প্রশাসনিক জটিলতায় ডিএনসিসির ডিজিটাল ট্রাফিক সিগন্যাল

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
প্রশাসনিক জটিলতায় আটকে রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ডিজিটাল ট্রাফিক সিগন্যাল। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্মল বায়ু ও টেকশই পরিবেশ (কেইস) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এই বাতিগুলো স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু দুই সিটি করপোরেশন বিভক্ত হওয়ার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটির সঙ্গে উত্তর সিটির প্রশাসনিক এই জটিলতা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিরসনের জন্য দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও প্রকল্প পরিচালকের পক্ষ থেকে ডিএনসিসিকে বারবার পত্র দিলেও আমলে নিচ্ছে না সংস্থাটি। যে কারণে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের যে নির্দেশনা রয়েছে তা বস্তবায়ন হচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যানজট নিরসনে ২০০১-০২ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট’ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় ৮৮টি সড়ক মোড়ে আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি বসানো হয়। নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্পের মাধ্যমে সিগন্যাল বাতিগুলো স্থাপন করে সিটি করপোরেশন। কিন্তু নানা ধরনের ত্রুটির কারণে নির্মাণ শেষে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। এতে যে সময় নির্ধারণ করে দেওয়া ছিল তার সঙ্গে বাস্তব যানবাহনের পরিসংখ্যানের কোনও সামঞ্জস্য ছিল না। সে কারণে বেশ কয়েকবার পরীক্ষামূলকভাবে ট্রাফিক বাতি চালু করা হলেও তা সফলতার মুখ দেখেনি।

২০০৮ সালের শেষের দিকে প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়। সে সময় উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে পুরো ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সমস্যার সৃষ্টি হয়। শহরে দেখা দেয় ভয়াবহ যানজট। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় পরে কাউন্টডাউন বন্ধ করে আগের মতো হাত দিয়ে সিগন্যাল ব্যবস্থায় ফিরে যায় ট্রাফিক পুলিশ। পরে ২০১০ সাল থেকে পাঁচ বছর মেয়াদী প্রকল্পটির দ্বিতীয় দফায় অর্থায়ন করা হয়। মেয়াদ শেষ হয় ২০১৪ সালের জুনে। কিন্তু প্রকল্পটির সুফল পায়নি নগরবাসী। পরে তৃতীয় দফায় মেয়াদ আবারও বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়।

এদিকে ২০১১ সালের শেষের দিকে দুই সিটি করপোরেশন বিভক্ত হওয়ার পর দেখা দেয় প্রশাসনিক জটিলতা। প্রকল্পের মাধ্যমে জি-২ প্যাকেজের আওতায় ডিএনসিসি এলাকায় নির্মিত ২৮টি সিগন্যাল নিয়ে জটিলতা শুরু হয়। এর মধ্যে মেট্রোরেলের কারণে ১২টি সিগন্যাল বাতির অপসারণ করা হয়েছে। বাকি ১৬টি সিগন্যাল বাতির মধ্যে ৯টি কার্যকর থাকলেও অন্য ৭টি সংস্থার উন্নয়নমূলক কাজসহ নানা ত্রুটির কারণে অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে রাজধানীর সিগন্যালবাতিগুলো চালু করার উদ্যোগ নেয় প্রকল্প কর্মকর্তা ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ডিএসসিসির সবকটি ট্রাফিক সিগন্যালের মধ্যে বেশ কয়েকটি রিমোর্ট কট্রোলের পদ্ধতিতে চালু করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো ডিএনসিসির সিগন্যাল বাতির বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না।.

