পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করছে দেশ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

অবশেষে স্বপ্ন সত্যি হচ্ছে। পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করছে দেশ। আজ দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল স্থাপনা ‘রিঅ্যাক্টর বিল্ডিং’ নির্মাণে কংক্রিট ঢালাই কাজের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে নতুন দিগন্তের আরেক মাইলফলক ছুঁতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কংক্রিট ঢালাই শুরুর পর আগামী ৬৮ মাসের মধ্যেই এ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ১ হাজার ৬২ একর জায়গার ওপর রাশান ফেডারেশনের সহযোগিতায় প্রকল্পের অন্যান্য কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর পাবনা সফরকে কেন্দ্র করে বিরাজ করছে সাজসাজ রব।

প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা। ঈশ্বরদী বিমানবন্দর থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা ও ঈশ্বরদী পৌর এলাকার প্রধান সড়কসহ ১২ কিলোমিটার পথজুড়ে তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে প্রকল্প এলাকায় সাজানো হয়েছে দুটি মঞ্চ।

একটি তৈরি হয়েছে যে স্থানে প্রধানমন্ত্রী কংক্রিট ঢালাই কাজের উদ্বোধন করবেন। অপরটি প্রকল্পের প্রথম চত্বরে। এ মঞ্চে বিশাল সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেবেন তিনি। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে প্রকল্পের ভেতরেই তৈরি করা হয়েছে হেলিপ্যাড। বেলা ১১টা থেকে ১১টা ১০ মিনিটের মধ্যে কংক্রিট ঢালাইয়ের উদ্বোধন করা হবে। এরপর ১১টা ১২ মিনিট থেকে শুরু হবে আলোচনা অনুষ্ঠান।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের সভাপতিত্বে এ সভায় প্রকল্প পরিচিতি তুলে ধরবেন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিচালক ড. মোহাম্মদ শৌকত আকবর। স্বাগত বক্তব্য রাখবেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আনোয়ার হোসেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখবেন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রতিনিধি রোসাটমের মহাপরিচালক মি. আলেক্সি লিখাচেভ, ভূমিমন্ত্রী মো. শামসুর রহমান শরীফ। সব শেষে বক্তব্য রাখবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মিজানুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি অবিস্মরণীয় দিন। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের মাধ্যমেই প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হয়ে যাবে। এ পর্যন্ত আসতে শুরু থেকে অনেক কাজই শেষ করতে হয়েছে। আশা করছি পরবর্তী ধাপের কাজগুলোও পরিকল্পনামতো বাস্তবায়ন হবে।

এর আগে প্রকল্পের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ইউরিক মিখাউল খোসলেভ জানিয়েছিলেন, ২০১৭ সালটি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ‘রিঅ্যাক্টর বিল্ডিং’ মূল পারমাণবিক স্থাপনা তৈরির কাজ শুরু হচ্ছে। মূল স্থাপনার কাজ শুরু হলে তার পরের ৬৮ মাসের মধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সার্বিক কার্যক্রম সরাসরি তদারকি করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনায় রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হয়েছে ৫ হাজার ৮৭ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ।

সূত্র জানায়, দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্র রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে পাবনা জেলার রূপপুর পদ্মার পারে। সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সার্বিক কার্যক্রম তদারকি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়েছে ৫ হাজার ৮৭ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ। চলছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় বা শেষ পর্যায়ের কাজ। এরই অংশ হিসেবে আজ উদ্বোধন হতে যাচ্ছে বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল স্থাপনার ‘রিঅ্যাক্টর বিল্ডিং (উৎপাদন কেন্দ্র)’ নির্মাণ কাজের ঢালাই।

এরই মধ্যে গুটিয়ে আনা হয়েছে স্থাপনাটির ফাউন্ডেশনের (ফাস্ট কংক্রিট পোরিং ডেট বা এফসিডি) সার্বিক কার্যক্রম। দুই পর্যায় মিলে ১ লাখ ১৮ হাজার ১৮০ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটির কাজ ২০১৩ সালে শুরু হয়েছে। প্রকল্প সমাপ্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে। দুই ইউনিটের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২৪শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।

সূত্র জানায়, এ প্রকল্পের জন্য থ্রি প্লাস রিঅ্যাক্টর বসবে। যেটি বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ও আধুনিক প্রযুক্তি, যা কেবল রাশিয়ায় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রয়েছে। আর বাংলাদেশের রূপপুরই হবে এর দ্বিতীয় ব্যবহার। ২০২০ সালের মধ্যেই রিঅ্যাক্টর ভেসেলসহ সব যন্ত্রপাতিই রাশিয়া থেকে চলে আসবে। তারপর প্রকল্প এলাকায় তা সংযোজন করা হবে।

প্রকল্পের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর জানান, পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বলয়ের কারণে এবং রাশিয়ান ফেডারেশনের নির্মিত প্রযুক্তির অ্যাকটিভ ও প্যাসিভ সেফটি সিস্টেমের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় কোনো ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি নেই। এরপরও যদি অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেও, এর তেজস্ক্রিয় পদার্থ জনগণের নাগালের মধ্যে যাবে না।

সূত্র জানায়, মূল স্থাপনার জন্য সয়েল স্টাবলিশমেন্টের কাজ প্রায় শেষ। অর্থাৎ বাংলাদেশের মাটি তুলনামূলক নরম হওয়ায় যন্ত্রের সাহায্যে মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত সিমেন্ট মিশিয়ে দেয়া হয়। এভাবে ১৭ হাজার ৪৫০ কিউবিক মিটার কংক্রিটিং করা হয়। প্রথম পর্যায়ে ৪ হাজার কিউবিক মিটারের কাজ শেষ হয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারির মধ্যেই পুরোটা শেষ হবে। মূল স্থাপনার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হবে ৭০ মিটার করে আর ফাউন্ডেশনের থিকনেস হবে ৩ মিটার।

জানা গেছে, ১৯৬২ সালে আইয়ুব সরকারের আমলে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের জন্য ২৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু অর্ধশতাব্দীকাল ধরে প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। এতকাল ধরে এটি ছিল শুধু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি। বর্তমান সরকারের আমলে রূপপুর ইস্যু হালে পানি পায়। চুক্তি হয় রাশিয়ার সঙ্গে। রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি কর্পোরেশন (রসাটমের) নেতৃত্বে ২০১৩ সালে শুরু হয় দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প কাজ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রথম পর্যায়ে ২৬০ একর জমি পর্যাপ্ত না হওয়ায় রূপপুর চরের আরও ৯৯০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।

নতুনভাবে অধিগ্রহণ করা পদ্মার বিশাল চরে চলছে মাটি ভরাটের কাজ। এদিকে মূল প্রকল্প এলাকার বাইরে তৈরি হচ্ছে গ্রিনসিটি আবাসন পল্লী। পাবনা গণপূর্ত অধিতদফতর এগুলো বাস্তবায়ন করছে। ইতিমধ্যেই তিনটি সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। এ এলাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২০ তলা ১১টি বিল্ডিং এবং ১৬ তলা ৮টি বিল্ডিংয়ের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। ২২টি সুউচ্চ বিল্ডিং তৈরি হবে এ চত্বরে। এছাড়া থাকবে মাল্টিপারপাস হল, মসজিদ ও স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা। যুগান্তর