পানিবাহিত রোগতত্ত্ব ও বিশুদ্ধ পানি

তমা মেহেদী  :

২০ বছর বয়সী একজন যুবক “জনাব ক” বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ৬ দিনের চিকিৎসাসেবা সম্পন্ন হওয়ার পরে যখন তিনি সুস্থ, সপ্তম দিনের মাথায় যখন তাকে ছুটি দেওয়ার জন্য চিকিৎসকগণ মনস্থির করলেন তখন ছুটির কাগজ লিখার আগ মুহুর্তে রোগীর ডায়রিয়া শুরু হলো। চিকিৎসকগন মনে করলেন বিষক্রিয়ার কারনেই পূনরায় ডায়রিয়া শুরু হয়েছে। তার ছুটি আটকিয়ে তাকে আরো ২-১ দিন পর্যবেক্ষনের সিদ্ধান্ত হলো।

অতঃপর তার সাথে যারা ছিলেন, তারাও একে একে ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হও্য়া শুরু করলো। বিষয়টি জানার পরে মেডিকেল বোর্ড বসলো, সকলের নমুনা পরীক্ষা করে জানা গেলো এটি আর কিছু নয়, পানিবাহিত ডায়রিয়া।

 

গল্পটি কাল্পনিক হলেও পুরাতন নয়। পুরাতন গল্প নতুন মোড়কে প্রকাশিত।

 

প্রতি বছর হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীকে জায়গা দেওয়া কতৃপক্ষের জন্য কষ্টকর হয়ে যায়। প্রায় হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীদের জন্য ডায়রিয়া কর্ণার আলাদা করে দেওয়া হয়। “Diarrhoea” শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ “উদরাময়”। লোকমুখে ডায়রিয়া শব্দটিই অধিক পরিচিত। ডায়রিয়ার বিভিন্ন লক্ষনের মধ্যে সবচাইতে পরিচিত লক্ষন দিনে ৩-৪ বারের অধিক মলত্যাগ করা বা তরল মল ত্যাগ করা। এর সাথে আরো বেশকিছু লক্ষন সাথে দেখা যেতে পারে যেমন পেট ফেঁপে থাকা, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, ক্ষেত্রবিশেষে জ্বরও থাকতে পারে। সাধারনত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা বিভিন্ন পরজীবীর আক্রমনে মানুষ ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এই সকল অনুজীবের মধ্যে Rotavirus অন্যতম। Norovirus নামে আরো একটি পরজীবী বয়স্কদের পরিপাকতন্ত্রের রোগের জন্য দায়ী। এই সকল অনুজীবদের কারনে ডায়রিয়া হতে পারে এবং এই সকল ভাইরাসই পানি দ্বারা বাহিত হয়। পানিবাহিত আরো একটি পরজীবি, Coliform ব্যাকটেরিয়া, যার আক্রমনে ডায়রিয়া রোগে মানুষ সংক্রমিত হয়।

 

হাসপাতালে বহুবিধ পরজীবির আনাগোনা থাকে সর্বক্ষন। আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানির একটা অভাবের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে নেই বলে সকলে জানলেও এটা সত্য। এক একেকটি ২৫০ মি.লি. বিশুদ্ধ পানির বোতলের বর্তমান বাজারমূল্য ১৫-২০ টাকা। সাধারনত সরকারী হাসপাতাল্র চিকিৎসা গ্রহনে যে সকল রোগীরা আসেন, তাদের অশিকাংশই নিম্ন বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসেন। ইচ্ছা থাকলেও তাদের পক্ষে হয়তো বা বাজারজাত পানি কিনে খাওয়া সম্ভব হয়না। আবার অনেক সময় আমাদের দেশের মানুষ জ্ঞানের অভাবে বা অবজ্ঞার ছলে বিশুদ্ধ পানির বিষয়টা আপস করে বসেন। জনগনের মধ্যে পানিবাহিত রোগ নিয়ে জ্ঞানহীনতা রয়েছে, এই বিষয়টি অস্বীকার করার উপায় নেই। পানিবাহিত রোগ নিয়ে সরকারী বা বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সার্বক্ষনিক ক্যাম্পেইন চালিয়ে যাচ্ছে জনসচেতনা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। অনেক সময় মানুষ জানার পরেও নিরুপায় হয়ে যায় বিশুদ্ধ পানির ব্যাবহার নিয়ে। সরকারী হাসপাতালের মতন একটি জায়গায় প্রায় সকলেই অসহায়ত্ব অনুভব করে। বিভিন্ন হাসপাতাল কতৃপক্ষ হাসপাতালে বিশুদ্ধ পানির ব্যাবস্থা করার উদ্দেশ্যে রিভার্স অসমোসিস ফিলট্রেশনের ব্যাবস্থা করলেও সেটা নেহায়েতই অপর্যাপ্ত। টিউবওয়েল থেকেই সিংহভাগ রোগী পানি সংগ্রহ করেন।

