পুঠিয়ায় অবৈধ ক্লিনিক-ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের ছড়াছড়ি, অপচিকিৎসায় ঘটছে মৃত্যু

মইদুল ইসলাম মধু:
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অনুমোদনহীন ভাবে গড়ে উঠেছে অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্ঠিক সেন্টার। কর্তৃপক্ষের নজরদারীর অভাবে প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিকিৎসার নামে চালানো হচ্ছে অপচিকিৎসা।

অভিযোগ রয়েছে, অনেক ক্লিনিক মালিক নিজেই ডাক্তার সাজেন আবার ভূয়া ডাক্তার সাজিয়ে সিজারিয়ান অপারেশন সহ বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসা দিচ্ছেন।  প্রতিটি ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের ব্যানারে একাধিক এমবিবিএস ডাক্তারের সাইন বোর্ড ঝোলানো থাকলেও তাদের নেই নিজস্ব চিকিৎসক ও অভিজ্ঞ সেবক সেবিকা। ফলে কোনটিতে ভাড়া করা ডাক্তার, কোনটিতে ভুয়া ডাক্তার দিয়ে বিভিন্ন অপারেশন করায় প্রতিনিয়ত ঘটছে রুগি মৃত্যুর ঘটনা।

এছাড়াও ক্লিনিক ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের নামে চিকিৎসা দেয়ার আড়ালে প্রতিষ্ঠান গুলোতে মাদক সেবন ও দেহব্যবসার ঘটনাও ঘটে। জানা গেছে, পুঠিয়া উপজেলা সদর, বানেশ্বর বাজার, ঝলমলিয়া বাজার মিলে অন্তত ২০ টির অধিক ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার রয়েছে। এগুলোর অনেকেরই নেই বৈধ কাগজপত্র, একটি ক্লিনিকে ১০ টি রোগীর জন্য সার্বক্ষনিক একজন এমবিবিএস চিকিৎসক ও একজন ডিপ্লোমা পাশ অভিজ্ঞ সেবক সেবিকা থাকার বিধান রয়েছে।

ডায়াগনষ্টিক সেন্টারগুলোতেও নেই নিজস্ব পরীক্ষক, নিজেরাই নামী দামী কোন পরীক্ষকের ভূয়া সিল সাক্ষর ব্যবহার করে ভুয়া রিপোর্ট দিচ্ছেন। এতে অনেকেই রোগ নিরাময়ের বদলে অস্বাভাবিক স্বাস্থ্য ঝুকিতে পরছেন। ভুক্তভুগি অনেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করলেও অনেকে অভিযোগের বদলে টাকার বিনিময়ে মৃত্যুর ঘটনাও আপস মিমাংশা করে নিচ্ছেন। মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কয়েকটি ক্লিনিকে অভিযান চালানো হলেও স্থায়ী সমাধান মেলেনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলা সদরে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত আল মাহাদী ইসলামি হাসপাতালে গত কয়েক বছরে ভুয়া ডাক্তারের অপচিকিৎসায় একাধিক রোগি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট ভুয়া ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় অপারেশন টেবিলেই গর্ভে নবজাতকসহ পান্না বেগম নামের এক প্রসুতির মৃত্যু হয়।

এব্যপারে মৃত প্রসুতির পরিবারের পক্ষে মামলা দায়ের করা হলে ক্লিনিক মালিক মুনসুর রহমান, ভুয়া ডাক্তার আবদুল করিম ও কর্তব্যরত নার্সকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাৎক্ষনাত প্রশাসন ক্লিনিকটি সিলগালা করলেও জামিনে বেড়িয়ে ক্লিনিক মালিক মুনছুর রহমান প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ক্লিনিকটি আবারো চালু করেছেন এবং ক্লিনিকের পাশাপাশি নতুন করে স্বর্ণা ডায়াগনষ্টিক সেন্টার নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন।

উপজেলার বানেশ্বর বাজারে অবস্থিত গ্রীন লাইফ হসপিটাল নামের বেসরকারী ক্লিনিকে মাদক বিক্রি, অসামাজিক কর্মকা- ঘটানো এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চিকিৎসা দেয়াসহ নানা অভিযোগে ক্লিনিকটিতে একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ক্লিনিকটিতে অভিযান চালিয়ে অসামাজিক কর্মকা-ে লিপ্ত থাকা অবস্থায় একাধীক যৌনকর্মীকে আটক করে ক্লিনিকটি সিলগালা করেন।

প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ক্লিনিকটি আবারো চালু করা হয়। গত বছরের জুন মাসে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ক্লিনিকটিতে অভিযান চালিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চিকিৎসা দেয়া, ক্লিনিকটিতে নিজস্ব চিকিৎসক ও অভিজ্ঞ সেবক সেবিকা না থাকাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে চার লাখ টাকা জড়িমানা অনাদায়ে ক্লিনিকটি সিলগালা করার নির্দেশ দেন। পরে ক্লিনিক মালিক বাবুল তাৎক্ষনাত ৪ লাখ টাকা জরিমানা পরিশোধ করেন। এর কিছুদিন পরেই গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর ক্লিনিকটির অপচিকিৎসায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরন হয়ে লিপি খাতুন নামের এক প্রসুতির মৃত্যু হলেও এব্যপারে কেও অভিযোগ করেনি।

জানা গেছে, মৃত রোগীর পরিবারের সঙ্গে মোটা অংকের অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে বিষয়টি মিমাংসা করা হয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে উপজেলা সদরে অবস্থিত জনসেবা ক্লিনিকে সিজারিয়ান অপারেশনের সময় ডাক্তারের অপচিকিৎসায় অপারেশন টেবিলেই খিচুনি উঠে বিউটি খাতুন নামের এক প্রসুতির মৃত্যু হয় এঘটনায় নবজাতককে বাঁচানো গেলেও আশঙ্কাজনক অবস্থায় রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

পরে তাৎক্ষনিকভাবে ঘটনাটি ধামাচাঁপা দিতে রোগীর পরিবারের সাথে ক্লিনিক মালিক ১ লক্ষ টাকায় বিষয়টি মিমাংশা করেন। এছাড়াও নবজাতক ও প্রসুতি মৃত্যুর অভিযোগ রয়েছে ফাতেমা ক্লিনিক ও গ্রামীন হাসপাতালের বিরুদ্ধে এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চিকিৎসা দেয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে রায়হানা ক্লিনিকের বিরুদ্ধেও। অভিজ্ঞ নিজস্ব পরীক্ষক ছাড়াই সব ধরনের রিপোর্ট দেয়া হচ্ছে স্কয়ার ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, জনসেবা ডায়াগনষ্টিক সেন্টার ও নাজ এক্সরে প্যাথলজি সেন্টারগুলোতে।

সরকারী তালিকাভুক্ত ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের সংখ্যা জানতে চেয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টিএইচও সাইদুর রহমানকে ফোন করা হলে পুঠিয়া থেকে উনার বদলি হয়ে গেছে বলেই তিনি ফোন কেটে দেন। জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, এধরনের অভিযোগের কথা আমিও শুনেছি।

তবে এগুলো দেখভালের দায়িত্ব সিভিল সার্জন অফিসের দাবী করে তিনি বলেন, রাজশাহী সিভিল সার্জনের অফিস থেকে উপজেলায় বেসরকারী ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের তালিকা নিয়ে এবং তালিকার বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোতে অভিযান চালানো হবে। ভুক্তভুগি অনেকে অভিযোগ না করে অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে আপস করার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি আরো বলেন, আপস না করে এব্যপারে ভুক্তভুগিদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

 

স/আ