পুঠিয়ায় নবজাতকসহ প্রসুতি হত্যার সেই ভুয়া ডাক্তারের যত প্রতারণা

মইদুল ইসলাম মধু:
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলা সদরে অবস্থিত আল-মাহাদী ইসলামী হাসপাতাল নামের একটি বেসরকারী ক্লিনিকে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় গর্ভের নবজাতকসহ প্রসুতির মৃত্যুর ঘটনায় দায়েরকৃত হত্যা মামলায় গ্রেফতার সেই ভূয়া ডাক্তার আব্দুল করিম সম্পর্কে সব চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।

এসএসসি পাশ করেই এমবিবিএস, এফবিবিএস সহ হাড় জোড়া, বাতব্যাথা ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পরিচয় দেয়া সেই ডাক্তার আগেও বিভিন্ন যায়গায় বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে অনেকের সাথে প্রতারণা করেছে। সর্বশেষ গত ৯ আগস্ট উপজেলা সদরে অবস্থিত আল-মাহাদী ইসলামী হাসপাতালে সে এক প্রসুতির সিজারিয়ান অপারেশন করে। কিন্তু ভুল চিকিৎসায় পান্না বেগম নামের ওই প্রসুতির গর্ভের নবজাতকসহ পান্না বেগমের মৃত্যু হয়। দায়েরকৃত হত্যা মামলায় চলতি অক্টোবর মাসের গত ১ তারিখে আবদুল করিমকে গ্রেফতার করে পুঠিয়া থানা পুলিশ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার চকপাড়া গ্রামের বাহাজ উদ্দিনের বড় ছেলে আবদুল করিম ((৫২)। ১৯৮৩ সালে বড়াইগ্রাম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাসের সনদ দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সিপাহী পদে চাকুরিতে যোগদেন । ছুটিতে বাড়ি এসে ম্যাজিস্ট্রেট সেজে এসএসসি পরীক্ষার হলে ঢুকে ধরে পড়লে পুলিশের হাতে আটক হয়ে জেলে যান, হারান সৈনিক পদের চাকরি। ১৯৯০ সালে এইসএসসির ভূয়া সনদপত্র ব্যবহার করে চাকরি নেয় সিংড়া উপজেলার একটি হাইস্কুলে সেখানে কমলা খতুন নামের একটি মেয়েকে বিয়ে করে ওখানেই ঘরজামাই হিসেবে থেকে যান আবদুর করিম। সেখানেও সনদপত্র ভূয়া প্রমানিত হওয়ায় দুই বছর পর চাকরি হারান তিনি। সেখান থেকে নিজ এলাকায় ফিরে কর্মচারি হিসেবে একটি ফার্মেসির দোকানে কাজ শুরু করেন।

সেনাবাহিনীর চাকরি হারিয়ে ভূয়া ম্যাজিস্ট্রেট সেজে জেল খাটার পর শিক্ষকতার চাকরি হারানো আব্দুল করিমের ইচ্ছা যাগে ডাক্তার হবার। সঙ্গে সঙ্গে আব্দুল করিম নাম পরিবর্তন করে ডা. এস এম রিয়াজুল ইসলাম নিজের নাম দিয়ে হয়ে যান হাড় জোড়া, বাতব্যাথা ও শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। রুগি দেখা শুরু করেন নরসিংদী জেলার মনোহরদি উপজেলার হাসপাতাল সংলগ্ন মেডিকেয়ার ডায়গস্টিক হাসপাতালে।

সেখানে তিনি চেম্বারও খোলেন, ৬ বছর পর চলে আসেন কিশোরগঞ্জের ভৈরবে চাকরি নেন একটি বেসরকারী হাসপাতালে। সেখানে এক নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ৭ লাখ টাকাও হাতিয়ে নেয় আব্দুল করিম। পরে বিয়ে না করার পায়তারা শুরু করলে সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি মিমাংশা হয়। এখানেই শেষ নয় আবদুল করিম চলে আসেন সিরাজগঞ্জে সেখানেও একটি হাসপাতালে চাকরি নেন ডাক্তার হিসেবে। প্রতারনার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে চলে আসেন নিজ এলাকায় চাকরি নেন রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলা সদরে অবস্থিত আল-মাহাদী ইসলামী হাসপাতালে নিজের নাম পাল্টে এবার নতুন নাম ব্যবহার করেন ডা. ক্যাপ্টেন (অব) জাহাঙ্গীর আলম। উপাধি হিসেবে ব্যবহার করেন এমবিবিএস, এফবিবিএসসহ বিশেষজ্ঞ জাতীয় উপাধী।

জানা যায়, বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নাম ও উপাধি ব্যবহার কারী আবদুল করিমের রয়েছে তিনটি ছেলে সন্তান। স্থানীয়রা কেও জানেনা সে কোন মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে ডাক্তার হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, সে ভূয়া সনদে হাইস্কুলে চাকরি নিয়ে ধরা পড়ে সেখান থেকে পিটুনি খেয়ে চাকরি হারিয়ে এলাকা ছাড়া হন। দীর্ঘদিনপর সে এলাকায় এসেছে প্রাইভেট কার কিনেছে জমি কিনেছে।

উল্লেখ্য যে, গত ৯ আগস্ট আল-মাহাদি ইসলামী হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশন করার সময় ভূল চিকিৎসায় পান্না খাতুন নামের এক প্রসুতির গর্ভের নবজাতকসহ তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আলামত বুঝে ওটিতে লাশ রেখেই ডাক্তার জাহাঙ্গীর আলম ও ক্লিনিক মালিক মুনসুর রহমান কেটে পড়েন খবর পেয়ে পুঠিয়া থানা পুলিশ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ঘটনাস্থালে আসেন। এসময় ক্লিনিকটির অপারেশন থিয়েটারে প্রসুতির লাশ পায় তবে ক্লিনিকটিতে একজন নার্স মারুফা খতুন ছাড়া ডাক্তার বা মালিক কাউকেই পায়নি।

এসময় আবাসিক মেডিকেল অফিাসার ইমরান খাঁন এ প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন, প্রসুতি মৃত্যুর ঘন্টা খানেকের মধ্যে উন্নত চিকিৎসা দিলে গর্ভের নবজাতককে বাচাঁনো যেত। সেদিনই পুঠিয়ার সাবেক ইউএনও মোছাঃ নাজমা নাহার ক্লিনিকটি সিলগালা করে দেন। সেদিন রাতেই নিহতের স্বামী বাদি হয়ে ক্লিনিক মালিক, ডাক্তারসহ ৪ জনকে আসামী করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) ও পুলিশ পরিদর্শক তদন্ত রাকিবুল হাসান প্রতিবেদককে জানান, ঘটনার দিন ক্লিনিকের নার্সকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেল-হাজতে পাঠানো হয় এবং চলতি মাসের ১ অক্টোবর নাটোর থেকে ভূয়া নাম ব্যবহার কারী সেই ভূয়া ডাক্তারকে গ্রেফতার করা হয়। তার পরদিন ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে তাকে রাজশাহীর চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তোলা হয় আবদুল করিমকে। পরে গত ১২ অক্টোবর শুনানী শেষে ২ দিনের রিমা- মুঞ্জুর করেন আদালত। দুই দিনের রিমা- শেষে গত ১৪ অক্টোবর (শনিবার) বিকেলে তাকে জেল-হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।
স/শ