পানির দাম নির্ধারণ না করায় রাণীনগরে ধান চাষে শুরুতেই ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা 

কাজী কামাল হোসেন, নওগাঁ:
নওগাঁর রাণীনগরে চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে গভীর নূলকূপ থেকে ফসলী জমিতে সেচ প্রদানের ক্ষেত্রে পানির দাম নির্ধারণ না করায় দ্বিগুণ টাকায় পানি কিনতে হচ্ছে চাষিদের। এতে মৌসুমের শুরুতেই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাষিরা। নির্ধারিত দাম না থাকায় গভীর ও অগভীর নূলকূপের মালিক ও তত্ত্বাবধানে থাকা ব্যক্তিরা তাদের ইচ্ছে মত বিঘা প্রতি পানির দর বসিয়ে চাষিদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা।
কৃষকদের অভিযোগ, ব্যক্তি মালিকানার গভীর ও মটর এবং ডিজেলচালিত অগভীর নূলকূপে নেওয়া হচ্ছে প্রতি বিঘায় আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। অথচ একই মাঠে সমিতির মালিকানাধীন গভীর নূলকূপ থেকে সেচ প্রদান বাবদ পুরো মৌসুমে প্রতি বিঘায় এক হাজার ৫০ টাকা নিচ্ছে।
আর রাণীনগর বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কতৃপক্ষ তাদের আওতাধীন গভীর নূলকূপের পানির দাম নির্ধারণ করেছে প্রতি ঘন্টা ১২৫ টাকা অর্থাৎ পুরো মৌসুম মিলে ১ হাজার ২৫০ টাকা। অথচ দ্বায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা নির্ধারিত পানির দাম গোপন করে চাষিদের কাছ থেকে এক হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৫ ০০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি বিঘায় ৫০০ থেকে সাড়ে ১২০০ টাকা অতিরিক্ত নেওয়া হচ্ছে। হাতিয়ে নেওয়া কৃষকের লক্ষ লক্ষ টাকা কার পকেটে যাচ্ছে? এমন প্রশ্ন এলাকার সচেতন মহলের।
বরেন্দ্র’র আওতায় গভীর নূলকূপ গুলোতে নির্ধারিত দামের চেয়ে দ্বিগুণ দাম নেওয়ার অভিযোগ উপজেলা জুড়ে পাওয়া গেলেও মানতে নারাজ সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ।
বর্তমানে রাণীনগর উপজেলার কৃষকরা বুক ভরা আশা নিয়ে কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পুরোদমে ইরি-বোরো ধান রোপণের কাজে ব্যস্ত সময় পাড় করছে। দু’একটি এলাকার কয়েকটি মাঠ ছাড়া সিম্বা, খাগড়া, ছয়বারিয়া, লোহাচূড়া, কাশিমপুর, এনায়েতপুর, গোনা, রাজাপুর, খট্টেশ্বর, বালুভরা, পানলা, দেউলা, বড়গাছা, বেলঘরিয়া, বরিয়া, বরবরিয়া, তেবারিয়া, একডালা, আমগ্রাম, করজগ্রাম, পারইলসহ প্রায় সব মাঠেই ধান রোপণ কাজ প্রায় শেষের দিকে। অথচ উপজেলা সেচ কমিটি’র পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত পানির দাম নির্ধারণ করেননি। ফলে সুযোগ বুঝে নিরহ চাষিদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে গভীর ও অগভীর নূলকূপ মালিক ও তত্ত্বাবধানে থাকা ব্যক্তিরা। নিয়ন্ত্রণ না থাকায় নূলকূপ মালিকদের দেখা-দেখি ডিজেল ও মটরচালিত নূলকূপের মালিকরা তাদের চাইতেও বেশি দামে পানি বিক্রি করছে। তাদের কথা মতই চলতি ইরি-বোরো মৌসুমটা পানি দিবে এই এলাকার চাষিরা। কিন্তু লোকসানের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা কৃষকরা জানেন না যে, পানির দাম এলাকা ভেদে নির্ধারণ করা হয় এবং সেচ সংক্রান্ত বিষয়ে উপজেলা পর্যায়ে একটি সেচ কমিটিও রয়েছে। কৃষকদের কাছ থেকে ইতিমধ্যেই নেওয়া হয়েছে (ইরি-বোরো মৌসুমের) মোট টাকা’র কিছু অংশ, বাঁকী টাকা কিছু দিন পর দিলেই চলবে বলে জানিয়েছেন কর্তা ব্যক্তিরা।
