পুঠিয়া পৌরসভার বেড়েছে আয়, নেই উন্নয়ন

পুঠিয়া প্রতিনিধি :
রাজশাহীর পুঠিয়া পৌরসভা প্রতিষ্ঠার ২২ বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। কাউন্সিলরদের অভিযোগ বছরে কোটি টাকার বেশী রাজস্ব আদায় হয়। কিন্তু টাকার সংকট দেখিয়ে ৮ মাস থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারি ও জনপ্রতিনিধিদের বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। আর খাতা-কলমে উন্নয়ন ও বিল-ভাউচারের মাধ্যমে লোপাট হচ্ছে অর্থ। এই কারণে উল্টা পৌরসভা প্রায় দেড় কোটি টাকা দেনার দায়ে পড়েছে। সেই সাথে পৌর ভবন নির্মাণের বরাদ্দকৃত ৭৫ লাখ টাকার মধ্যে প্রায় অর্ধকোটি টাকা ব্যাঙ্ক থেকে গায়েব করা হয়েছে। নাগরিকদের অভিযোগ পৌরসভা ইচ্ছেমত কর আদায় করছেন। অথচ টাকা ছাড়া এখানে কোনো সেবাই মেলে না।

পৌরসভা সূত্রে জানাগেছে, গত ২০০১ সালে পুঠিয়া পৌরসভা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর সীমানা নিধারণ মামলা জটিলতার কারণে প্রায় ১৫ বছর প্রশাসক দায়িত্ব পালন করেন। গত ২০১৬ সালে প্রথম পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয়বার নির্বাচন হয় ২০২০ সালে। বর্তমান মেয়র আল মামুন ৯৪ লাখ টাকা দেনার বোঝা মাথায় নিয়ে দায়িত্ব নেন। এরপর প্রায় তিন বছরে ৯৪ লাখ টাকার দেনা বেড়ে দাড়িয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকায়। অথচ এই তিন বছরে পৌরসভার রাজস্ব আয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা। অপরদিকে ২০০২ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পৌরসভা ভবন নির্মাণ করতে ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ঠরা দীর্ঘ ২২ বছরেও ভবন নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করতে পারেননি। যার কারণে অর্থ মন্ত্রণালয় বরাদ্দকৃত ভবন নির্মাণের অর্থ ফেরৎ চেয়ে একাধিবার পত্র দিলেও পৌর সংশ্লিষ্ঠরা সে অর্থ ফেরৎ দেয়নি।

কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম রুহুল বলেন, খাতা-কলমে উন্নয়ন ঘটলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। যে যেভাবে পরছে পৌরসভা থেকে লুটে নিচ্ছে। আর নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এ সকল নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। তিনি বলেন, সকল অনিয়মের বিষয় গুলো উল্লেখ করে গত দুই বছর আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, দূণীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগও দেন তিনি।

নাটোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর পুঠিয়া জোনাল অফিসের ডিজিএম ইয়াকুব আলী বলেন, পৌরসভার কাছে তাদের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। গত বছর আরো বেশী ছিল্। আর বিল না দেয়ায় সে সময় দুটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল।

আজিজুল ইসলাম নামের একজন পৌরবাসী অভিযোগ তুলে বলেন, জন্ম, মৃত্যু ও নাগরিক সনদসহ যে কোনো কাগজপত্র তুলতে গেলে টাকা দিতে হয়। অথচ পৌরসভা গঠনের ২৩ বছরে নাগরিকদের অর্থ লুটপাট ছাড়া এলাকায় কোনো উন্নয়ন নেই।

নরুল ইসলাম নামের অপর একজন বলেন, শুনেছি পৌরসভা ‘গ’ থেকে ‘খ; শ্রেণীতে উন্নত হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ ২২ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত পৌরসভার নিজস্ব কোনো ভবন করতে পারেনি। যাযাবরের মত বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া ঘরে চলে দপ্তারিক কাজ। তিনি বলেন, সড়কে কয়েকটি বার্তি ছাড়া উন্নয়ন বলে কিছু নেই। দূনীতি আর অনিয়মের কারণে সড়কের কাজ শেষ না হতেই তা ভাংচুর শুরু হয়।

প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর কামাল হোসেন বলেন, তিনি চলতি বছর কিছু দিনের জন্য ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন। সে সময় পৌরসভার দেনা ছিল প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ টাকা। এখন তা বেড়েছে দেড় কোটির উপর। তার দায়িত্ব থাকা অবস্থায় কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা যথা সময়ে দেয়া হতো। বর্তমানে জনপ্রতিনিধি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ৮ মাস থেকে বেতন বন্ধ। আর গত অর্থ অভাবে আগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও ৬ মাসের ভাতা এখনো পরিশোধ করা হয়নি।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক কাউন্সিররা বলেন, প্রতিবছর হাট বাজার ও বিভিন্ন কর আদায়ের মাধ্যমে পৌরসভার কোটি উপরে রাজস্ব আদায় করা হয়। কিন্তু প্রতিবছর পৌরসভার দেনা কেনো বাড়ে তা রহস্যজনক। তারা বলেন, সহকারি প্রকৌশলী গত ২১ বছর থেকে একই স্থানে কর্মরত। মেয়র ও প্রকৌশলী মিলে নানা কৌশলে বিভিন্ন বিল ভাউচারে মাধ্যমে রাজস্ব আয়ের অর্থ আত্নসাত করেছেন। আর যেটুকু উন্নয়ন হচ্ছে তা মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দকৃত অর্থে। সেই সাথে ব্যাংক একাউন্ট থেকে পৌর ভবন নির্মাণে আসার অর্থ প্রায় পৌনে এক কোটি টাকার বেশীর ভাগ গায়েব করেছেন। মন্ত্রনালয় থেকে ভনন নির্মাণের অর্থ ফেরৎ দেয়ার জন্য কয়েকদফা পত্র আসলেও তারা কোনো কর্ণপাত করছেন না। যা সঠিক ভাবে তদন্ত করলে অর্থ গায়েবের রহস্য বের হবে।
তবে পৌরসভার সহকারি প্রকৌশলী ও ভারপ্রাপ্ত সচিব শহিদুল ইসলাম অর্থ সংকটের কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারি ও জনপ্রতিনিধিদের ৮ মাস থেকে বেতন-ভাতা বন্ধ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ গুলো সব মিথ্যা। পৌরসভার সকল অর্থ ব্যয়ের কাগজপত্র রয়েছে। আর ব্যাংক একাউন্ট থেকে ভবন নির্মাণের অর্থ গায়েবের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।

অপরদিকে মেয়র আল মামুন খান বলেন, তার সময়ে পৌরসভায় ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। কোথাও কোনো অনিয়ম করা হয়নি। ব্যাংক একাউন্ট থেকে ভবন নির্মাণের অর্থ গায়েব ও মন্ত্রণালয় থেকে ওই ফেরৎ না দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আগের মেয়রের সময় হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।

এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক (রাজশাহী) আশরাফুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি সময়ে পুঠিয়া পৌরসভা ভিজিট করা হয়েছে। কোনো অনিয়ম আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ভবন নির্মানের অর্থের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে তিনি নতুন। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে তিনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।