প্রধান প্রকৌশলীর মদদে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে দুর্নীতির মহোৎসব চলছেই

নিজস্ব প্রতিবেদক:

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত চলছে। এরই মধ্যে আরো অন্তত ১০০ কোটি টাকার কাজ বিনা দরপত্রে (টেন্ডার) দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

গত এক বছরে এসব কাজ দেওয়া হয়েছে পছন্দের ঠিকাদারকে। এ ছাড়া সম্প্রতি হজে যাওয়ার আগে একই দিনে রেলওয়ের ফান্ড থেকে ৩৫ লাখ টাকা তোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ টাকার হদিস পাচ্ছেন না গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন।

রাজশাহী রেলওয়ের সূত্র জানায়, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে গত এক বছরে অন্তত ১০০ কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয়েছে বিনা দরপত্রে। ‘এলটিএম’ পদ্ধতির নামে নিয়ম লঙ্ঘন করে পছন্দের ঠিকাদারদের ডেকে ডেকে কাজ দেওয়া হয়েছে নির্দিষ্ট হারে অর্থের বিনিময়ে। ফলে কাজ হয়েছে নিম্নমানের। আবার একই কাজ বারবার করেও অর্থ লোপাট করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলীর ভবনের টিন পরিবর্তন, হিসাব শাখার ভবন সংস্কার, পাবনার হার্ডিঞ্জ ব্রিজের রিবেটিং, রাজশাহী রেলওয়ে অফিসার্স মেস সংস্কার, কয়েকটি স্টেশনে মাটি ভরাট ইত্যাদিতে কোটি কোটি টাকার কাজ। কিন্তু বেশির ভাগ কাজ করা হয়েছে দরপত্র ছাড়াই পছন্দের ঠিকাদারদের দিয়ে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে ভবন সংস্কারের নামে অন্তত ১০ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ টাকা দিয়ে নতুন একটি ভবনই গড়া যেত। কিন্তু তা না করে পুরনো ভবনের টিন পরিবর্তন করে রঙিন টিন লাগানো, কোথাও টাইলস বসানো, রং করাসহ নানা কাজের অজুহাতে টাকা লোপাট করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেলওয়ের ডিজির শ্যালক বদরুল আলমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, আনোয়ারুল ইসলাম বাবু কনস্ট্রাকশন, মোল্লা কনস্ট্রাকশন, মেসার্স পদ্মা ট্রেডিং করপোরেশন ও মেসার্স আব্দুল বাসেত কনস্ট্রাকশনসহ আরো তিন-চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অন্তত ৮০ কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয়েছে বিনা দরপত্রে। প্রাক্কলন ব্যয় নির্ধারণ করে কাজ শুরুর পরে ইচ্ছামতো এসব প্রতিষ্ঠানকে বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এর বাইরে রাজশাহীর কয়েকজন ঠিকাদারকে অন্তত ২০ কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ডিজির শ্যালক বদরুলকে আটটি লুপ লাইট নির্মাণ ও বগুড়া লেভেলক্রসিং গেট নির্মাণকাজের জন্য প্রায় ২৭ কোটি টাকা, আনোয়ারুল ইসলাম বাবুকে স্টেশনে পাথর ও খোয়া ফেলানো কাজের জন্য প্রায় ২০ কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয়েছে। এগুলো সবই দেওয়া হয়েছে কয়েকটি ধাপে দরপত্র ছাড়াই।

সূত্র মতে, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে সহকারী প্রকৌশলীর ভবনের পাশে সম্প্রতি তেল ট্যাংক নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে কাজটি দেওয়া হয়েছে পাবনার আনোয়ারুল ইসলাম নামের এক ঠিকাদারকে। এই ঠিকাদারের সঙ্গে গোপনে যৌথভাবে কাজ করেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ আরিফুল ইসলাম। তাঁর সঙ্গে আঁতাত করে প্রধান প্রকৌশলী রমজান আলী কাজটি দরপত্র ছাড়াই করার অনুমতি দিয়েছেন পছন্দের ঠিকাদারকে। ফলে নিম্নমাণের কাজ করে সরকারের বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের আশঙ্কা রয়েছে।

সূত্র জানায়, রাজশাহী নগরের ভেতরে জামালপুরে এবং কোর্ট স্টেশন এলাকায় দুটি কালভার্ট নির্মাণকাজ করা হয়েছে রাজশাহী মহানগর যুবলীগের বহিষ্কৃত যুগ্ম সম্পাদক তৌহিদুল হক সুমনকে দিয়ে। কাজ দুটির প্রয়োজন ছিল না। সিটি করপোরেশন (রাসিক) এলাকা হওয়ায় তাদেরই কালভার্ট দুটি করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু রাসিকের পরিবর্তে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী বিনা দরপত্রে কাজ দুটি করিয়ে রেলওয়ের প্রায় দুই কোটি টাকা অপচয় করেছেন। একইভাবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মোল্লা কনস্ট্রাকশনকে মুলাডলি স্টেশনে পাথর ও খোয়া ফেলার কাজ দিয়ে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা লোপাটের পাঁয়তারা চলছে। এর আগে উল্লাপাড়া রেলওয়ে স্টেশনে একইভাবে কাজ করে বিপুল অঙ্কের টাকা লোপাট করা হয়।

অভিযোগ উঠেছে, পাবনার পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালের পুরনো ভবন সংস্কারের নামে নতুন করে এক কোটি ৮৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে সরকারি অর্থ অপচয়ের চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রধান প্রকৌশলী রমজান আলী এবং পাকশী বিভাগীয় প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম। এ বিষয়ে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন জামাল হোসেন নামের একজন ঠিকাদার। তিনি বলেন, রেলওয়ের অর্থ পুকুর চুরি করতে এবার এই ধরনের ভূতুড়ে সংস্কারে নেমেছেন ঠিকাদাররা। প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘হাসপাতালের ছাদ দিয়ে পানি পড়ে, সেটির ওপরে নতুন ছাদ দেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন সংস্কার বাবদ এই অর্থ ব্যয় করা হবে। এখানে অনিয়মের সুযোগ নেই। ’

রাজশাহীতে কর্মরত একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী রমজান আলী গত হজের আগে শেষ অফিসের দিনে রেলওয়ের ফান্ড থেকে ৩৫ লাখ টাকা তোলার ব্যবস্থা করেন। এ টাকা কোন কাজে ব্যয় করা হয়েছে, তার হিসাব পাচ্ছেন না গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। বিষয়টি রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানিয়েছে সংস্থাটি।

জানতে চাইলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী রমজান আলী বলেন, ‘কোনো কাজই অনিয়মের মাধ্যমে হয়নি। সব কাজই হয়েছে টেন্ডারের মাধ্যমে। তবে পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালের কাজটি আমি হজে থাকার সময়ে অনুমোদন করা হয়েছে। ’

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রায় ৩০০ কোটি টাকার কাজে অনিয়ম নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গত জুন থেকে তদন্ত সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তারা কী তদন্ত করছে, সেটি তাদের বিষয়। আমাদের কাছে কিছু কাগজপত্র চেয়েছিল, আমরা সরবরাহ করেছি। ’

স/আর