প্রাথমিকে নিয়োগ আটকে থাকায় কষ্টে কাটছে উচ্চশিক্ষিত প্রতিবন্ধীদের

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক:

শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরেই কর্মক্ষেত্রে নানান প্রতিবন্ধকতার শিকার। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ থাকলেও এখানেও প্রতিবন্ধী প্রার্থীরা নিয়োগবঞ্চিত। এমনকি যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে প্রতিবন্ধী কোটায় নিয়োগ পাননি অনেকেই। ফলে বাধ্য হয়েই উচ্চ আদালতের দ্বারস্ত হন এসব চাকরিপ্রার্থী। শারীরিক প্রতিবন্ধী এসব চাকরিপ্রার্থীর প্রায় সবাই-ই নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য। ফলে তাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর মতো অর্থের জোগান দেওয়া পরিবারের জন্য কষ্টসাধ্য। এ অবস্থায় তাদের অনেকেই থাকেন জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের হোস্টেলে। সেখানেও টাকা বাঁচাতে অনেক প্রতিবন্ধী দিনে একবেলা খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেন।

এমন বাস্তবতায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে ২০২০ সালের নিয়োগ পরীক্ষায় ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা পূরণ করে নিয়োগ দিতে রিট করা হয়। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২৮৫ প্রতিবন্ধী প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া প্রশ্নে জারি করা রুলের ওপর শুনানি শেষ হয়েছে। এ বিষয়ে রায় ঘোষণার জন্য আগামী ১৪ জানুয়ারি দিন ঠিক করেছেন হাইকোর্ট। ফলে উচ্চশিক্ষিত প্রতিবন্ধী চাকরিপ্রার্থীরা এখন অপেক্ষায় আছেন হাইকোর্টের আদেশের।

কিন্তু অনেকেরই প্রশ্ন, যোগ্যতা ও কোটা থাকা সত্ত্বেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হতে প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের কেন হাইকোর্টে রিট করতে হবে? লিখিত ও মৌখিক (ভাইভা) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও কেন তাদের চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না? এসব বিষয়ে জাগো নিউজকে নিজেদের আক্ষেপের কথা জানান কয়েকজন প্রতিবন্ধী চাকরিপ্রার্থী।

জাগো নিউজকে তারা জানান, বাবা-মায়ের অর্থ খরচ করে লেখাপড়া শেষ করে নিজে একটি কর্মসংস্থানে যাওয়ার স্বপ্ন তাদের। নানান প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও তারা রাষ্ট্রের উন্নয়নে রাখতে চান অবদান। পাশাপাশি মা-বাবাকেও দিতে চান স্বস্তি। প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য শিক্ষকতা উপযুক্ত পেশা দাবি করে শিগগির তারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ চান।

আমার চেয়ে কম বয়সী অনেকেই মাসে ১২ হাজার টাকা আয় করে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেও কিছু করতে পারছি না। কেউ হয়তো বলছে তোমার থেকে বয়সে ছোটরাও আয় করছে, তুমি কী করছ?

কথা হয় বাগেরহাটের পার্থ প্রতীম মিস্ত্রির সঙ্গে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরিপ্রত্যাশী এই প্রতিবন্ধী যুবক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা দুই ভাই ব্লাইন্ড (অন্ধ)। বাবা প্রান্তিক পর্যায়ের অভাবী মানুষ। এরপরও অনেক কষ্টে দুই ভাইকে পড়ালেখার খরচ জোগাচ্ছেন। ছোট ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স করছে। প্রতিবন্ধী দুই ছেলেকে বাইরে রেখে লেখাপড়া করানোর খরচ অনেক। ফলে সবমিলিয়ে আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি।’

‘এখানে কোনো সিমপ্যাথি বা ওই ধরনের কিছু আশা করছি না- আমরা বাস্তব জীবন যেভাবে পার করছি তা তুলে ধরেছি। সাংবাদিকরা লিখলে যে আমার প্রতি সিমপ্যাথি প্রকাশ করা হবে সেটা নয়। তবে বাস্তবতা এটাই, বাধ্য হয়েই আমার মতো অনেকেই জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের হোস্টেলে থাকেন।’