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পের জি-২ প্যাকেজের আওতায় ট্রাফিক সিগন্যাল আমদানিকৃত যন্ত্রপাতির ৭৫ শতাংশ বিল এরই মধ্যে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি ২৫ শতাংশ এখনও পরিশোধ করা হয়নি। এদিকে প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে আগামী ১৫ ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে বাকি বিল পরিশোধ না করা হলে প্রকল্পের অর্থ ফেরত যাবে। বিষয়টি জানিয়ে গত কয়েক বছর ধরে প্রকল্প পরিচালক ও ডিএসসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম ডিএনসিসির মেয়রকে প্রশাসনিক অনুমোদন দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার নথি পাঠিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সংস্থাটি ফাইল অনুমোদন দেয়নি। যে কারণে ডিএনসিসি এলাকার সড়কে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতিগুলো কার্যকর করা যাচ্ছে না।

প্রকল্প পরিচালক তার নথিতে উল্লেখ করেছেন- কেইস প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ আগামী ১৫ ডিসেম্বর নির্ধারিত রয়েছে। প্রকল্প সমাপ্তির পর এ খাতে উদ্বৃত্ত টাকা বিশ্বব্যাংকে ফেরত যাবে এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃক উক্ত ট্রাফিক সিগন্যালগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। সুপারিশকৃত প্রস্তাবগুলো দীর্ঘদিন ধরে অনুমোদন না পাওয়ার কারণে প্রকল্প সমাপ্তির পর কোনও প্রকার আইনি জটিলতা তৈরি হলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকেই তা দেখতে হবে। এক্ষেত্রে কেইস প্রকল্পের কোনও দায়-দায়িত্ব থাকবে না।

গত ১৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিটের ‘ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন’ সংক্রান্ত এক সভায় সিটি করপোরেশন কর্তৃক বাস্তবায়িত ট্রাফিক সিগন্যালে স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনা পুলিশকে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত হয়। সভার রেজ্যুলেশন অনুযায়ী, শহরের ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে রিমোট কন্ট্রোল অটোমেটিক বৈদ্যুতিক সিগন্যাল চালু করতে হবে। এজন্য পরবর্তী ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশ ও সিটি করপোরেশনকে সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে সময়ের মধ্যে সংস্থা দুটি বিষয়টি কার্যকর করতে পারেনি। পুরো ব্যবস্থাপনাটি একটি প্রকল্পের আওতায় থাকায় প্রকল্পের মাধ্যমে বিদেশ থেকে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আমদানি করতে সময় লেগে যায় বলে জানায় ডিএসসিসি।

এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও কেইস প্রকল্পের পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উত্তর সিটির ট্রাফিক সিগন্যালগুলো নিয়ে একটা প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি সমাধান করার জন্য আমরা অনেক দিন ধরে নোট দিয়ে আসছি। কিন্তু ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ এখনও অনুমোদন দিচ্ছে না। প্রকল্পের নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে যদি এই জটিলতা সমাধান করা না যায় তাহলে সিগন্যাল বাতিগুলো কার্যকর করা যাবে না। পাশাপাশি প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত অর্থ ফিরে যাবে।’

তবে ট্রাফিক সিগন্যালগুলোর ব্যাপারে ডিএনসিসির ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আরিফুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা এখনও বুঝে নেইনি। আমরা বলেছি আপনারা আমাদের সচল অবস্থায় বুঝিয়ে দেন, আমরা নেব।’

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ডিএনসিসির সব সিগন্যাল বাতি সচল অবস্থায় ছিলো। কিন্তু তারা অর্থ ছাড় সংক্রান্ত ফাইল অনুমোদন না দেওয়ার কারণে ঠিকাদার এ কাজে নিয়োজিত জনবল প্রত্যাহার করে নিয়ে সিগন্যাল বাতিগুলোর স্যুইচ বন্ধ করে রেখেছেন। কারণ এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে জনবল লাগে তাদের নিয়মিত বেতন ভাতা পরিশোধ করতে হচ্ছে। তাছাড়া বেশ কয়েকটি সিগন্যাল বাতি মেট্রোরেল ও ডিএনসিসির উন্নয়ন কাজের জন্য সরিয়ে রাখা হয়েছে।’