প্রাকৃতিক নৈসর্গে ভরা চীনের পাথরের বন: রফিকুল ইসলাম

পাথরের বন। চীনের ভাষায় যেটিকে চীনারা ডাকেন শিলিন নামে। এটির ইংরেজি নামকরণ হলো স্টোন ফরেস্ট। বাংলায় যার নামকরণ হয় পাথরের বন বা পাহাড়। পৃথিবীর আশ্বর্যজনক একটি স্থাপনা হলো চীনের এই পাথরের বন। নামটির সঙ্গে এই পাথরের বনের গঠনও যেন একই।

প্রাকৃতিক নৈসর্গে ভরা চীনের এই পাথরের বনের চারিদিকে পাথরের পাহাড় আর পাহাড়। যেদিক চোখ যায় পাথরের পাহাড়। প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ পাথরের বন। স্টোন ফরেস্ট প্রকৃতির এক অদ্ভুত খেয়াল। চারিদিকে পাথরের অভূতপূর্ব সব কারুকার্য। যেন এক নান্দনিক শৈল্পিক সমারোহে গড়া সব পাথর। এসব পাথরের মাঝে ছোট ছোট পুকুরো রয়েছে।

এখানে রয়েছে গোল্ড ফিস। এখানে পাথরের সঙ্গেই যেন সবকিছুর বসবাস। আর এই পাথর দেখতেই প্রতি বছর ছুটে আসেন বিশ্বের হাজার হাজার মানুষ। চীনারাও এই পাথরের বন দেখতে প্রতিদিন ছুটে যান। ফলে এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের ভীড় লেগেই থাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। আশ্বর্যজনক এই পাথরের বন ঘিরে শোনা যায় যেমন নানান কাহিনী, তেমনি এটিকে ঘিরে রচিত হয়েছে নানা গল্প ও সিনেমা। ফলে পৃথিবীজুড়ে চীনের এই পাথরের পাহাড় বা বনের আগ্রহ সীমাহীন। খাড়া ভাড়া পাথর ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে।

শুক্রবার সরেজমিন পাথরের এই বনে গিয়ে দেখা যায়, বন দেখতে হাজার হাজার মানুষের ভীড়। টিকিট কাটতে যেমন লাইন ধরতে হচ্ছে, তেমনি বনে প্রবেশের গাড়ীতে উঠতেও লাইনে দাড়াতে হচ্ছে। বনের এবং বাসের টিকিট কেটে বনের ভিতর প্রবেশের আগেই পাথরের পাহাড়গুলো যেনো হাত বাড়িয়ে ডাকছে পর্যটকদের। ফলে কুনমিং শহর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই পাথরের পাহাড়টি দেখতে ঢল নামে মানুষের।

একসময় পাহাড়ে প্রবেশের টিকিট মূল্য ছিলো ১৯০ ইউয়ান। তবে পর্যটকদের ঢল দেখে চীনা সরকার সেটিকে কমিয়ে এখন ১৬৫টি ইউয়ানে নিয়ে এসেছে। এই টিকিট কাটার পরে পাহাড়ের ভিতরে প্রবেশ করতে কাটতে হলো বাসের আরেকটি টিকিট। যার মূল্য ২৫ ইউয়ান। এরপর কিছু দূর গিয়ে বাসটির গন্তব্যস্থল শেষ হতেই চোখে পড়ে বিশাল বিশাল পাথরের পাহাড় আর পাহাড়। প্রথমেই চোখে পড়ে একটি পুকুরের ভিতরে দাড়িয়ে থাকা ছোট ছোট নানা রকমের শত শত বিশাল বিশাল পাথর। এই পুকুরের একটু দূর ঘিরে চারিদিকে শুধু পাথর আর পাথর। সবগুলোই দাড়িয়ে রয়েছে।

একটু দূরে গিয়ে দেখা যায়, দুটি পাথরের গা ঘেষে একটি পাথরের বিশালাকার খন্ড মাঝখানে আটকে আছে। দেখে মনে এই যেন পড়ে যাবে দমকা হাওয়ায়। কিন্তু যুগ যুগ ধরে এইভাবেই আটকে আছে আশর্যজনকভাবে। এর পাশেই শত শত পাথরগুলো কোনোটি একে অপরের সঙ্গে আবার কোনোটি আলাদা আলাদা দাড়িয়ে আছে। এই পাথরের ভিতর দিয়েই রয়েছে ছোট ছোট পুকুর।

পাথরের পাহাড় পরিদর্শণের জন্য পুকুরের পাশ দিয়ে পাথর কেটে কেটে করা হয়েছে ছোট ছোট ব্রিজ। এগুলো দেখেও যেনো চোখ জুড়িয়ে যায়।

জানতে চাইলে বনের একজন গাইড হু চেন ইয়া বলেন, এই পাথরের বন নিয়ে রয়েছে নানা গল্প। এটি দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি আকর্ষণীয়। এ কারণেই প্রতিদিন এটিকে দেখতে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসেন। পাথরের এই বন বা পাহাড়গুলো দেখতে ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে একটি। এখানে উঠে গোটা বনের অনেকটা অংশ অবলকন করা যায়।