অপর দিকে বরেন্দ্র’র আওতায় গভীর নূলকূপের দ্বায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা জানান, কৃষকদের কাছ থেকে দ্বিগুণ নয়, দুই-চার শ’ টাকা বেশি নেওয়া হয়। তার কারণ হলো- একটি গভীর নলকূপ অপারেটর এক জন, ডেনম্যান হিসেবে এক জনকে মৌসুম ভিত্তিক নিয়োগ দিতে হয়। তাদের বেতন, বিভিন্ন সরঞ্জাম ক্রয়সহ বরেন্দ্র অফিসের একটি নির্ধারিত কার্ড আছে সেই কার্ডে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫ শ’ টাকা করে পুরো মৌসুমে অনেক কয়েক বার রিচার্জ করতে হয়। সব মিলে প্রায় ৬০ হাজার থেকে ৬৫ হাজার টাকা পর্যন্ত রিচার্জ করতে হয়।  বিষয়গুলো কৃষকরা জানে। সবমিলে একটি গভীর নলকূপ পরিচালনা করতে অনেক খরচ হয়। আবার উঁচু-নিচু জমি ভেদে কম-বেশি করে পানি সেচ দিতে হয়। তাতে নির্ধারিত রেট দিয়ে নলকূপ পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। এছাড়াও বড় সমস্যা হচ্ছে সময় মতো কৃষকরা পানির দাম দিতে চায় না। তখন আমরা বিভিন্ন ভাবে বিড়ম্বনার শিকার হই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে চলতি মৌসুমে প্রায় ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধান চাষ করা হচ্ছে। এসব জমিতে চলতি মৌসুমে মোট ২ হাজার ২৩৬টি গভীর ও অগভীর নলকূপ থেকে সেচ প্রদান করা হচ্ছে। গভীর নলকূপ রয়েছে ৪০৬টি। এর মধ্যে ২৬২ টি রয়েছে বরেন্দ্র’র আওতায়। এসব গভীর-অগভীর নলকূপ বর্তমানে পুরোদমে আবাদী জমিতে নিরবচ্ছিন্ন সেচ প্রদান করছে। এই উপজেলার চাষিরা জমি প্রস্তুত শেষে ধান রোপণ কাজও প্রায় শেষ করেছে। এবছর ইরি-বোরো ধান চাষের অনুকূল আবহাওয়া, সঠিক সময়ে ধান রোপণ, নিরবিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ সরবারহ, সার সংকট না থাকায় ফসলও ভাল হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বলে স্থানীয় কৃষি বিভাগ মনে করছেন।
এ ব্যাপারে উপজেলার সিম্বা গ্রামের ইরি-বোরো চাষি অহেদ মিনা ও গফুর মিনা বলেন, আমরা দুই ভাই এবছর বরেন্দ্র’র গভীর নলকূপে প্রায় ১১ বিঘা জমিতে ধান চাষ করছি। প্রতি বিঘাই ১৮ শ’ করে পানি কিনতে হচ্ছে। অগ্রীম কিছু টাকা ডিপের দ্বায়িত্বে থাকা মোসলিম ও রাজাকে দিয়েছি। গত বছর ১৬ শ’ টাকা নিয়েছে এবছর ২ শ’ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। এনায়েতপুর গ্রামের কৃষক খবির উদ্দিন বলেন, ম্যানেজার মোয়াজ্জিমকে প্রতিবিঘা পানির দাম দিতে হচ্ছে ১৮ শ’ টাকা। কাটা-মাড়াই পর্যন্ত যা খরচ হবে তাতে লাভ তো দূরের কথা লসের ঘানি টানতে হবে। পানলা গ্রামের কৃষক হামিদুল ইসলাম জানান, বরেন্দ্র গভীর নলকূপের আওতায় আমি এবছর ২ বিঘা জমিতে ইরি ধান রোপণ করেছি। গভীর নলকূপের অপারেটর এরশাদ আলীকে বিঘা প্রতি ২৭ শ’ টাকা হারে পানির দাম দিতে হবে।
বড়গাছা ইউনিয়নের পানলা গ্রামে স্থাপিত বরেন্দ্র ডিপের দ্বায়িত্বরত অপারেটর এরশাদ আলী প্রতি বিঘা ২৭ টাকা হারে পানির দাম নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে জানান, আমি এখনও কোন কৃষকের কাছ থেকে টাকা নেইনি বা পানির দামও নির্ধারণ করিনি। তবে আমার নলকূপের আওতায় জমিগুলো বেশ উঁচু শ্রেণীর, তাই কৃষকরাই বিবেক করে বিঘাপ্রতি  ১৬/১৮ শ’ টাকা হারে দেয়।
রাণীনগর বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’র সহকারি প্রকৌশলী ও উপজেলা সেচ কমিটির সদস্য সচিব মো: তিতুমীর রহমান জানান, চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে অতিরিক্ত পানির দাম নেওয়ার অভিযোগ এখনও কোন এলাকা থেকে পাইনি। আমাদের অফিসের আওতায় ২৬২টি গভীর নলকূপ রয়েছে। অফিসের নির্ধারিত রেট প্রতি ঘন্টা ১২৫ টাকা করে। কৃষকের কাজ থেকে এর চেয়ে বেশি টাকা কেউ নিলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর উপজেলা সেচ কমিটির পক্ষ থেকে জমির শ্রেণী নির্ধারণের জন্য ইউনিয়নভিত্তিক জরিপ চলছে, দুই এক দিনের মধ্যে এলাকাভিত্তিক পানির দাম নির্ধারণ করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সেচ কমিটির সভাপতি মো: আল মামুন জানান, সরকারিভাবে পানির দাম নির্ধারণ করা আছে। কৃষকের কাছ থেকে অতিরিক্ত পানির দাম নেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে যে সব এলাকার কথা আপনারা (সাংবাদিকরা) বলছেন, সেই সব এলাকায় গিয়ে এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
স/শা