প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় মেয়েদের সাফল্য

মোঃ ওসমান গনি

২০১৪ সালের জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহের শ্লোগান ছিলো ‘‘কন্যা শিশুর প্রতি করো নাকো ভুল, এক একটি কন্যা যেনো সুরভিত ফুল।’’ সত্যিই ২০১৬ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (PEC)  পরীক্ষার ফলাফল এটিই প্রমাণ করে দিলো। সারা দেশের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেলো ছেলেদের চেয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় উপস্থিতি অনেক বেশি, পাশের হার বেশি এবং জি পিএ- ৫ পাওয়ার সংখ্যাও বেশি।

২০১৬ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলো ২৮ লাখ ৩০ হাজার ৭৩৪ জন। পাশ করেছে ২৭ লাখ ৮৮ হাজার ৪৩২ জন। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও পাশের হার দুই দিক দিয়েই মেয়েরা এগিয়ে। মেয়েদের পাশের হার ৯৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ ও ছেলেদের পাশের হার ৯৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ এই পরীক্ষায় মোট জি পি এ – ৫ পেয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৮৯৮ জন। এর মধ্যে প্রায় ৫৫ শতাংশই মেয়ে।

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (PEC) পরীক্ষায় মেয়েদের ফলফল দেখে বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মাননীয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। আমাদের দেশ মেয়ে শিক্ষায় দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের জনগণ দিন দিন মেয়ে শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। দেশের মানুষ সচেতন হচ্ছে মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন ‘‘কোন কালে একা হয়নি জয়ী পুরুষের তরবারী শক্তি দিয়েছো, প্রেরণা দিয়েছো বিজয়লক্ষ্মী নারী’’। সত্যিই নারীরা পুরুষদের যুগে যুগে কালে কালে যে কোন মহৎ কাজে প্রেরণা, শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে।  সুখে দুঃখে পুরুষের পাশে থেকে কাজ করেছে। জাতীয় জীবনে নারীদের অবদান অনেক। সেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রীতিলতা  থেকে শুরু করে আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান অনেক। আবার কোন কোন নারী সমাজ সংস্কার হিসেবে কাজ করেছেন। যেমন-বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত। তাঁদের অবদানের জন্য আজ মাত্র ৪৫ বছরের স্বাধীনতার পর আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নয়ন লাভ করেছি। যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও গার্মেন্টস শিল্পে।

বাংলাদেশের জনগণের অর্ধেক নারী। নারীদের উন্নয়নের জন্য সরকার প্রাথমিক শিক্ষার ৬০% মহিলা কোটা দিয়েছে। এর ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের মাতৃস্নেহ, মায়া-মমতা, সোহাগ দিয়ে লেখাপড়া করান। আর তার ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা সঠিক ভাবে লেখাপড়া করার ফলে ফলাফল অনেক ভালো হয়েছে। বাড়িতে শিক্ষার্থীরা পিতা-মাতার কাছে যে ধরণের আদর, সোহাগ, স্নেহ, মায়া মমতা পায় বিদ্যালয়ে এসে তারা নারী শিক্ষকেরা সেই একই ভাবে শ্রেণি পঠন-পঠন ও শিখন-শেখানো কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেন। বিভিন্ন শিক্ষামূলক গবেষণায় দেখা গেছে বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাক্ষেত্রে নারী শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের খুব সহজে আপন করে নিতে পারে এবং শিক্ষার্থীরাও তাদের আপন করে নেয়। কাজেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নারী শিক্ষকদের শিক্ষাদান অনেক কার্যকরী ও ফলদায়ক হয়।

২০১৬ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (PEC) পরীক্ষায় মেয়েরা যে ভালো ফলাফল করেছে তার জন্য প্রথমত আমি বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ দিবো। কারণ বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে বিশেষ নজর দেয়। বর্তমান সরকার প্রথম ২০১০ সাল থেকে বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ ০১ জানুযারী থেকে বই প্রদান শুরু করে। ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ দীর্ঘ আট বছর ০১ জানুয়ারী সারা দেশ বই উৎসব পালন করছে। ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সরকার প্রায় ২২৫ কোটি ৪৩ লাখ ১হাজার ১২৮ টি পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করেছে। এটি বর্তমান সরকারের একটি ভাল উদ্যোগ আর এর জন্য সরকার আমাদের মতো শিক্ষকদের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। যখন বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীরা নতুন বই নিয়ে বাড়ি ফিরে তখন তাদের চোখে মুখে যে আনন্দের ছটা দেখা যায়, এটা আমাকে খুবই আনন্দিত করে। আমাদের সময়ে নতুন শিক্ষাবর্ষের বই পেতে পেতে ১/২ মাস লেগে যেতো। বর্তমান সরকার এই সমস্যার সমাধান করেছে। তাই প্রতি বছর ০১ জানুয়ারী বই উৎসব পালন করা হচ্ছে।  ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ১ম শ্রেণী থেকে ডিগ্রী পর্যায় পর্যন্ত ১ কোটি ৭২ লাখ ৯৩ হাজার ১১৮ জন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মেধাবৃত্তি ও উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে।