পার্থ প্রতীম মিস্ত্রি বলেন, ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের হোস্টেলে মিল সিস্টেম। আমরা যারা এখানে থাকি তাদের অনেকের এতটাই দুরবস্থা যে শুধু দুপুরের মিলটাই (খাবার) খাই। রাতে খাই না। সকালে যদি কিছু জোটে তো সেটা খাই। এভাবেই দিন কাটছে আমাদের।’

জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাইন্ডেশনে কেন থাকেন? এমন প্রশ্নে পার্থ প্রতীম বলেন, ‘আমরা (প্রতিবন্ধীরা) যদি একা থাকি বা একা চলাচল করি তাহলে এক ধরনের মেন্টালি ডিপ্রেশনে (মানসিক হতাশায়) ভোগার পরিস্থিতি তৈরি হয়। আবার এখানে অন্যদের সঙ্গে থাকলে চাকরি ও অন্যান্য কাজে আপডেট থাকা যায়। মাস্টার্স শেষ করার পরে তো এখন বেকার, এছাড়া আমি অন্ধ। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই এখানে থাকা।’

মাস্টার্স শেষ করেও চাকরি না পেয়ে অনেকটা আক্ষেপের সঙ্গে পার্থ প্রতীম বলেন, ‘যারা স্বাভাবিক, চোখে দেখেন- তারা অশিক্ষিত হলেও পোশাক কারখানায় চাকরি করে মাসে ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। কম করে হলেও তো ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা মাসে বেতন পান। আমার চেয়ে কম বয়সী অনেকেই মাসে ১২ হাজার টাকা আয় করে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেও কিছু করতে পারছি না। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে কী করছি, কী হচ্ছে? কেউ হয়তো বলছে তোমার থেকে বয়সে ছোটরাও আয় করছে, তুমি কী করছ? এই যে বুলিং- এসব থেকে পালিয়ে বাঁচতেই এখানে থাকা।’

তিনি আরও বলেন, ‘অনেক প্রতিবন্ধী খুবই দরিদ্র পরিবারের। আমার মতো অনেকেই আছেন যারা জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাইন্ডেশনে এক বেলা খাবার খেয়ে দিন পার করেন। বিশেষ করে রাতে কেউ খেতে চান না। শুধু আমরাই যে কষ্ট করি তা নয়, মা-বাবাও কষ্ট করছেন। যদি কিছু টাকা আয় করতে পারতাম তাহলে পরিবারের একটা সাপোর্ট হতো।’

আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আমাদের মধ্যে যে যেই কাজ করতে সক্ষম, তাকে সেটা করার সুযোগ দেওয়া হোক। আমরা আহামরি কিছু চাচ্ছি না। আমরা চাই সবার মতো যেন খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারি।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করা প্রতিবন্ধী এই যুবক জানান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার আগে চাকরির আর কোনো পরীক্ষায় অংশ নেননি। এরপর তিনি খাদ্য অধিদপ্তরে খাদ্য পরিদর্শক পদে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন। সেখানেও তার চাকরি হয়নি। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোটা পূরণ করে প্রতিবন্ধী চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগের দাবি জানান তিনি।

ইডেন কলেজ থেকে মাস্টার্স করেছেন নারায়ণগঞ্জের পারুল বেগম। জাগো নিউজকে পারুল বলেন, ‘যখন পড়ালেখা করেছি মা-বাবা খরচ জুগিয়েছেন। যখন যা চেয়েছি তা পেয়েছি। এখন বড় হয়েছি, চলতে-ফিরতে অনেক কিছুর প্রয়োজন পড়ে। এ বয়সেও পরিবারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।’

তিনি বলেন, ‘এর আগে তথ্য মন্ত্রণালয়ের লিখিত ও মৌখিক (ভাইভা) পরীক্ষা দিয়েছি। সেখানে বলেছিল চাকরি হয়ে যাবে, একটা তারিখ দিয়ে বলেছিল নিয়োগপত্র পেয়ে যাবে। কিন্তু পরবর্তীসময়ে বলা হলো ওখানে প্রতিবন্ধী কোটা নেবে না। এরপর বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএডিসি) টিকেছিলাম, সেখানেও ভাইভা পর্যন্ত গিয়ে বাদ পড়েছি।’

