পশ্চিমবঙ্গে ‘বঙ্গজননী বাহিনী’ বনাম ‘দুর্গা বাহিনী’

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

লোকসভা নির্বাচনে ভারতে যেভাবে নির্বাচনী প্রচারণা হয়েছিল এবং বিজেপির বিরুদ্ধে সমগ্র বিরোধী পক্ষ যেভাবে সে প্রচারণা চালিয়েছিল তাতে এটা ধরে নেয়া হয়েছিল যে, নির্বাচনে বিজেপির পরাজয় একরকম অবশ্যম্ভাবী।

অথচ নির্বাচনের ফলাফল দাঁড়াল সম্পূর্ণ অন্যরকম। বিজেপি নির্বাচনে বিরাট জয় অর্জন করেছে, এমন বিজয় যা তাদের ২০১৪ সালের বিজয়কেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। আসলে বিজেপির হিন্দুত্ববাদ ও সাম্প্রদায়িক প্রচারণা এমনভাবে কাজ করেছিল যাতে তাদের আপাত দুরবস্থা সত্ত্বেও ভারতের জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প তারা চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছিল।

নির্বাচনের অল্প কিছুদিন আগে এক আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মাধ্যমে কাশ্মীরে এক মুসলিম সন্ত্রাসী গ্রুপ চল্লিশজন সামরিক ব্যক্তিকে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে হত্যা করেছিল। এটা যে পরিস্থিতি তৈরি করেছিল তার ফলে বিজেপির সাম্প্রদায়িক প্রচারণা তুঙ্গে তোলা তাদের পক্ষে সহজ হয়েছিল।

তাছাড়া পাকিস্তান সরকারকে এর জন্য দায়ী করে তারা তাদের সাম্প্রদায়িক প্রচারণা অতি উচ্চপর্যায়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিল। ভারতের জনগণের মধ্যে এই প্রচারণা নীরবে এক বড় রকম প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল।

২০১৪ সালে বিজেপি ভারতের কৃষক ও নিুশ্রেণীর লোক দলিতদের থেকে নিয়ে মধ্যবিত্তকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, পাঁচ বছরে শাসনামলে তারা তার কিছুই রক্ষা করেনি। উপরন্তু আম্বানি, টাটাসহ কর্পোরেট স্বার্থের খেদমতই তারা করেছিল। এর ফলে কৃষক থেকে শুরু করে দলিতরা লাখ লাখ লোকের সমাবেশ করে এবং বিশাল বিশাল মিছিল করে বিজেপির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিল।

কিন্তু দেখা গেল নির্বাচনের সময় তারাই বড় আকারে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। এর থেকেই প্রমাণিত হয় ভারতের জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দুত্ববাদ ভেতরে ভেতরে কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল, যাতে তারা নির্বাচনের সময় নিজেদের স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে হিন্দুত্বের জোয়ারে ভেসে গিয়ে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল।

সারা ভারত তো বটেই, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেও ঘটেছিল একই ব্যাপার। নিঃসন্দেহে এটা ঘটেছিল তাদের ধর্মান্ধতা, অসচেতনতা ও পশ্চাৎপদতার কারণে।

১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব কমে আসার পরিবর্তে ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কংগ্রেসই ছিল এর জন্য মূলত দায়ী। বাহ্যত একটি অসাম্প্রদায়িক দল হলেও কংগ্রেস ছিল একটি হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল। তাদের দীর্ঘদিনের শাসনের মধ্য দিয়ে তারা এটাই প্রমাণ করেছিল। কাজেই বিজেপি আকাশ থেকে পড়েনি। সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে বিজেপি এবং তাদের পিতৃসংগঠন আরএসএস হল প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেসেরই সৃষ্টি এবং তাদের শাসনের পরিণতি।

দীর্ঘদিন কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে আসা সত্ত্বেও কংগ্রেসের কাছ থেকে কিছু না পেয়ে মুসলমানরা তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমকে দীর্ঘদিন সমর্থন করেছিল। কিন্তু সিপিএমের ক্ষেত্রেও তারা কিছু পায়নি। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানের সংখ্যা ৩০ শতাংশেরও বেশি। কিন্তু তাদের কর্মসংস্থান মাত্র শতকরা দুই ভাগ থেকেছে সিপিএমের আমলেও। মার্কসবাদী দল হিসেবে পরিচিত হলেও মুসলমানদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তারা কংগ্রেসের নীতিই অনুসরণ করেছিল।

কলকাতায় আমি একবার জ্যোতি বসুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানের সংখ্যা ৩০ শতাংশের বেশি হলেও কর্মসংস্থান ২ শতাংশের নিচে কেন? তিনি বললেন, মুসলমানরা প্রতিযোগিতায় পারে না। অবাক হওয়ার মতো জবাব। কারণ চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা পরীক্ষা থাকলেও কেরানি, দারোয়ান, পিয়ন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষকের জন্য তো প্রতিযোগিতার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাহলে তারা পেছনে পড়ে থাকল কেন?