প্রাথমিক মেয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় ভালো ফল আজ লাখ লাখ পরিবারকে উল্লসিত করেছে। তবে এ সাফল্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে সরকারের শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের আরও সজাগ হতে হবে। স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া হার রোধে ও উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষত মেয়ে শিশুদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখতে সকল অভিভাবকদের উৎসাহ যোগাতে হবে। অভিভাবকদের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

আমাদের দেশে যে সমস্ত সামাজিক  সমস্যা আছে যেমন-বাল্যবিবাহ, মেয়ে শিক্ষার প্রতি অভিভাবকদের অনীহা। বর্তমানে আর একটি নতুন সমস্যা যোগ হয়েছে। ইভটিজিং তা দূর করতে হবে। মেয়েদের শিক্ষার জন্য সঠিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এই সমস্ত সামাজিক সমস্যা দূর করার জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এগিয়ে আসতে হবে।

২০১৬ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (PEC) পরীক্ষায় মেয়েদের ভালো ফলাফলের বিষয় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেছেন, মেয়েদের এই ফলাফল অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ সাধারণ প্রবণতা হলো পড়াশোনায় মেয়েরা বেশি মনোযোগী থাকে। এছাড়া উপবৃত্তি মেয়েদের শিক্ষায় টিকে থাকাও ভালো ফল করার সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। মানুষের সচেতনতাও বেড়েছে। এর মূল কারণ বাল্যবিবাহ। এ জন্য প্রাথমিকে এই অর্জন ধরে রাখতে সরকারকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।

বর্তমান সরকার একটি শিক্ষা বান্ধব ও শিক্ষক বান্ধব সরকার। তাঁর প্রমাণ ০১/০১/২০১৩ সালে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে ২৬,১৯৩ টি বিদ্যালয় এবং ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষকের চাকুরী সরকারীকরণ করে। বিদ্যালয় বিহিন ১ হাজার ১২৫ টি গ্রামে নতুন করে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। আর কোন সরকার এইভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের মূল্যায়ন করেনি। এর ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেসরকারি শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দুঃখ-কষ্ট, দূরদশা লাঘব হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সঠিক পরিবেশ ফিরে আসে। এছাড়া ২০১৫ সালের ০১ জুলাই থেকে সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি শিক্ষার্থীকে শতভাগ উপবৃত্তি প্রদান করছে। এর ফলে প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ঝড়ে পড়ার হার প্রায় শূন্য পর্যায়ে নেমে এসেছে। সরকারের যথাযথ মনিটরিং জোরদার করার ফলে প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তি ও অভিভাবকদের সচেতনাতার জন্য বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করার ফলে আজ প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (PEC) পরীক্ষায় মেয়ে শিক্ষার্থীদের সাফল্য।

আশার কথা হলো যে, আজকে যারা মেয়ে শিক্ষার্থী, একদিন বড় হয়ে তারা মা হবেন। নেপোলিয়ান বোনোপার্টি বলেছেন ‘‘তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি দিবো’’ অর্থাৎ আজকে যে সমস্ত মেয়ে শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (PEC) পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করছে তারা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাস্তরে ভালো ফলাফল করলে আমাদের দেশে নারী শিক্ষার হার আরও বেড়ে যাবে। এই সমস্ত নারীরা জাতি গঠনে অবদান রাখবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে শিক্ষার অন্যান্য স্তরে অর্থাৎ মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে গিয়ে যেন মেয়ে শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ে না যায়। কারণ মেয়েরা যত বড় হবে অভিভাবকেরা তত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চাইবে। এর জন্য সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের মা-সমাবেশ, অভিভাবক সমাবেশ করে অভিভাবকদের বাল্য বিবাহের কুফল সম্পর্কে অবহিত করে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। যাতে তাঁরা তাঁদের মেয়েদের বাল্যবিবাহ না দেন, লেখাপড়া করান। অভিভাবকদের বুঝতে হবে, আজকের মেয়ে আগামী দিনের মা। আজকের মেয়েদের সঠিকভাবে শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে আগামী দিনের মা শিক্ষিত হবে; আর আগামী দিনের মা শিক্ষিত হলে জাতিও শিক্ষিত হবে। তাহলে বাঙালী জাতি আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানে শিল্প সাহিত্যে একটি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে উঠবে। তখন বাঙালী জাতি বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। বিশ্ব দরবারে বাঙালী জাতি একটি শিক্ষিত সভ্য জাতি হিসেবে পরিগণিত হবে। তাই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (PEC) পরীক্ষায় মেয়েদের যে সাফল্য, এই সাফল্যকে সামনে আরও বেগবান করতে হবে, যাতে জাতি হিসেবে আর আমাদের মেয়ে শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়ে থাকতে না হয়।

 

লেখক,
সহকারী শিক্ষক
মচমইল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়
বাগমারা,রাজশাহী।