পুরান ঢাকার জন্য নতুন নগর পরিকল্পনা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

সাভারে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১ হাজার ১৩৪ জনের মৃত্যু ও আড়াই হাজার লোককে আহত অবস্থায় উদ্ধার করার সময় সারা জাতি কেঁদেছিল। তারও আগে ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলী অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনের মৃত্যুতে মানুষ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। আর ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে নিমতলী থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুন লেগে ৬৯ জন মানুষের মৃত্যু হলো। কী নির্মম সে মৃত্যু, তা কল্পনার অতীত। নিমতলীর ঘটনার পর সরকারি তদন্ত কমিটি ১৭টি সুপারিশ করেছিল; সেগুলো আট বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। উল্লিখিত তিনটি ঘটনা ছাড়াও আরও কত ঘটনায় মানুষের করুণ মৃত্যু আমরা দেখেছি। রানা প্লাজার ঘটনার সময় সাধারণ মানুষ যেমন উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তেমনি এ বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আগুন লাগার ফলে ১ হাজার ২০০–র বেশি রোগীকে উদ্ধার করে অন্যান্য হাসপাতালে স্থানান্তর করার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ আরেকবার প্রমাণ করল যে মানুষ মানুষের জন্য। কিন্তু নিমতলী বা চুড়িহাট্টায় রাসায়নিক পদার্থ বা গ্যাস থেকে আগুন লেগে যে লোমহর্ষক অবস্থার জন্ম হয়, তার কাছে সাধারণ মানুষ বড়ই অসহায়।

অনতিবিলম্বে চকবাজার থেকে রাসায়নিক পদার্থের গুদামগুলো সরিয়ে নেওয়া হবে বলে আশা করি। তবে সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি ও সার্বিক সমাধানের জন্য গোটা পুরান ঢাকার নতুন নগর পরিকল্পনা করা দরকার। কাজটি অনেক আগেই শুরু করা দরকার ছিল। রাজউক চেষ্টা করে এগোতে পারেনি এলাকার বাসিন্দাদের অনাগ্রহের কারণে। জমির মালিকানা থেকে শুরু করে নানা রকমের সমস্যা আছে, যা শত শত বছরের এমন একটি পুরান এলাকায় থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু পুরান ঢাকাবাসীদেরই বুঝতে হবে, রাজউক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পুরান ঢাকাকে ঢেলে সাজাতে আন্তরিক। এলাকাটিকে আধুনিক বসবাসযোগ্য ও ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে গড়তে চায়। এটা আসলে ওই এলাকাবাসীর স্বার্থে। তাই তাদের এগিয়ে আসা উচিত সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে। নিমতলী ও চুড়িহাট্টার দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা পাওয়ার পরও নতুন টাউন প্ল্যানিং নিয়ে থেমে থাকা বা সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই। আমরা বড় দুর্ঘটনা ঘটার আগে কিছু করি না। এমনকি বড় দুর্ঘটনার পরও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে ভবিষ্যতে দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে সচেষ্ট হই না। ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ পান্থপথের বসুন্ধরা সিটিতে আগুন লাগার পর কিছুদিন ঢাকায় ফায়ার ড্রিল করার হুজুগ পড়েছিল—এ কথা সিদ্দিক বাজারের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের হেডকোয়ার্টার থেকে জেনেছিলাম। কিন্তু এখন এ বিষয়ে কিছু শুনি না। কিন্তু এটা নিয়মিত করার বিষয়। নেপাল, ভারতের উত্তরাঞ্চল ও মিয়ানমারে ভূমিকম্পের ফলে আমাদের দেশও কেঁপে ওঠে বলে আমার দু-চার দিন কিছু হইচই করি। কিন্তু আবার চুপ মেরে যাই। বাস্তবতা হলো, মানুষের মৃত্যু যতই নির্মম, অসময়ের ও অগ্রহণযোগ্য হোক না কেন, চোখের পানির সঙ্গে রুহের মাগফিরাত কামনা করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। কিন্তু বেঁচে থাকা মানুষগুলো যেন বেঘোরে প্রাণ না হারায়, সে জন্য দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝে দায়িত্ববানদের যথাযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়।