‘প্রতিযোগিতায়’ তারা যদি না পারে, তাহলে পিছিয়ে পড়া জনগণ হিসেবে তো তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা দরকার। এর উত্তরে তিনি বলেন, সেটা হবে সাম্প্রদায়িকতা! সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে কী অদ্ভুত কথা! তাদেরকে চাকরি না দেয়াটা সাম্প্রদায়িকতা হবে না, অথচ তাদের জন্য চাকরির সংস্থানের ব্যবস্থা হবে সাম্প্রদায়িকতা!! উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই যে, দীর্ঘদিন সিপিএমকে সমর্থন দেয়ার পর তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মুসলমানরা ২০১১ সালে ভোট দিয়েছিল মমতা ব্যানার্জিকে।

মমতা ব্যানার্জি এখন মুসলমানদের ‘পরিত্রাতা’ হিসেবে তাদেরকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা ইত্যাদির বিষয়ে; কিন্তু তিনিও কর্মসংস্থানের বিষয়ে কিছুই করেননি। শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি মাদ্রাসার সংখ্যাও বৃদ্ধি করেছিলেন। কিন্তু এ সবের দ্বারা সাধারণভাবে মুসলমানদের শিক্ষার কোনো উন্নতি হয়নি।

তিনি মসজিদের ইমাম ও মোল্লাদের জন্য কিছু অর্থ বরাদ্দ করে তাদের বেতন বৃদ্ধি করে মুসলমানপ্রীতি দেখিয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখার জন্য হিন্দু-মুসলমান সবার বিরুদ্ধেই সন্ত্রাস করেছিলেন। এর ফলে মমতা ব্যানার্জির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মুসলমানরাও লোকসভা নির্বাচনে অনেক হিন্দুত্ববাদী বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জির অবস্থা খারাপ হওয়ার জন্য এটাও দায়ী।

ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা এখন সেখানকার সমাজ ও রাজনীতিতে এক মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে, যা আগে কোনোদিন দেখা যায়নি। সাম্প্রদায়িকতা অনেকটা সুপ্ত অবস্থায় থাকলেও হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বেশ কিছুটা শান্তির সঙ্গে সহাবস্থান করেছেন। কিন্তু এখন বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কারণে পরিস্থিতির মধ্যে বড়রকম পরিবর্তন ঘটেছে। বিজেপি শুধু উত্তর ভারত থেকে নয়, পশ্চিমবাংলাতেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।

বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ লোক উত্তর-পূর্ব ভারত ও পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন বসবাস করছে- এই ধুয়ো তুলে বিজেপি এনআরসি বা ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন কার্ড প্রবর্তন করে ইতিমধ্যেই উত্তর-পূর্ব ভারতের ৪০ লাখ লোককে বিদেশি গণ্য করে তাদেরকে ভারত থেকে বহিষ্কারের আওয়াজ তুলেছে।

এ ক্ষেত্রে বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ’র ভূমিকা ন্যক্কারজনক। তিনি প্রকাশ্যেই এক্ষেত্রে তার সাম্প্রদায়িক নীতি ঘোষণা করে বলেছেন, বাংলাদেশ এবং অন্য দেশ থেকে যেসব হিন্দু ও বৌদ্ধ ভারতে অভিবাসী হয়েছে, তাদেরকে ভারত নাগরিকত্ব প্রদান করবে। শুধু বহিষ্কার করবে মুসলমানদেরকে। এতেই বোঝা যায় তারা মুসলমানদের ভোটের কোনো পরোয়া করে না।

মমতা ব্যানার্জি এখনও মুসলমান ভোটের দিকে চোখ রেখেছেন এবং সেজন্য তিনি বিজেপির এই মুসলমান বহিষ্কারের ঘোরবিরোধী। নির্বাচনে তাদের বেহাল অবস্থার পর নতুন করে তিনি প্রচারণায় নেমেছেন।

এজন্য তিনি গঠন করেছেন ‘বঙ্গজননী বাহিনী’ নামে এক নতুন সংগঠন (যুগান্তর, ১৩.০৬.২০১৯)। এই বাহিনীর নেতৃত্বদানে রয়েছেন তৃণমূলের সংসদ সদস্য কাকলী ঘোষ দস্তিদার। মমতা ব্যানার্জির এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য বিজেপি এখন পশ্চিমবঙ্গে গঠন করেছে ‘দুর্গা বাহিনী’ ও ‘মাতৃশক্তি বাহিনী’। এর জন্য তারা মন্দিরে মন্দিরে এবং তার বাইরে ব্যাপকভাবে কমিটি গঠন করছে।

পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে মমতা ব্যানার্জি যতই বলুন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য তিনি নিজের প্রাণ দিতেও প্রস্তুত, তার দলের অবস্থা ভালো নয়।

লোকসভা নির্বাচনের সময় পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির সভাপতি বলেছিলেন, এবার পশ্চিমবঙ্গে তো তৃণমূল শক্তিকে ‘হাফ’ করবেন এবং তৃণমূলকে ২০২১ সালের নির্বাচনে ‘সাফ’ করবেন। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতি যেভাবে রয়েছে এবং ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে চলছে তাতে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া দাঁড়িয়েছে প্রায় ষোল আনা।

১৬.০৬.২০১৯

বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল