জন্য কঠিন ছিলো। আমি বুঝতে পারছি আমি ভুল করেছি। সব সময়, সব কিছু পুরোটাই। ভালবাসা, ঘৃণা, যন্ত্রণা, জীবন, মৃত্যু, সব কিছুই বুঝতে হয়তো আমার ভুল হয়েছে। না! আমার বোঝার কোন তাড়া ছিল না। আসলেই ছিলো না। কিন্তু আমাকে সবসময় যন্ত্রণার কাটাতারের উপর হাটতে হয়েছে। একটা জীবন এতো যন্ত্রণার কেন?!

সেই সব মানুষেরা, যারা আপন মানুষের বেশ ধরে কাছে এসে বুকে হাত রাখে। তারপর চলে যাবার সময় হৃদপিণ্ডটা ছিড়ে নিয়ে যায়। অন্যের জীবন যাঁদের কাছে এতো মূল্যহীন তারা ভালো থাকে কি করে??

না, আমি কষ্টে নেই এখন। আমার কোন দুঃখ বোধও নেই। কোন যন্ত্রণা নেই। আমি শূন্য। সব দুঃখ, কষ্টের অবসান হতে চলেছে। চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম নেমেছে। একটু পরই ঘুমিয়ে যাবো। একেবারে চিরকালের মতো। অতল থেকে অতালান্তে।
নিজেকে নিয়ে আমি চিন্তিত নই। যেটা পেয়েছি আমি জানি সেটা কত ভয়ঙ্কর। আর সেই জন্যই আমি আজ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মানুষ হয়তো আমাকে বোকা বলবে, আমাকে ভীতু বলবে। আবার স্বার্থপরও বলবে। অথবা বলবে আমি গাধা। কিন্তু আমাকে কে কি বলবে, না বলবে তাতে এখন আর আমার কিছু আসে যাবে না।

আমি মৃত্যু পরবর্তী জীবন, আত্নার ঝুলে থাকা, আত্নার আফসোস নিয়ে ভেসে বেড়ানো; এসব কিছু নিয়ে ভাবছি না। সত্যিই যদি পরকাল বলে কিছু থাকে, তাহলে নিশ্চিত একদিন আমি হাবিয়া দোজখে যাবো। আর সেটা এই সময়ের চেয়ে হয়তো কঠিন হবে না। জীবন কঠিন যন্ত্রণা আর অবহেলার। মৃত্যু সেই সব থেকে মুক্তি দেয়। জীবনের চেয়ে মৃত্যু সহজ।

মামনি যেদিন সবার সামনে চড়,থাপ্পড় দিয়েছিলো…. ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বলেছিলো বাসা থােকে বের হয়ে যাহ্!….. গলা ধাক্কা খাবার মতো কোন অপরাধ কি আমি সত্যিই করেছিলাম! সেদিন আমার অপরাধ কতটুকু ছিলো?!
তারপর আমার কেবলই মনে হতো সবার নিজের একটা বাড়ি থাকা আবশ্যক। একেবারে নিজের বাড়ি। যেখান থেকে কেউ তাকে বের করে দিবে না। আমার সেই নিজের বাড়ি আমি পেয়ে যাবো আজ…..

তোমাকে দোষ দিবো না। দিতে চাইও না। তোমার কোন অন্যায় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি তুমি দুঃখিত হবার চেয়ে রাগান্বিত হয়েছো বেশি। তুমি তোমার ভুলটা বুঝতে পারোনি; বরং আমাকে ভুল বুঝেছো। যে কোন সম্পর্কের মধ্যে শুধু কমিটমেন্ট থাকলে হয় না, সেই কমিটমেন্ট রাখারও কমিটমেন্ট থাকতে হয়। ভালোবাসার মধ্যে শীতলতা থাকতে হয়। আপনজনের সাথে তরল কন্ঠে কথা বলতে হয়। রাগ, অভিমান এগুলো সব সম্পর্কের মধ্যেই থাকে। তোমাকে হয়তো আমার ভালোবাসাটা বোঝাতে পারিনি। তোমাকে ভালোবেসে আমি সব ছেড়েছিলাম। সবাই কেই।
তার বিনিময়ে?!
তুমি আমাকে ছেড়েছো।
আজ আমার কেউ নেই। কিছু নেই। সব হারিয়ে যাকে পেতে চেয়েছিলাম সেও হারিয়ে গেল। পুরোপুরি নিঃস্ব যাকে বলে।
আমার ভুল কি ছিলো?
আমার অপরাধ টা কি??
মানুষ হিসেবে কি আমার জানার অধিকার নেই?

-এর পরের স্ট্যাটাসে ‘বিদায়’ লিখে আত্মহত্যা করেন তিনি।

জি/আর