 

জাহাঙীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা বিভাগের ২০০৯ সালের একটি গবেষনায় ০-১৫ CFU/ml (কলোনি ফরমিং ইউনিট/মি.লি.) Coliform sp. ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমনে মানুষের জ্বর, পেট ব্যাথা এবং ডায়রিয়া হতে পারে। সাধারনত টিউবওয়েলের পানি যারা কোনরকম বিশুদ্ধিকরন ছাড়া পান করেন, তারা কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া দ্বারা পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। ডায়রিয়া বা উদরাময় একটি পানিবাহিত রোগ, এই ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। ডায়রিয়া নিরাময় অসম্ভব নয়, তবে নিরাময়ের চাইতে সর্বদাই প্রতিকার শ্রেয়। ডায়রিয়া রোগতত্ত্বে আক্রান্ত হওয়ার পরেও যখন রোগীকে পূনরায় ঔষধের সাথে অবিশুদ্ধ পানিই পান করানো হয়, তখন নিরাময় কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। বিশ্বব্যাপী বিশুদ্ধ পানি এখন মানুষের সবচাইতে প্রয়োজনীয় চাহিদার মধ্যে একটি। বিশুদ্ধ পানি পানের মাধ্যমে ডায়রিয়াসহ বহুবিধ পানিবাহিত রোগ হতে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। পানি বিশুদ্ধিকরনের অনেক রকম প্রক্রিয়া রয়েছে।

এর মধ্যে ১০০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি ফুটিয়ে ফিল্টারিকরন করে পান করা সবথেকে নিরাপদ পন্থা। ১০০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংক্রমনকারী অনেক ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসই সাধারণত নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তবে পানি শুধু ফুটিয়ে পান করলে অনুজীব হতে রক্ষা মিললেও পানিতে থাকা ধুলা-বালি বা ক্ষতিকর কেমিকেল যেমন আর্সেনিক, ক্লোরিন, ফ্লোরিন অথবা শৈবাল জাতীয় পদার্থ থেকেই যায়। এই জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত ফিলট্রেশনের। ফুটন্ত পানি ফিল্টার করে পান করলে পানিবাহিত রোগ হতে অনেকখানিই সুরক্ষা পাওয়া যেতে পারে। নগরায়নের এই যুগে পানি ফুটানোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানীর প্রয়োজন। সরকারী গ্যাসের চুলায় পানি ফুটালে দেশীয় সম্পদের অপব্যাবহার করা হয়। কেনা গ্যাসের অতিরিক্ত মূল্যের কারনে মধ্যবিত্ত পরিবার এই বিষয়টিকে এড়িয়ে চলতে চাইবেন, এইটায় স্বাভাবিক। আবার বর্তমানে বাজারে যে সকল ওয়াটার হিটার পাওয়া যায়, সেই হিটারগুলো অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ করে বলে এটাও মূল্যবৃদ্ধির এই সময়ে কার্যকারী সমাধান নয়।

 

এই সবকিছু বিবেচনা করলে একটি যুক্তিসঙ্গত সমাধান হতে পারে রিভার্স অসমোসিস ফিল্টার। উন্নত বিশ্বে রিভার্স অসমোসিস ফিল্টারের ব্যাবহার বেশ সুপ্রসিদ্ধ। এই ধরনের ফিল্টারগুলোর আয়তন সাধারনত ০.০০০১ মাইক্রন থাকে। বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে অসমোটিক চাপ ব্যাবহার করে পানিকে এই ফিল্টার মেমব্রেনের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করে। সাধারনত ০.০০০১ মাইক্রন মেমব্রেন অতিক্রম করে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর পদার্থসমূহ ফিল্টারজাত পানিতে প্রবেশ করতে পারেনা। তবে রিভার্স অসমোসিস ফিল্টাত ব্যাবহারের একটি প্রতিকূল প্রভাব হচ্ছে, এই ফিলট্রেশনের কারনে পানিতে বর্তমানরত শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় লবন বা মিনারেলসমূহও বাহির হয়ে যায়। উপসংহারে তাই বলা যায়, পানি ফুটিয়ে সাধারন ফিল্টারজাত করে পান করা সবথেকে নিরাপদ উপায়, তবে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির এই সময়ে রিভার্স অসমোসিস ফিল্টার সাধারন মানুষের জন্য উপযোগী বলা যায়।

 

তমা মেহেদী

এম. এস. ইন ফার্মাকোলজী, বি. ফার্ম. (অনার্স)