পুরান ঢাকায় অবস্থিত কিছু ঐতিহাসিক দালান বা স্থাপনা, যা ইউএন হেরিটেজের মর্যাদা পাওয়ার সমতুল্য বা যোগ্য—তা চিহ্নিত হওয়া দরকার। বাকি বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকা নিয়ে নতুন টাউন প্ল্যান হতে হবে। পরিকল্পনাসহ পুরো কাজটি করতে গবেষণা হওয়া দরকার। এটা রাজউক কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আরবান রিজওনাল প্ল্যানিং (ইউআরপি) ডিপার্টমেন্টের সহায়তায় করতে পারে। গবেষণার মাধ্যমে জানা যাবে, কোন ভবন রেখে দিতে হবে এবং কোন ভবন ভেঙে করে নতুন নগর পরিকল্পনার জন্য জায়গা করে দিতে হবে। আরও বিশদভাবে জানা যাবে, নতুন নগর পরিকল্পনার ফলে বর্তমানে পুরান ঢাকার জমির মালিক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক ও আবাসিক ভবনের মালিকেরা কে কতটা সুযোগ-সুবিধা পাবেন এবং কেন পাবেন। প্রজেক্টকে লাভজনক করতে হলে আকাশের দিকে বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। সেটা খুব সহজেই সম্ভব, পুরান ঢাকার মাটি অপেক্ষাকৃত ভালো বলে ফাউন্ডেশনে নির্মাণ খরচ কম হবে।

কাজটি করতে রাজউক দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইউআরপি ডিপার্টমেন্ট এবং অভিজ্ঞ স্থপতি ও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের কাজে লাগাবে। রাজউক দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে পুরান ঢাকার জমির মালিক, বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক করবে। গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে নতুন নগর পরিকল্পনা প্রয়োজন। এতে সার্বিক সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলো তুলে ধরা যাবে। তা ছাড়া, তাঁদের বোঝানো দরকার, বর্তমানে সড়ক এতটাই সরু যে ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভানোর কাজে বড়ই অসহায়। চুড়িহাট্টার দুর্ঘটনায় এটা তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন।

বর্তমানে পুরান ঢাকায় বিক্ষিপ্তভাবে অনেক নতুন বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনের কাজ চলছে, এটা নতুন নগর পরিকল্পনার বিরাট অন্তরায়। নতুন যেসব ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলো রাজউকের অনুমোদনপ্রাপ্ত কি না জানি না। পুরান ঢাকায় বিক্ষিপ্তভাবে কোনো নতুন স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ নেই। সব নির্মাণ নতুন নগর পরিকল্পনার আওতায় সম্মিলিতভাবে হতে হবে। পুরান ঢাকার একটি নগর পরিকল্পনা করার পর সেটিকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একেক ভাগের নির্মাণকাজ শেষ করতে হবে। সময় সর্বোচ্চ তিন বছর। সব ধরনের নাগরিক সুযোগ–সুবিধাসহ চওড়া রাস্তা ও বহুতল ভবন হবে। আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনগুলো এতটা বহুতল হবে, যেন বর্তমানের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। তাহলে অংশীজনেরা নতুন নগর পরিকল্পনার প্রতি সম্মতি–সমর্থন জানাবে।

ঢাকায় সমন্বয়হীনতার কারণে অনেক কাজ ফলপ্রসূ হয় না। বড় প্রজেক্টে অনেকের সহযোগিতা প্রয়োজন। রাজউক যেহেতু ঢাকা শহরের উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, তাই তার নেতৃত্বে কাজ হতে হবে। নিমতলী ও চুড়িহাট্টার মতো আর কোনো হৃদয়বিদারক ঘটনা যাতে না ঘটে, সে জন্য রাজউক ও পুরান ঢাকাবাসীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা দরকার।