পারুল বেগম বলেন, ‘আমাদের কথাগুলো যেন সংশ্লিষ্টদের নজরে আসে। আর আমাদের চাওয়া হলো, আমরা যেন পরিবার ও সমাজে কারও বোঝা না হই। বাবা-মা লেখাপাড়া শিখিয়েছেন, আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আমাদের মধ্যে যে যেই কাজ করতে সক্ষম, তাকে সেটা করার সুযোগ দেওয়া হোক। আমরা আহামরি কিছু চাচ্ছি না। আমরা চাই সবার মতো যেন খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারি।’

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ পেতে হাইকোর্টে রিট করেন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন মাহবুব শেখ। জাগো নিউজকে মাহবুব বলেন, ‘খাদ্য অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও সমবায় অধিদপ্তরেও আবেদন করেছিলাম। পরীক্ষায় প্রতিবন্ধীদের জন্য একজন সহলেখক (রাইটার) থাকেন। সহলেখক আমাদের চাহিদা অনুযায়ী দেয়নি, ওনাদের মতো করে দিয়েছে। পরীক্ষায় যখন বসি তখন প্রশ্নই সঠিকভাবে বুঝিয়ে বলতে পারেন না সহলেখক। প্রশ্নই যদি বলতে না পরেন তো উত্তর দেবো কীভাবে!’

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পরীক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এত প্রতিকূলতার মধ্যে পরীক্ষা দিয়ে পাস করাটা বেশ কষ্টসাধ্য। এরপরও পাস করার পরে নিয়োগ হলো না- বিষয়টি হতাশাজনক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগে ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা থাকার পরও সেটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আশা করবো আমাদের অধিকারটুকু যেন হরণ করা না হয়। ন্যায়বিচার পেতেই আদালতে এসেছি। শিক্ষকতা পেশাটাও আমাদের জন্য উপযোগী। আশা করবো সেখানে যেন আমাদের কর্মসংস্থান হয়।’

প্রতিবন্ধী প্রার্থীরাও লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এসেছেন। কিন্তু শারীরিক সমস্যার কারণে তাদের চাকরি দেয়নি কর্তৃপক্ষ। এটা আইন ও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন। বিষয়টি সুবিবেচনা করা উচিত।

অনেক চাকরিতে কোটা না থাকায় প্রতিবন্ধীদের নিয়োগ দেওয়া হয় না বলে মনে করেন নারায়ণগঞ্জের কামাল হোসেন তালুকদার। জাগো নিউজকে কামাল বলেন, ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদ ছাড়াও এর আগে সমাজসেবা অধিদপ্তরসহ দুটি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তবে ভাইভার পর জানানো হয় সেখানে প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা নেই। এজন্য আমাদের বাদ দেওয়া হয়েছে।’

সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধীদের উপযোগী ক্ষেত্র শনাক্ত করে আলাদাভাবে নিয়োগের দাবি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কামাল বলেন, ‘সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরকারি চাকরিতে টেকা আমাদের জন্য বেশ কঠিন। সব সেক্টরে আমাদের নেওয়াও না।’

প্রতিবন্ধী চাকরিপ্রার্থীদের পক্ষে রিটকারী আইনজীবী ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘পৃথক চারটি রিটে মোট ২৮৫ জন চাকরিপ্রার্থী রয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ জন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজি দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩ জন। এছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী মিলিয়ে মোট ২৮৫ জন রিট করেছেন।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় বাদে অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও অনার্স-মাস্টার্স পাস করে এসেছেন। আমরা জানি সাধারণত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসতে চান না। বিসিএস নন-ক্যাডারে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে আমরা এমনটা দেখেছি। অথচ এসব শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেও প্রাথমিকে শিক্ষকতা করতে চান। এরা নিয়োগ পেলে প্রাথমিকের শিক্ষার মান আরও উন্নত হবে বলে আমার বিশ্বাস।’

আইনজীবী ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া আরও বলেন, ‘প্রতিবন্ধী প্রার্থীরাও লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এসেছেন। কিন্তু শারীরিক সমস্যার কারণে তাদের চাকরি দেয়নি কর্তৃপক্ষ। এটা আইন ও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন। বিষয়টি সুবিবেচনা করা উচিত।’

মুন্সিগঞ্জের শারীরিক প্রতিবন্ধী রাসেল ঢালীর প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘বিচারপতি নাইমা হায়দার বলেছিলেন, যদি তারা চাকরির পরীক্ষায় টেকে, মেধাবী হয়, যোগ্য হয়- তাদের তো চাকরি দিতে হবে। তাদের কেন আদালতে আসতে হবে?’