ফেলনা প্লাস্টিক ‘ফেলনা’ নয়

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

খুলনার খালিশপুর এলাকায় মোংলা কাস্টম হাউস সড়কের বিপরীতে একটি দেয়াল ঘেঁষে স্তূপ করে রাখা আছে প্লাস্টিকের খালি বোতল। পাশের ছোট ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে এমন হাজার হাজার বোতল। পাশাপাশি বিভিন্ন ভাঙাচোরা প্লাস্টিক সামগ্রীর বড় বড় স্তূপ। কয়েকজন নারী-পুরুষ স্তূপের পাশে বসে বোতলের গা থেকে কাগজের লেবেল আলাদা করছেন। এরপর বোতল থেকে ছিপি খুলে আলাদা করে রাখছেন। একেক রঙের বোতল রাখা হচ্ছে একেক বস্তায়।

কথা হয় নার্গিস আক্তার নামের একজন কর্মীর সঙ্গে। তাঁর কাজ পণ্যের শ্রেণি ও মান অনুযায়ী আলাদা করা। নার্গিস জানান, তিনি মাসিক ৬ হাজার টাকা মজুরিতে প্লাস্টিক বাছাইয়ের কাজ করেন। তাঁর সঙ্গে আরও কাজ করছেন ফারজানা, শাহানা, লিলিসহ মোট ১৪ জন কর্মী। একেকজনের কাজের ধরন ও বেতন একেক রকম।

খুলনা শহরে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বোতল এবং অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করা ও প্রক্রিয়াকরণের ২০টি কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল কেটে ছোট ছোট টুকরা করা হয়। পরে তা বিদেশে রপ্তানি হয়। আর অন্যান্য ফেলনা প্লাস্টিক গুঁড়া করা হয়, যা দেশের ভেতরেই রিসাইক্লিং বা পুনরুৎপাদন শিল্পের বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়।

উদ্যোক্তারা জানান, তিন-চার বছর আগেও খুলনায় প্লাস্টিক প্রক্রিয়াকরণের চার-পাঁচটি কারখানা ছিল। এখন ২০টি কারখানায় অন্তত ৪০০ জন কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে।

কুড়িয়ে পাওয়া প্লাস্টিকের বোতল ও অন্যান্য প্লাস্টিক পণ্য সংগ্রহ করে তা কেটে বিক্রি ও রপ্তানি করা হয়। খুলনায় গড়ে উঠেছে ২০টি কারখানা।

খুলনায় উচ্ছিষ্ট বোতল ও প্লাস্টিক থেকে ফ্লেক্স উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে গঠন করা হয়েছে খুলনা প্লাস্টিক মালিক সমিতি নামের একটি সংগঠন। জানতে চাইলে সংগঠনটির সভাপতি মেট্রো প্লাস্টিক কারখানার মালিক মো. মনির হোসেন   বলেন, ফেলনা প্লাস্টিক এখন আর ফেলনা নয়। এসব প্লাস্টিক পণ্য সংগ্রহ করে বিক্রি করায় একদিকে শহর পরিচ্ছন্ন থাকছে, অন্যদিকে মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তিনি বলেন, খুলনায় কয়েক বছরে এই ব্যবসার পরিসর ও পরিধি বেড়েছে। প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। এখন এসব প্লাস্টিকের প্রচুর চাহিদা।

খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) পরিচ্ছন্নতাকর্মী, পথশিশু, ছিন্নমূল মানুষেরা রাস্তা ও পার্ক থেকে প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে উচ্ছিষ্ট পণ্যের দোকান বা ভাঙারির দোকানে বিক্রি করেন। ভাঙারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সেগুলো কিনে নেন প্লাস্টিক প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মালিকেরা। সেখান থেকে বাছাই করে সাদা, সবুজ ও বাদামি রঙের বোতল আলাদা করা হয়। আলাদা করা বোতল ১ ইঞ্চির মাপে কাটা হয়। টুকরাগুলোকে বলা হয় ফ্লেক্স। এগুলো পরিষ্কার করতে যন্ত্রে সোডা ও ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ধোয়া হয়। এরপর তা পানিভর্তি চৌবাচ্চায় ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে ছাঁকনি দিয়ে পানি ঝরিয়ে রোদে শুকানো হয়।

ব্যবসায়ীরা জানান, প্লাস্টিকগুলো মানভেদে ২০-২৫ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। রপ্তানির জন্য তা ২৫ কেজি করে প্যাকেট করা হয়। এগুলো যায় চীন ও ভারতে।

প্লাস্টিক প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলো খুলনা নগরের সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের পেছনে এবং দৌলতপুর, খালিশপুর, গোয়ালখালী, আড়ংঘাটা, জিরোপয়েন্ট, লবণচরা ও ফুলতলা বাইপাস এলাকায় গড়ে উঠেছে।

রেজা প্লাস্টিক কারখানার সত্বাধিকারী মো. রেজা  বলেন, শীতকাল ছাড়া বাকি সময় কাঁচামালের সরবরাহ ভালোই থাকে। গ্রীষ্মে মানুষ বেশি পানীয় পান করে বলে কাঁচামালের সরবরাহ অনেক বেশি থাকে।

কারখানার মালিকেরা জানান, তাঁরা সাদা ও সবুজ বোতল কেনেন প্রতি কেজি ২৫-২৮ টাকায়। এ ছাড়া বাদামি বোতল প্রতি কেজি ১৫-১৬ , ভাঙা প্লাস্টিক সামগ্রী ২৮-৩০ এবং স্যালাইন ব্যাগ ও সিরিঞ্জ ৩৫-৪০ টাকায় কেনেন তাঁরা। কাটা ও পরিষ্কার করার পর সাদা বোতলের টুকরা প্রতি কেজি ৪০-৪১, সবুজ বোতলের টুকরা ৩৫-৩৬ ও বাদামি বোতলের টুকরা ২৫-২৬ টাকায় বিক্রি হয়। সবচেয়ে ভালো মানের প্লাস্টিক টুকরা বিক্রি হয় ৬০-৬৫ টাকায়। এ ছাড়া স্যালাইন বোতল ও সিরিঞ্জ থেকে পাওয়া প্লাস্টিক টুকরা ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি করেন তাঁরা। সব খরচ বাদ দিয়ে কারখানার মালিকদের প্রতি কেজিতে দুই টাকা মুনাফা থাকে।

সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের পেছনে আল মক্কা প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক আবদুল ওয়াদুদ মিয়া জানান, রপ্তানিযোগ্য বোতলের টুকরার ৫০০ বস্তায় (২৫ কেজি করে) হয় এক কনটেইনার। বোতলের ফ্লেক্স উৎপাদন করার পর তা ঢাকায় নেওয়া হয়। সেখানে একটি কেন্দ্রীয় সমিতি আছে। সমিতির মাধ্যমে সেগুলো বিদেশে রপ্তানি করা হয়। এ ছাড়া অন্যান্য প্লাস্টিকের টুকরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত প্লাস্টিক কারখানাগুলো কিনে নেয়।

আবদুল ওয়াদুদ মিয়া জানান, তাঁর কারখানায় মাসে ২০ টন করে ফ্লেস্ক উৎপাদিত হয়। এ ছাড়া তিনি গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, পিরোজপুর এলাকার বিভিন্ন কারখানা থেকে মাসে ৮০ টন টুকরা করা বোতল ও প্লাস্টিক কেনেন। নগদ টাকায়, এমনকি অগ্রিম টাকা দিয়ে এগুলো কিনতে হয়।