এই বন দেখতে আসা বাংলাদেশী শিক্ষার্থী ও চীনের কুনমিং সায়েন্স এ্যান্ড এটকনলোজি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খালেদ মাহমুদ সুজন বলেন, বনটি সতি্য আশ্বর্যজনক। তাই এটিকে দেখেত এখন পর্যন্ত দুইবার আসলাম। যত দেখি ততই দেখতে মন চাই। প্রাণজুড়ে যায় দাড়িয়ে থাকা শত শত পাথরের দিকে তাকিয়ে থাকলে।‘

বাংলাদেশের চট্টগ্রামের বাসিন্দা ও কুনমিয়ের বিনস্টলক ইন্টারন্যাশনাল কিন্ডার গার্টেন স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ সাহেদ হোসেন (সোহেল) বলেন, ‌এই বন সারা পৃথিবীজুড়ে বিখ্যাত। এটিকে ঘিরে নানা গল্প-কাহিনী রচিত হয়েছে। আছে সিনেমাও। ফলে বন দেখতে ছুটে এসেছি। এসো মুগ্ধ হয়েছি। কিভাবে একটির পর একটি পাথরের পাহাড়গুলো দাড়িয়ে আচে শত শত বছর ধরে-তা না দেখলে বিশ্বাস করায় দায়।‘

এদিকে উইকিপিডিয়া সূত্র মতে, প্রেমিককে বিয়ে করতে চেয়েছিল উই আদিবাসী এক নারী। কিন্তু সমাজের বাধার মুখে প্রতিষ্ঠা পাইনি ভালোবাসার দাবি। ফলে শোকে জমে পরে পাথর হয়ে যায় আশিমা। মাথায় স্কার্ফ এবং হাতে ঝুড়ি নিয়ে ঘুরতে থাকা সেই নারীর মতো দেখতে একটি পাথরো রয়েছে। এটির সামনে প্রতিবছর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে উই আদিবাসীরা।

চীনের ইউনান প্রদেশের চিরবসন্তের সাইলন জেলার দিকে প্রকৃতির অপার বিস্ময় এই পাথরের পাহাড়। চীনের ইউনান প্রদেশের এই পর্বতমালাটি হিমালয় পর্বতমালারই একটি অংশ। ছোট বড় উঁচু নিচু বিচিত্র পাথর দিগ্বিদিক এমনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যেন এক গভীর জঙ্গল, যে জঙ্গলে পাতায় ছাওয়া সবুজের পরিবর্তে বিশাল সব পাথুরে বৃক্ষ সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে। ২০০৭ সালেই ইউনেস্কো শিলিন পাথুরে বনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বা বিশ্ব ঐতিহ্যকেন্দ্র বলে ঘোষণা করে।

স্টোন ফরেস্টের আজকের এই অবস্থায় পৌছাতে লেগেছিলো প্রায় ২৭০ মিলিয়ন বছর। শত শত বছর ধরে সাগরের তলদেশে জমা হচ্ছিল লাইমস্টোন।

প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে কোনো এক সময় হয়তো এখানে বয়ে গিয়েছিল বড়সড় কোনো ভূমিকম্প, কিংবা রহস্যময় কোনো কারণে এই অঞ্চলে ঘটে এক অভাবনীয় ভৌগোলিক পরিবর্তন। ফলে সাগরের তলদেশের পানি শুকিয়ে যেতে থাকে। আর সাগরের তলদেশ থেকে বেরিয়ে আসে লাখ লাখ বছরের পুরনো বৈচিত্রময় লাইমস্টোনের পাহাড়। পাহাড়গুলো আজো তার বুকের মধ্যে ধারণ করে আছে নানাবিধ সামুদ্রিক ফসিল।

এখানে একটি কথা না বললেই নয়। আমরা ৬ জন রাজশাহী থেকে চীন ভ্রমনে এসেছি। চীনের কুুুনমিং সায়েন্স এন্ড টেকনলোজি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে তাদের স্পোর্টস এন্ড কালচারাল ফেস্টিভ্যালে যোগ দিতে। এই ৬ জনের মধ্যে সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও রাজশাহী চেজ একাডেমির পরিচালক মনিরুজ্জামান আলমগীর তিনি এর আগেই দুইবার এই স্টোন ফরেস্ট পরিদর্শণ করেছেন। আর বাকি ৫ সদস্যের মধ্যে এই প্রতিবেদকসহ রাবির সাবেক রেজিস্ট্রার আমানুল হক, প্রকৌশলী আরেফিন রুমি, ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ ও তার স্ত্রী ফাতেমা কায়সারের এটি প্রথম চীন ভ্রমণ। ফলে স্টোন ফরেস্ট দেখাও প্রথম। সেই স্টোন ফরেষ্ট পরিদর্শনে গিয়ে বয়স্ক আমানুল হক আজাদ শারিরীক অসুস্থতা নিয়েও বসে থাকেননি। ছুটে চলেছিলেন ফরেস্টের এপ্রান্ত ও প্রান্ত।

স/আর