প্রতারকদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব

ই-কমার্স প্রতারণায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রাপ্য অর্থ ফেরত দেওয়ার ফর্মুলা দিয়েছেন আর্থিক খাতের কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ও আমলা। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অভিযুক্ত মালিকপক্ষের হাতে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ সরকার রেশিও অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বণ্টনের উদ্যোগ নিতে পারে। এছাড়া আইন অনুযায়ী এই ক্ষতিপূরণের অর্থ সরকার কিংবা অন্য কারও দেওয়ার কথা নয়। সুযোগও নেই। এই কাজটি সুষ্ঠুভাবে করার জন্য সরকারের তরফ থেকে প্রশাসক বসিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে এসব অর্থসম্পদ নিয়ে কেউ নয়ছয় করতে না পারে, এর রক্ষাকবচও থাকতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলেন, এভাবে প্রতারিত হওয়ার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরাও কম দায়ী নন। এটি তাদের অতি লোভের পরিণতি। যখন ২ লাখ টাকা দামের মোটরসাইকেল ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রির জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো অফার দিয়েছে, তখন কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে না পড়ে দশবার ভাবতে হতো। কেননা দেশে এ ধরনের প্রতারণা নতুন কিছু না। সেই কোটচাঁদপুরের হুন্ডি কাজল থেকে শুরু করে যুবক, ডেসটিনি-কাণ্ডের মতো হায় হায় কোম্পানির বড় বড় প্রতারণার ঘটনা সবার চোখের সামনেই ঘটেছে।

তবে এ কথাও ঠিক যে, যখন এসব প্রতিষ্ঠান চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়েছে, তখনই সরকারের পক্ষ থেকে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। সরকার যেহেতু রাষ্ট্রের অভিভাবক, তাই অভিভাবক হিসাবে ব্যর্থতার দায় তো রয়েছে। তারা মনে করেন, এ বিষয়ে বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধান আরও যুগোপযোগী করে তা কঠোরভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই।

প্রসঙ্গত, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘ই-কমার্সে ক্ষতিগ্রস্তদের দায় নেবে না সরকার। দেশে অন্তত ২০ হাজার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গ্রাহকরা কম দামে পণ্য কিনতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারা কম দামে পণ্য কেনার সময় তো সরকারকে জানাননি। তাহলে তাদের ক্ষতির দায় সরকার এখন নেবে কেন?’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম শনিবার বলেন, ই-কমার্স প্রতারক প্রতিষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রের করণীয় হলো এদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড আর না হয়, এজন্য নতুন একটি আইন করে তা যথাযথভাবে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া। এছাড়া সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা বিক্রির মাধ্যমে গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ যথাসম্ভব মিটিয়ে দেওয়া।

জানা যায়, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে দেশে পৃথক কোনো আইন নেই। এমন সুযোগ নিয়েই ইভ্যালিসহ ১১টি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের কাছ থেকে ৩ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ই-অরেঞ্জ হাতিয়ে নিয়েছে ১১০০ কোটি, ই-ভ্যালি ১ হাজার কোটি, ধামাকা ৮০৩ কোটি, এসপিসি ওয়ার্ল্ড ১৫০ কোটি, এহসান গ্রুপ ১১০ কোটি, নিরাপদ ডটকম ৮ কোটি, চলন্তিকা ৩১ কোটি, সুপম প্রোডাক্ট ৫০ কোটি এবং কিউ ওয়ার্ল্ড মার্কেটিং ১৫ কোটি টাকা। এ তালিকায় এর বাইরে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, বিদ্যমান আইনেই প্রতারক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে সরকার। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার উপায় বের করতে সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রশাসক বসাতে পারে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের গেটওয়েতে এখন পর্যন্ত প্রতারক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর যে পরিমাণ টাকা আটকে আছে, সেগুলোও লক করে সরকারের এখতিয়ারে নিতে হবে। ফলে পরবর্তী সময়ে প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে এই টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বণ্টন করার সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু কোম্পানির হিসাবে স্থানান্তর করা হলে অবশিষ্ট এই অর্থও তারা আত্মসাৎ করবে।

তিনি আরও বলেন, ‘টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের কোনো দায় নেই। কারণ গ্রাহকরা ব্যক্তিগতভাবে সংশ্লিষ্ট ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন করেছে। ব্যক্তি পর্যায়ে লেনদেনে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সরকার সে ক্ষতিপূরণ বাজেট থেকে দিতে পারে না। তবে এ ধরনের প্রতারণা ঠেকাতে পৃথক একটি কর্তৃপক্ষ গঠন, ই-কমার্স ব্যবসা করতে হলে লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক এবং প্রতিটি লেনদেনের বিপরীতে ইন্সুরেন্স রাখার বিধানও রাখতে পারে সরকার।’

এদিকে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত একাধিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন। অপরদিকে পাওনা টাকা পেতে কয়েক লাখ গ্রাহক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন। ভুক্তভোগী গ্রাহকরা পৃথকভাবে একাধিক মামলাও করেছেন।

জানতে চাইলে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ক্ষতিকারক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। এসব কোম্পানি দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের সম্পত্তি বিক্রি করে অর্থ ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য একজন প্রশাসক বা রিসিভার নিয়োগ দেওয়া সমীচীন হবে। সুনির্দিষ্ট নীতি কিংবা গাইডলাইনের ভিত্তিতে রিসিভার সম্পত্তি বিক্রি করে গ্রাহকদের পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিলে সংকট কিছুটা হলেও প্রশমিত হবে। এটি অবশ্য দীর্ঘ প্রক্রিয়া।

তিনি আরও বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ সরকার সরাসরি দিতে পারবে না। কারণ সরকার কার টাকা দেবে। সরকারের নিজের কোনো অর্থ নেই। জনগণের করের টাকা সরকারের হাতে আছে। তাহলে ব্যক্তির ক্ষতিপূরণের টাকা জনগণের ট্যাক্সের পয়সা থেকে দিতে পারে না। ফলে আইন ও বিধি অনুযায়ী এ দায় নিতে পারবে না বলে সরকার যথাথই বলেছে।

সূত্র জানায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে তালিকাভুক্ত ১ হাজার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ই-ক্যাবের হিসাবে এ সংখ্যা দেড় হাজারের বেশি। তবে অধিকাংশের লাইসেন্স নেই। শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে তারা ইকমার্স পরিচালনা করছে। অন্য কোনো জায়গা থেকে এসব প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করা হচ্ছে না। অবশ্য এরই মধ্যে কিছু রুলস অনুসরণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার মতে, নিবন্ধনের আওতায় এলে এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরধারি বেশি করা সম্ভব হবে। তবে আগে যেসব প্রতিষ্ঠান প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, তাদের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, কিংবা ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো কার্যক্রমও চলমান নেই।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আবুল হোসেন মিয়া বলেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কেউ কেউ লাইসেন্স নিয়েছে সিটি করপোরেশন থেকে। অর্থাৎ ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে তারা ব্যবসা পরিচালনা করছে। কেউ আবার রেজিস্ট্রার অব জয়েনস্টক কোম্পানি থেকে নিবন্ধন নিয়েও ব্যবসা চালাচ্ছে। তাই যারা লাইসেন্স দিয়েছে, তাদের দায়িত্ব নিশ্চয়ই আছে। কারণ, লাইসেন্স নিয়ে কে কী ধরনের ব্যবসা করছে, সেটি দেখার দায়িত্ব লাইসেন্সদাতা প্রতিষ্ঠানের।

তবে এক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং রেজিস্ট্রার অব জয়েনস্টক কোম্পানি যৌথভাবে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

 

সূত্রঃ যুগান্তর