সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
খেলাপি ঋণ ও উচ্চ সুদ দেশের দীর্ঘমেয়াদি টেকসই অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি। তারপরও ঋণখেলাপিদের একের পর এক সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ফলে ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও একটি বড় সমস্যা। এসব কারণে ব্যাংকিং খাতের সংস্কার জরুরি। এর বাইরে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে যেতে দেশের অর্থনীতিতে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলেও মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে- মানসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জন, বৈষম্য দূর করা, দক্ষ জনশক্তি তৈরি, রফতানি বহুমুখীকরণ, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। শনিবার পলিসি রিসার্স ইন্সটিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত চতুর্থ বাংলাদেশ ইকোনমিক ফোরামের (বিইএফ) সম্মেলনে বিভিন্ন অধিবেশনের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। তবে এসব বিষয়ে সরকারের নজর থাকলেও সংস্কারের ক্ষেত্রে ধীরে এগোচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। তিনি বলেন, সংস্কার করা প্রয়োজন, করাও হচ্ছে, আরও করা হবে। তবে ঝুঁকির ভয়ও আছে। এছাড়া ব্যাংকিং খাতে সংস্কার করতে চাইলেও উন্নয়নের ধারা ঠিক রাখতে কখনও কখনও কম্প্রোমাইজ করতে হয়।
রাজধানীর একটি হোটেলে দিনব্যাপী এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ‘স্ট্র্যাটেজিস অ্যান্ড পলিসিস ফর অ্যান আপার-মিডল ইনকাম বাংলাদেশ’-এর উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সাবেক তত্ত্বাবধাক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, পিআরআইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. সাদিক আহমেদ, আইএনএমের নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি, পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তার ও নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। আলোচনায় অংশ নেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, সানেমের নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর সেলিম রায়হান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. সায়মা হক বিদিশা।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন খাতে সংস্কার প্রয়োজন আছে, এটাকে কেউ অস্বীকার করে না। এ বিষয়ে সরকারের চিন্তাও আছে। সময় লাগলেও হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। সংস্কারের ক্ষেত্রে অর্থনীতির নিজস্ব গতি রোধ করা ঠিক নয়। সরকার সেটি পারে না। প্রতিটি পা ফেলার আগে আমরা চিন্তা করছি। ব্যাংকিং খাতে রাজনীতি আছে। এক্ষেত্রে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দেশের নাগরিক হিসেবে চোরকেও সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। কাউকে পেছনে রাখা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এই এক অর্জনেই তো আমাদের স্বর্গে যাওয়ার মতো সনদ পাওয়ার কথা। আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। রাস্তা, সেতু, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন অবকাঠামো ক্ষেত্রে মানুষের চাহিদা বাড়ছে। তাই এত প্রকল্প নিতে হচ্ছে। এতে ক্ষতি নেই। পদ্মা সেতু ছাড়া সব মেগা প্রকল্পই অনট্র্যাকে আছে। এডিপির বাস্তবায়ন বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জমিকে মনে করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র। হাত দিতে গেলেই সমস্যা। ফলে প্রকল্পও বাধাগ্রস্ত হয়।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ঋণখেলাপিদের একের পর এক সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ফলে ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নষ্ট হচ্ছে। এক্ষেত্রে সংস্কার জরুরি। তাছাড়া বেসরকারি বিনিয়োগ আসছে না। ডুয়িং বিজনেস পরিবেশের অবস্থা ভালো নয়। শেয়ারবাজারে এখনও সরকারি কোম্পানিগুলো আসেনি। এদিকে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির তুলনায় করের হার অনেক কম। এতে বৈষম্য বাড়ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তিনি আরও বলেন, প্রয়োজনীয় বরাদ্দের অভাবে প্রকল্প সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন হয় না। আবার যা বরাদ্দ দেয়া হয় সেটিও পুরোপুরি ব্যবহার হচ্ছে না। দেখা যায় অর্থবছরের ৯ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয় ৪৫ শতাংশ আর বাকি ৩ মাসে বাস্তবায়ন হয় ৪৫ শতাংশ। ফলে অর্থ ব্যয় সঠিক হয় না, মিস ইউজ হয়।
ড. সাদিক আহমেদ বলেন, কয়েক বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগ ২০-২৩ শতাংশের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। কিন্তু কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে ৩৬ থেকে ৩৯ শতাংশ বেসরকারি বিনিয়োগের প্রয়োজন। ব্যাংকের উচ্চ সুদহার, খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ঝুঁকির মুখে পড়েছে অর্থনীতি। এই সমস্যার সমাধানে শক্তিশালী শেয়রবাজার, বন্ড মার্কেট ও সরকারি পর্যায় থেকে নীতিগত সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে ব্যাপক হারে। এ খাতে সংস্কার জরুরি। দুর্বল আর্থিক খাত, এক পণ্যনির্ভর রফতানি, রাজস্ব আদায় কম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মানসম্মত উত্তরণ সম্ভব নয়। এজন্য দক্ষতা উন্নয়ন ও আর্থিক খাতে বহুমুখীকরণের বিকল্প নেই। তিনি আরও বলেন, আমাদের বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের কম থাকছে। কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মেগা প্রকল্পগুলোর কস্ট ওভার রান ও টাইম ওভার রান হচ্ছে। ফলে সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার একটি বড় সমস্যা। এছাড়া খেলাপি ঋণ দীর্ঘমেয়াদে টেকসই অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাবে এমনটা হচ্ছে। এসব বিষয়ে নজর দেয়া জরুরি। তাছাড়া চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে মানসম্মত প্রবৃদ্ধির জন্য দক্ষ শ্রমশক্তির প্রয়োজন। কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শিক্ষা খাতে সংস্কার আনতে হবে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পোশাক খাতনির্ভর রফতানি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে পোশাক খাত যেসব প্রণোদনা পায় অন্যান্য সম্ভাবনাময় রফতানিমুখী শিল্পকে সেগুলো দিতে হবে। রফতানি পণ্য যেমন বহুমুখীকরণ করতে হবে, তেমনি রফতানি বাজারও বহুমুখী করা দরকার। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভিত্তিতে রফতানির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। তিনি আরও বলেন, আয় বৈষম্য দেশের অন্যতম একটি সমস্যা। আমরা মধ্য আয়ের দেশে যাচ্ছি কিন্তু অন্তর্ভুক্তিমূলক যাত্রা হচ্ছে না। ফলে এক ধরনের মধ্যম আয়ের ফাঁদ তৈরি হতে পারে।
ড. জাইদী সাত্তার বলেন, সস্তা শ্রমিকনির্ভর রফতানি বেশিদিন থাকবে না। এক সময় রফতানির ৭০ শতাংশ আসত পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে। এখন ৮৪ শতাংশই আসছে পোশাক খাত থেকে। ননগার্মেন্টস খাতে রফতানি অনেক অনেক হলেও আয় হচ্ছে সামান্য। এক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রণোদনাও নেই। দেশীয় শিল্প রক্ষায় ম্যানুফ্যাকচারিং ট্যারিফ কমানো প্রয়োজন। বিশ্ব অর্থনীতির বাজারে অভিগম্যতা বাড়াতে হবে। রফতানি বহুমুখীকরণ করতে পলিসিগত সমস্যার সমাধান করতে হবে।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের রফতানি পোশাক খাতনির্ভর। অন্য পণ্যের অবদান খুবই কম। পণ্য বহুমুখীকরণ হচ্ছে না। নেগোসিয়েশনের দক্ষতা বাড়াতে হবে। তাছাড়া ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ক্ষেত্রে যে সমস্যা রয়েছে তা সমাধান করতে হবে।